জাতীয় শিক্ষানীতির নয়া খসড়া সম্পর্কেপ্রাথমিক পর্যবেক্ষণ

কেন্দ্রীয় সরকার ‘নতুন শিক্ষানীতির খসড়া’ প্রকাশ করতেই তা তৎক্ষণাৎ প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়ে। এই বিক্ষোভ আসে মূলত হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতায়। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি উত্তাল হয়ে উঠতে শুরু করে এবং দু’দিনের মধ্যে সরকার খসড়ায় সংশোধন এনে জানায় যে জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার কোনও ইচ্ছা তাদের নাই। প্রথম খসড়ায় ‘ভাষা নির্বাচনে নমনীয়তা’ ধারায় বলা হয়েছিল যে ছাত্রছাত্রীরা ষষ্ঠ অথবা সপ্তম গ্রেডে উঠে ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে ইচ্ছে করলে একটি বদল আনতে পারবে। যে তিনটি ভাষা তারা শিখছিল তার মধ্যে একটি বদল করে অন্য একটি নতুন ভাষা নিতে পারবে, কিন্তু হিন্দি ও ইংরেজি শেখা চালিয়ে যেতে হবে। বলাই বাহুল্য, এই নির্দেশের অর্থহিন্দি ও ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করা। ইংরেজি শিখতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়, কিন্তু হিন্দিকে এভাবে বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্রোহ শুরু হয় এবং দু’দিনের মধ্যে নয়া শিক্ষানীতির খসড়ার ৪.৫.৯ বিন্দুটি সংশোধিত করে ‘হিন্দি ও ইংরেজি শেখা চালিয়ে যেতে হবে’ বাক্যাংশটি মুছে দেওয়া হয়। এই সংশোধনের ফলে বিদ্রোহের আগুন সাময়িকভাবে স্তিমিত হলেও বিরোধিতা থামেনি। কারণ, খসড়াতে যেভাবে ত্রিভাষা সূত্রকে তুলে ধরা হয়েছে তার মধ্যেই বাস্তবে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বীজ লুকিয়ে আছে বলে মনে করেন অধিকাংশ শিক্ষাবিদ।

সরকারি হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এই সংবেদনশীল আলোড়ন অতিক্রম করে সামগ্রিকভাবে ‘খসড়া নয়া শিক্ষানীতি’-র সমালোচনামূলক পর্যবেক্ষণ শুরু হয়েছে। শিক্ষানীতির খসড়াটি প্রস্তুত করার কাজে শিক্ষাজগতের বেশ কিছু উচ্চপদস্থ ব্যক্তিকে নিয়োগ করা হয়েছিল এবং পেশ করা খসড়ায় তাঁরা জানিয়েছেন যে বিভিন্ন ধরনের স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে বহু পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতেই তাঁরা খসড়া চুড়ান্ত করেছেন। বাস্তবিকই তাঁরা তা করতে চেয়েছেন। ফলত অনেক প্রয়োজনীয় দিক খসড়ায় এসেছে। কিন্তু মাথার ওপর বসে থাকা কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলনও প্রতি পদে ফিরে ফিরে এসেছে। সমগ্র খসড়াটিই তাই অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ। অনেক বিষয়ে মহতী উদ্দেশ্য ঘোষণা করেও তা বাস্তবায়িত করার প্রশ্নে সম্পূর্ণ বিপরীত ফলদায়ী পন্থার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল সমস্যাগুলিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া এই অন্তর্দ্বন্দ্বকে প্রকট করেছে।

