খবরা-খবর
বসিরহাটে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার আদিবাসী কন্যা

৩০ ডিসেম্বর অর্চনা ঘটক, জয়ন্তী দাশগুপ্ত, শীলা দে সরকার, রামু সোরেন এবং দেবব্রত বিশ্বাসকে নিয়ে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি এবং সি পি আই (এম এল) লিবারেশনের এক যুক্ত প্রতিনিধি দল দুপুর প্রায় ১২টা নাগাদ যখন ন্যাজাট ২নং গ্রাম পঞ্চায়েতের দক্ষিণ আখরাতলা গ্রামের নেতাজিপল্লীতে নিহত আদিবাসী স্বপ্না মালির বাড়ি পৌঁছায়, তখন সেখানে এই কেসের অনুসন্ধানকারী অফিসার (আই ও) ন্যাজাট থানার সুরজিৎ দে সহ দুজন পুলিশ অফিসার কয়েকজন সিভিক ভলান্টিয়ারকে নিয়ে স্বপ্নার বাড়ীর লোকজনের এবং প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন। আই ও-কে সেখানে পাওয়ায় প্রতিনিধিদল তাদের কথা স্বপ্নার বাড়ির এবং গ্রামবাসীদের সামনে বলতে পারে, ফলে স্বপ্নার আত্মীয়স্বজন এবং গ্রামবাসীরা অনেক বেশি ভরসা পান এবং গ্রামবাসীরা বলতে থাকেন, “এইবার পুলিশ ঠিক জায়গায় পড়েছে।” প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে প্রথমে আই ও-র নাম এবং ফোন নাম্বার চাওয়া হয়। এরপর এই কেসে তিনজন অভিযুক্ত থাকলেও বাকি দুজন অর্থাৎ গ্রেফতার হওয়া চন্দন দাসের বাবা এবং মা-কে এখনও কেন গ্রেফতার করা হয়নি তা জানতে চাওয়া হয়, অভিযুক্তদের বাড়ি থেকে দেহ নেওয়ার সময় বাকি দুজন আসামী বাড়িতেই তো ছিল। আই ও বলেন, “আমরা সেদিন কত তাড়াতাড়ি পোস্টমর্টেম করতে নিয়ে যাওয়া যায় সেটা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম, ২৫ তারিখটা বাদ দিন, তারপর থেকে বাকি দুজনকে পাওয়া যাচ্ছে না।” প্রতিনিধিদল বলে, “এটা কোনো কথা হল, আপনারা ধরতে চাইলে পাওয়া যায় না এটা হয় নাকি? অবিলম্বে এদেরকে গ্রেফতার করুন।” পরের বিষয় হল, একটা সুস্থ, সবলা মেয়েকে কোনো একজনের পক্ষে তুলে নিয়ে যাওয়া মোটেই সম্ভব নয়। এই হত্যায় আর কে কে যুক্ত সেটা খোঁজার ব্যাপারে কতদূর এগিয়েছেন? ২৫ তারিখের ঘটনা, আজ ৩০ তারিখ”। তখন আই ও বলেন, “দু-রকম হতে পারে, আপনারা যেটা বলছেন সেটাও হতে পারে, আবার স্বেচ্ছায়ও হতে পারে”। প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে বলা হয়, “আপনার মাথায় মেয়েটি স্বেচ্ছায় গিয়েছিল এটা আসছে কেন, স্বপ্নার মা ও দাদা বাইরে থাকে, বাবা সারাদিন ভ্যান চালায়। সে একা সারাদিন থাকত, সে স্বেচ্ছায় যেতে চাইলে দিনের বেলাতেই যেতে পারত। বাবাকে রাতে খেতে দিয়ে পালাতে যাবে কেন? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, যদি সে স্ব-ইচ্ছায় যাবে তবে খালে তার জুতো বা খালপাড়ে মোবাইল পড়ে থাকবে কেন এবং খালের ধারে ধস্তাধস্তিরও চিহ্ন থাকবে কেন?” তখন আই ও বলেন, “না এটা আপনাদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলা। তখন বলা হয়, “আপনাদের মাথায় এটা আছে বলে, ওকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বড় প্রমাণ খালে পড়ে থাকা তার জুতোজোড়া আপনারা এখনও পর্যন্ত সংগ্রহ করেননি। এর পরে প্রশ্ন করা হয় সেদিন অর্থাৎ ২৪ তারিখ থানার কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের ভূমিকা নিয়ে। তখন আই ও বলেন, “এটা নিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলতে হবে। প্রতিনিধিদল বলে, “সে আমরা তদন্তের গতিপ্রকৃতি দেখে সবার কাছেই যাব। মেয়েটিকে দুস্কৃতিরা তুলে নিয়ে গেছে, ন্যাজাট থানা খবর পাওয়ার পর থানায় কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার মেয়েটির বাড়ি এসে খালে জুতোজোড়া পড়ে আছে দেখলেন এবং খালপাড়ে মোবাইল পাওয়া গেছে শুনে চলে গেলেন। কিছু সময় পরে সেই অফিসারই আবার ফিরে এসে একটা ভিডিও দেখিয়ে বলছেন, “মেয়ের বয়স ২৪ বছর, অভিযুক্তদের বাড়িতে সে স্বেচ্ছায় গেছে এবং ভাল আছে, আমাদের কিছু করার নেই। এখন ওখানে আর যেতে হবে না, কাল সকালে থানায় এসো, মিটমাট করে নিও। পুলিশ অফিসারের করে আনা ভিডিও-য় মেয়েকে দেখে মেয়ে আর বেঁচে আছে কিনা সন্দেহ হওয়ায় পুলিশ অফিসার চলে যাওয়ার সাথে সাথে আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশি কয়েকজন অভিযুক্তের বাড়িতে গিয়ে দেখেন মেয়েটির মুখে গ্যাঁজা বেরিয়ে আছে এবং বিভিন্নরকমভাবে দেখে তাদের মনে হয় মেয়ে বেঁচে নেই। এরপর থানায় বারবার বলার পর সকালে কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের কথায় সুস্থ মেয়েটির মৃতদেহ উদ্ধার হয় কিভাবে? আপনি দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্তকারী অফিসার, এই কেসে আর কে কে জড়িত, কার কি ভূমিকা, সেটা দেখাই তো আপনার কাজ। এই কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের ভূমিকা কি ছিল সেটা দেখা আপনার তদন্তের মধ্যে পড়ে না?” তখন আই ও বলেন, “আপনারা ঠিক বলছেন।” আমরা দাবি করি “অবিলম্বে তদন্ত করে এই হত্যায় আর কে কে জড়িত, পুলিশ অফিসারের ভূমিকা কি ছিল তা বের করে তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে এবং তিন মাসের মধ্যে চার্জশিট দিতে হবে। “মেরে ফেলার আগে ধর্ষণ করা হয়েছিল বলা হলে আই ও বলেন, পোস্ট মর্টেম রিপোর্টেযদি আসে, তাহলে কোর্টে আপীল করা হবে ধর্ষণের ধারা যুক্ত করার জন্য।” আই ও আরও বলেন, “গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্ত চন্দন দাসকে ১০ দিনের পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে তদন্ত করার স্বার্থেই।” এরপর আই ও খাল থেকে জুতোজোড়া সিভিক ভলান্টিয়ারকে দিয়ে তোলায় এবং জুতোজোড়া তোলার ও খালপাড়ে পড়ে থাকা পায়ের ছাপের ছবি তোলে।

