ঘটনা ও প্রবণতা

পশ্চিমবাংলায় প্রায় প্রত্যেকটা দিন বিজেপি কিছু না কিছু দখলের হামলা চালাচ্ছে। বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতি লেলিহান হচ্ছে। যা কিছু পক্ষে আসছে না তার প্রতি শত্রু-মনোভাব ছড়িয়ে দাও, ধর্মের জিগির তুলে হোক বা ভাষাগত বৈরিতার উন্মাদনা সৃষ্টি করে হোক, যা কিছু বাধা তাকে বাধ্য কর বশ্যতা মানতে, নয়ত তার সবকিছু জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও, হত্যা কর, জীবন তছনছ করে দাও, সন্ত্রাসের অরাজকতা-বিভৎসতায় হাড়হিম ধরিয়ে দাও!! বিজেপি এইরকমই স্বমূর্তি ধারণ করেছে গ্রাম-গ্রামান্তরে, মজদুর-মহল্লায় মহল্লায়। ওরা এভাবে সব অংশের জনজীবনের ক্ষেত্রগুলোতে দখল পেতে উন্মত্ত।

যে কোনো রাজনৈতিক হত্যা সাধারণভাবে দুঃখজনক। কিন্তু তা যদি সাম্প্রদায়িক চরিত্রের হয় অথবা শাসক দলের দিক থেকে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় তাহলে প্রকৃত গণতান্ত্রিক বিবেকবান দৃষ্টিকোণ থেকে শুধু দুঃখপ্রকাশ নয়, প্রতিবাদে ধিক্কারে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন, দরকার হত্যার পিছনে কাজ করা নির্দিষ্ট রাজনীতির স্বরূপটিকে চেনা এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বৈপরীত্যের প্রবণতাকে উন্মোচিত করা। এই পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষ্যণীয় নির্বাচনোত্তর সন্দেশখালিতে প্রথম আক্রমণটি সংঘটিত করে বিজেপি। সেখানে বহুদিন যাবত দুদলের মধ্যে সংঘাত ফেটে পড়ার পরিস্থিতি ধূমায়িত হচ্ছিল। দেশজুড়ে জেতা এবং বাংলায় নজীরবিহীন মাত্রায় আসন দখল তথা দ্বিতীয় স্থানাধিপত্য কায়েম করা বিজেপিকে যেমন আরও আগ্রাসী করে তোলে, তেমনি সন্দেশখালি বিধানসভা যার অধীন সেই বসিরহাট লোকসভায় প্রায় মেরুকৃত মুসলিম ভোটপুষ্ট তৃণমূলের কাছে হেরে যাওয়া বিজেপির মধ্যে আক্রোশের জন্ম দেয়। আর সেই আগ্রাসী আক্রোশ থেকে বিজেপিই প্রথমে একজনকে হত্যার পন্থা নেয়। পাল্টা হত্যা সংঘটিত করে তৃণমূল একের বদলা নিয়ে দজনকে। তৃণমূলের ছত্রছায়ায় বদলার খুনখারাবি চালানোর পেছনে মুসলিম এক কুখ্যাত ভেড়ী মাফিয়ার ভূমিকা থাকার কথা উঠে এসেছে। কিন্তু তাতে প্রধানত বিজেপির দায়ভাগ ও সুপরিকল্পনার অপরাধ এতটুকু লঘু প্রতিপন্ন হয়না। ওখানে হিংসা-প্রতিহিংসার যে সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি হল তার সূত্রপাত ঘটিয়েছে বিজেপি। দীর্ঘদিন ধরে ওখানে সক্রিয় বিজেপি-আরএসএস। ঘটনার ঘনঘটা থেকে বিজেপি ছড়াচ্ছে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির বিষ এবং বলাবাহুল্য নিশানায় রাখছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে ইতিমধ্যেই এই প্রবণতা উন্মোচিত হয়ে গেছে যে, ব্যারাকপুর লোকসভা ও ভাটপাড়া বিধানসভা নির্বাচনের আগে-পরে তৃণমূলে ভাঙ্গন এবং দলছুটদের বিজেপিতে যোগদান দাঙ্গার রাজনীতি ছড়ানোর মাধ্যমে বিজেপির দৌরাত্ম কায়েমে পরিণত হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্যে বড় মাত্রায় পরিবর্তন ঘটাচ্ছে বিজেপির অনুকূলে। এন আর এস হাসপাতালে এক রোগীর দুঃখজনক মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসকদের ওপর হামলা ঘটল। এই পরিণতির মূল উৎস হল পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাব যা রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্যনীতির জনস্বার্থ সংকোচনরীতির অঙ্গ। অন্য গন্ধ না পেলে বিজেপি এক্ষেত্রে হয়তো তৃণমূল সরকারের স্বাস্থ্য নীতি নিয়ে তুলকালাম করত। কিন্তু শুঁকেছে নিজেদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উপলক্ষ। ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিজেপি প্রতিনিধিরা ঘোঁট পাকাতে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করল এই বলে যে, আক্রমণকারীরা এক নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের লোকজন। অর্থাৎ বকলমে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ ছড়াতে চাইল। ঘটনাচক্রে আক্রান্ত ও গুরুতর আহত জুনিয়র ডাক্তাররা হিন্দু পরিচিতির, আর হামলাকারীরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তাররা গোড়াতেই বিজেপি নেতাদের সাম্প্রদায়িকতার রঙ চড়ানোর অভিসন্ধিতে জল ঢেলে দিয়েছেন। তারা মনে করেন, হামলাকারীদের ধর্মীয় পরিচয়ে চিহ্নিত করার কোনো প্রয়োজন নেই। তবু বিজেপি তার উদ্দেশ্যমূলক অসত্য বা বিকৃত প্রচার থেকে বিরত হচ্ছে না, হওয়ার নয়।

