কৃষ্ণনগর লোকসভা নির্বাচনে কালীগঞ্জ

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর পার্টি কংগ্রেসে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার দিকনির্দেশ নির্ধারিত হয়েছিল। সেই রাজনৈতিক তাৎপর্য মাথায় রেখে বাংলায় যৌথভাবে প্রচার আন্দোলনের কাজ চলেছিল। নির্বাচনী যুদ্ধে নামার প্রাক্কালে, কৃষ্ণনগর লোকসভা আসনে তার প্রতিচ্ছবির এক রাজনৈতিক পরিবেশে পার্টি থেকে দায়িত্ব নিয়ে কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের কালিগঞ্জ বিধানসভা এলাকায় পার্টি কাজেরসাথে যুক্ত হই।

শুরুতেই আজকের প্রেক্ষাপটে এখানকার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। শুরু হলো পার্টিকর্মী, সদস্য ও দরদীদের সাথে সাক্ষাত, মত বিনিময় পর্ব। সাথে সাথে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, অসংগঠিতভাবে থাকা কমরেডদের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে সামিল করার কাজ। দৈনন্দিন থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাটা পার্টি কর্মীদের মধ্যেই হয়ে গেল। আলোচনায় উঠে এলো কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম না পাওয়া, ১০০ দিনের কাজের বকেয়া মজুরি না পাওয়া, রেশন কার্ড সহ রেশনের খাদ্যসামগ্রী না পাওয়া, আবাস যোজনায় বঞ্চিত গরিবদের ক্ষোভ, পলাশী সুগার মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কর্মরত শ্রমিক ও আখ চাষীদের ক্ষোভ, এর সাথে জুড়ে আছে বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের স্বৈরাচারী দাপটের বিরুদ্ধে জোরালো বিক্ষোভ। অন্যদিকে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের জন্য উচ্ছেদ হওয়া সাধারণ মানুষের রুটি-রুজির টান, তেমনি গ্রাম গঞ্জের দুর্গম কাঁচা রাস্তাগুলি পাকা হওয়া যোগাযোগকে অনেকটা সাবলীল করেছে, কৃষকের কিছুটা সুবিধা হয়েছে। রাস্তায় নেমে পড়েছে ছোট ছোট যানবাহন। কাজ জুটেছে কিছু গ্রামীণ বেকারদের।

লক্ষ্য করছিলাম তৃণমূলের শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভগুলোর উৎস কোথায়? তৃণমূলের অভ্যন্তরে বিশেষ করে মুসলিম সমাজের মধ্যে ক্ষোভ বৃদ্ধির কারণ গত পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, তার সাথে ব্যাপক লাগামছাড়া দুর্নীতি। বিজেপি এটাকে কাজে লাগাতে ব্যস্ত। এর সাথে জুড়ে দিচ্ছে “মুসলিম তোষণের” বিরুদ্ধে হিন্দুদের উস্কে দেওয়ার রাজনীতি। কমবেশি খাচ্ছিল মানুষ। এখানে সিপিএম এর সমর্থনে আরএসপি বিধানসভায় নির্বাচিত হত। এখন তৃণমূল ক্ষমতায়। বামফ্রন্ট ক্ষমতা হারানোর পর থেকে সিপিএম কর্মীদের অনেকেই হতাশাগ্রস্থ, দিশাহারা, কিন্তু নির্বাচনী প্রতিপক্ষ হিসাবে কমরেডসুলভ আচরণ আশা করেও পাওয়া যায়নি। ম্রিয়মান আরএসপি সংগঠন সিপিএম প্রার্থীর হয়ে প্রচারে সামিল হয়েছে। এই ভোটে মূলত তৃণমূলকে পরাজিত করার সিপিএমের জোরালো প্রচার বিজেপির ফ্যাসিবাদী চরিত্রকে কিছুটা হলেও ঢেকে দেয়। পক্ষান্তরে, বিজেপির উত্থানকে জোরালো করতে সহায়তা করে, বামপন্থার স্বাধীন ভূমিকাকে দুর্বল করে। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের স্বাধীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে দুর্বল অবস্থান গণভিত্তি কে দুর্বল করেছে। এবারের নির্বাচনে আমাদের পার্টির উদ্যোগ পার্টি কর্মী ও দরদীদের অনেকাংশকে রাস্তায় নামিয়েছে। অতীতে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে জোরালো কৃষক সংগ্রাম যেমন আমাদের গণভিত্তিকে মজবুত করেছিল, আজকে সেই গণভিত্তি ফিরে পেতে গেলে কৃষক-খেতমজুর সহ অন্যান্য পেশার মানুষদের অধিকারের দাবি নিয়ে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিজেপির বিভাজনের রাজনীতি আর তৃণমূলের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এখানে গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি থেকে নির্বাচিত প্রার্থীদের আখের গোছানোর স্বার্থে তৃণমূলে যোগদানের পরে মানুষের মধ্যে সম্বিত ফেরে, কিন্তু বিকল্প কোথায়?