স্বপ্নার বাবা অদ্বৈত মালী ভ্যানচালক, মা সীতা মালী কলকাতায় পরিচারিকার কাজ করেন, দাদা অনিল মালী ডানকুনি-নাগের বাজার রুটের বাস চালায় এবং ডানকুনি মাইতি পাড়ায় থাকে। স্বপ্নারা আগে বর্তমান বাসস্থান থেকে ১ কিমি দূরে আদিবাসী গ্রামে থাকত। এখানে এখন স্বপ্নার বাবা-কাকাদের ছয় ভাইয়ের মধ্যে পাঁচ ভাই পরিবার নিয়ে বসবাস করে। ওদের বাড়ির গায়েই খাল এবং খালের ওপারে ইটভাটা। গত ২৪/১২/১৮ তারিখ সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ বাবা কে খেতে দিয়ে মেয়েটি ঘরের বাইরেগেলেই ঐ খালের ওপর দিয়েই তাকে টেনে-হিঁচড়ে ভাটার দিকে নিয়ে যায় অভিযুক্তরা। স্বপ্নার আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশীরা জানান, “গত ২৫ ডিসেম্বর তারিখে যখন পুলিশ ওদের বাড়ী থেকে আধা কিমি দূরের বয়ারমারি গ্রামের অভিযুক্তদের বাড়ী থেকে স্বপ্নার দেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যাচ্ছিল তখন তারা পুলিশের গাড়ি সহ মৃতদেহ আটকে প্রায় তিন ঘন্টা অবরোধ করার পর এস ডি পি ও এসে যখন কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের সন্দেহজনক ভূমিকা নিয়ে তদন্ত করার এবং অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেপ্তার করার আশ্বাস দেন তখন তারা অবরোধ তোলেন।”

এক হত দরিদ্র পরিবারের দু-ভাই বোনের মধ্যে স্বপ্না ছিল ছোট। দারিদ্র ও আনুষঙ্গিক প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে মেয়েটি স্বাবলম্বী ও পরিবারে একটু সচ্ছলতা আনার জন্য পড়াশুনার সাথে সাথে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিও চালাচ্ছিল। কালীনগর কলেজের ভূগোল (সাম্মানিক)-এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণও নিয়েছিল। কলকাতায় একটি চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ারও কথা ছিল। এ ঘটনার ফলে পরিবারটির মেয়ে হারানোর সাথে সাথে অর্থনৈতিক ভাবে একটু ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নও শেষ হয়ে গেল।

স্বপ্নার মা জানান, “অভিযুক্ত ছেলেটি পরিকল্পনা করেই সঙ্গীদের নিয়ে মেয়েকে অপহরণ, ধর্ষণ ও খুন করেছে। আগেও ছেলেটি অ্যাসিড মেরে মেয়ের মুখ বিকৃত করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল।” স্বপ্নার পরিবার এবং প্রতিবেশীরা বলেন যে, “তারা কোনো ভয় বা প্রলোভনের কাছে মাথা নোয়াবেন না। তারা অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান।”

পুলিশ ইউ এস ৩৬৫/৩০২/২০১/১২০ বি ধারায় চন্দন দাসের নামে, বাবা বিভাস দাস ও মায়ের নামে মামলা করলেও, পুলিশের ভূমিকা খুবই সন্দেহজনক।

৩১ ডিসেম্বর স্বপ্নার মা এবং দাদা, দুজন প্রতিবেশিকে নিয়ে বসিরহাটে স্থানীয় সি পি আই (এম এল) নেতা-কর্মীদের কাছে আসেন এবং ন্যায়বিচার যাতে নিশ্চিত হয় সেই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ২৭ ডিসেম্বর থেকেই আমরা স্বপ্না মালীর পরিবারের সাথে যোগাযোগ রেখে চলছি এবং সমস্তরকম সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি।

খণ্ড-26
সংখ্যা-1