রাজ্যে নিযুক্ত রাজ্যপাল জানা কথা যে বিজেপি মনোনীত এবং আরএসএস অনুগত। এই রাজ্যপালকে ঢাল করে এরাজ্যে তাদের বিস্তারের উদ্দেশ্যে তাদের নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপকে ব্যবহারের দুরভিসন্ধি বিজেপির বরাবরই রয়েছে। রাজ্যপাল সুযোগ পেলেই বিজেপির সুবিধার্থেঝেড়ে কাশেন। তার সংকেত শুরুতেই তিনি দিয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। বিজেপির হয়ে জ্যাঠামী তিনি মাঝেমধ্যেই করে বসেন। সেভাবেই বলে বসলেন, সন্দেশখালী ঘটনা প্রসঙ্গে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের প্রস্তাব বিবেচনায় স্থান পেতে পারে। বিজেপির ছাত্র শাখা এবিভিপি এযাবত এরাজ্যে যদিও সময়ে সময়ে কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে, মহাবিদ্যালয়ে সিঁদ কেটে ঢোকার চেষ্টা চালিয়েছে, তবে তেমন ছাতা খুলতে পারেনি। কিন্তু এখন এখানে বিজেপির আক্রমণাত্মক চেহারা দেখে গরম খেয়ে গিয়ে এবিভিপি খোয়াব দেখছে দৈত্যকায় হওয়ার, এক মাসের মধ্যেই নাকি লম্বা লাফ দেবে, পাঁচশ ইউনিট ও দেড় লাখ সদস্য করবে! রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মধ্যেও মাথা তুলতে শুরু করেছে বিজেপি-মুখী অংশ।

তাই ঘটনা ও প্রবণতা বলছে, বাংলায় বিজেপি-ই দেখা দিচ্ছে সবচেয়ে বড় বিপদ হিসাবে। তার মানে এই নয় যে তৃণমূলী স্বৈরাচার কোনরকম ছাড় পাবে। তবু বেজে উঠছে সময়ের ঘড়ি, বিজেপি হটাও রণধ্বনি তুলে আসুন বাম গণতান্ত্রিক শক্তি সবাই হাতে হাত ধরি, পায়ে পায়ে এগিয়ে চলি।

খণ্ড-26