এখানে হিন্দু, মুসলিম জনসংখ্যার দিক থেকে প্রায় সমান সমান। তাই আরএসএস পরিকল্পিতভাবে ক্যাডার নিযুক্ত করে দীর্ঘ বছর ধরে বিভাজনের রাজনীতি প্রয়োগ করার কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। বিস্তীর্ণ এলাকায় হিন্দু, মুসলিম গ্রামগুলি কোথাও আলাদা আলাদা, কোথাও একই গ্রামে এ পাড়া ওপাড়া, কোথাও পাশাপাশি বসবাস। গঙ্গার তীরবর্তী কিছু গ্রাম আছে যারা গো-পালক ঘোষেদের গ্রাম হিসেবে খ্যাত। তাদের একটা ক্ষুদ্র অংশ গঙ্গার ভাঙ্গনে উচ্ছেদ হওয়া, পেশার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে গঞ্জে আসা, কমবেশি চলছেই। সহজ সরল অথচ একরোখা এই মানুষগুলোকে বিজেপি ও আরএসএস মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে কাজে লাগায়। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর ক্ষুধার্ত কর্মহীন মানুষ কাজের তাগিদে বিভেদের ভয় ভুলে কাজে যোগ দিয়েছিল, বিভেদের রাজনীতি মৃত্যু ঘটিয়েছিল পাঁচ জনের। পরিযায়ী শ্রমিকদের অর্থের পুঁজি গ্রামের ভাগচাষী অনুৎপাদনশীল ধনী ও জোতদার শ্রেণীর কাছ থেকে কম পরিমাণে হলেও কৃষি জমি ক্রয় করতে সক্ষম হয়েছে। এটাকে ধরে মুসলিমদের সম্পত্তি বৃদ্ধি বিজেপির বিভাজনের রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ৮ হাজার একর জমি ঘিরে পলাশীর সুগার মিল প্রায় দু বছর বন্ধ, একদিকে কারখানার গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি বিক্রয়, কৃষি জমি গুলিতে লিজ দেওয়া, মাটি খনন করে বিক্রি করে দেওয়া, ইত্যাদি কৃষিভিত্তিক শিল্পকে ধ্বংস করেছে। সুগার মিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত খৈতান কোম্পানি ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের জোরালো প্রচার নেই, আন্দোলন নেই। আমাদের পার্টির সামান্য প্রচার দাগ কাটতে পারে না। সঠিক অর্থে এই আন্দোলন একদিকে কৃষি শ্রমিকদের, অন্যদিকে কারখানার শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করে বিভাজনের রাজনীতিকে মাটি ছাড়া করা যায়।

কাঁসা-পিতলের জিনিস উৎপাদনের বিখ্যাত মাটিয়ারী থেকে শুরু করে গঙ্গার তীরবর্তী বেশিরভাগ গ্রাম মৎস্যজীবী, পিতল কাঁসা শিল্পের শ্রমিক, গঙ্গার বালি তোলার শ্রমিক যারা ওই এলাকার তপসিলি জাতি ও উপজাতির মানুষ। এদের মধ্যে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেল। এই সব এলাকায় কয়েকটি গ্রামে আমাদের ছোট ছোট কাজের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচার করতে পেরেছি।

নির্বাচনী কাজের মধ্যে এসে গেল ২২ এপ্রিল পার্ প্রতিষ্ঠা দিবস, পালন হল দেবগ্রামে কমরেড নীলকণ্ঠের বাড়িতে, যেটা অলিখিত পার্টি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। এদিন নির্বাচনী কাজের সহায়তায় উপস্থিত হলেন রাজ্য পার্টির নেতৃত্ব অভিজিৎ মজুমদার ও বাসুদেব বোস। পতাকা উত্তোলনের পর, অভিজিৎ মজুমদার সিপিআই(এমএল) পার্টির জন্মের রাজনৈতিক তাৎপর্য — নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলন — “জনগণের স্বার্থ পার্টির স্বার্থ” নিয়ে উপস্থিত কমরেডদের উপযোগী সহজ-সরলভাবে বোঝালেন, ভালো লেগেছিল সেদিন।

নির্বাচনের প্রথম পর্বে দেওয়াল লেখা ও তারপর প্রার্থী পরিচিতি, গ্রাম বৈঠক, কর্মী বৈঠক, পথসভা, কয়েকটা অঞ্চল জুড়ে গাড়িতে প্রচার, পোস্টার লাগানো, প্রার্থীর তিন তারা চিহ্ন পরিচিতি, অবশেষে কিছু এজেন্ট দিতে পারা গেছে। এলাকার মানুষ সিপিআই(এমএল)-কে পুনরায় স্বমহিমায় আবারো তাদের রুটি-রুজির দৈনিক সংগ্রামে ফিরে পেতে চায়।

শেষমেষ একটা ছোট্ট অভিজ্ঞতা যা না বললে নয়। একদিন প্রচারে বিকেলবেলা আমাদের পার্টির পুরনো কাজের গ্রাম গঙ্গা নদীর লাগোয়া ঘাসুরিয়াডাঙ্গা পৌঁছালে সম্মানের সাথে বসার ব্যবস্থা হল, জড়ো হল বেশ কিছু যুবক আর বয়স্করা, মহিলারা আশেপাশের উঁকিঝুঁকি মারছে।এই সময় খালি গলায় পার্টির প্রার্থী সুবিমল সেনগুপ্ত, বাসুদেব বোস ও রাজ্য সম্পাদক কমরেড পার্থ ঘোষ বক্তব্য রাখেন। শোনার পর, একজন যুবক বলে উঠলো “আমরা ভুল করেছি, আমাদের ভুল ছিল, আবার এই পার্টিটা আমরা করব”। পরে তারা পার্টির প্রচার, অর্থ সংগ্রহ, এজেন্ট ও কিছু ভোট করার মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিল আমরা আছি থাকবো। এভাবেই পুরনো শক্তি নতুন করে আবার ফিরে আসছে কালীগঞ্জে।

খণ্ড-26