৪৮৪ পৃষ্ঠার সুবিশাল খসড়াটি পড়তে শুরু করলে বেশ চমকিত হতে হয় ভালো ভালো কথা আর ভঙ্গীমার বাহার দেখে। কিন্তু সেসব দিয়েও ‘নয়া শিক্ষানীতির’ স্বরূপ চাপা থাকেনি। ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকার একটি প্রবন্ধে একে ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে; নতুন বোতলটি মনোহারি এবং পুরনো মদ বলতে বোঝানো হয়েছে ২০১৬ সালে এই সরকার যে নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাবনা এনেছিল তাকে। ২০১৬র প্রস্তাবনায় শিক্ষার গৈরিকীকরণের ছক এতটাই উদগ্রভাবে প্রকাশিত ছিল যে তা সেই সময় ‘মনু ও মেকলের ককটেল’ হিসেবে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তা বাতিল করে বর্তমান খসড়াটির কাজ শুরু হয়। বস্তুত নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রথম পর্বেশিক্ষা ব্যবস্থার নানা প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ধারাবাহিক তীব্র আন্দোলন চলেছে এবং শিক্ষাজগতের প্রায় সমস্ত অংশ থেকেই মোদি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠতে দেখা গেছে। সরকারি স্কুলশিক্ষার বাজেট বরাদ্দে ব্যাপক হ্রাস, সর্বশিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে সংকুচিত করা, প্রান্তিক বর্গথেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের স্কলারশিপ বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া, নন নেট ফেলোশিপ তুলে দেওয়া, রিলায়েন্স কোম্পানীর ভূয়ো ইউনিভার্সিটি জিওর জন্য হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা, ইউজিসির মাধ্যমে ‘গ্রান্ট’ দেওয়ার ব্যবস্থা তুলে দিয়ে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাধ্যমে ‘লোন’ দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করার প্রচেষ্টা, বিভিন্ন রাজ্যের পাঠ্যসূচীতে ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক ও অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার ব্যাপক অনুপ্রবেশ, জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস বা ইতিহাস কংগ্রেসে গৈরিক আগ্রাসন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির উপাচার্যনিয়োগে প্রত্যক্ষ সংকীর্ণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ইত্যাদি পদক্ষেপগুলি ব্যাপক সমালোচনা ও বিরোধিতার মুখে পড়ে। পর্ব-২ এর শুরুতে শিক্ষানীতির যে খসড়া প্রকাশ করা হল তার চমকপ্রদ প্রতিশ্রুতিগুলি আসলে প্রথম পর্বের সমস্ত অপকর্মকে এক চোখধাঁধানো আবরণে মুড়ে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা মাত্র। শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে কর্পোরেট ব্যবসায় পরিণত করার পথে যেটুকু বাধা এতদিন ছিল তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের রোমান্টিক গৌরব তথা ‘ভারতীয় জ্ঞানচর্চা’ ফিরিয়ে আনার ঘোষণার মাধ্যমে খোলাখুলিভাবেই গৈরিকীকরণকে শিক্ষাসূচীর মূল লক্ষ্য করা হয়েছে।

খসড়ায় সবচেয়ে সদর্থক দিক ‘শিক্ষার অধিকার আইন, ২০০৯’-কে প্রসারিত করার সুপারিশ। ৬-১৪ বছর বয়সীদের জন্য, অর্থাৎ প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত, বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার এই আইনে স্বীকৃত ছিল। নতুন নীতিতে উচ্চমানের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে (অর্থাৎ ৩ বছর বয়স থেকে) শিক্ষার অধিকার আইনের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে এবং পরবর্তীতে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত তা প্রসারিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এইটুকু দীর্ঘদিনের দাবি বা আকাঙ্খা ছিল। কিন্তু বাস্তবে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সকলের জন্য বিনা খরচে সম মানের শিক্ষা সরবরাহ করতে প্রয়োজনীয় সরকারি ব্যবস্থাপনা কী হবে ও তার জন্য নির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ কী হবে তা বলা নাই। অঙ্গনওয়ারী বা আইসিডিএস সেন্টারগুলিকে প্রাইমারি স্কুলের কাছাকাছি আনা এবং অঙ্গনওয়ারী কর্মীদের ছয় মাসের একটি শিক্ষণ-ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা ছাড়া বিশেষ কিছু চোখে পড়ে না।

শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলির জন্য ‘স্পেশ্যাল এডুকেশন জোন’ গঠন এবং ‘বাদ পড়ে যাওয়া জনগোষ্ঠি’-র ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সমস্ত স্কুলেই যে একটি ন্যুনতম গুণমান থাকা বাঞ্ছনীয় তা নিয়ে কোনও কথা নাই। বর্তমান স্কুলগুলোর একটির সাথে অন্যটির পরিকাঠামোগত ও দক্ষ শিক্ষক সরবরাহ সংক্রান্ত প্রশ্নে যে অতল বৈষম্য বিরাজ করছে, গুণমান সম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ধনী ও গরীব শিশুদের মধ্যে বৈষম্য যে স্তরবিন্যস্ত হয়ে আছে তা নিরসনের কোনও কথা বলা নাই। বরং, দেশের সকল শিশুই যে নিজ নিজ বসবাসের এলাকাতে সম পর্যায়ের উচ্চ গুণমান সম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ পাওয়ার অধিকারি সেই ধারণা বা প্রত্যাশারই নিরসন করতে চাওয়া হয়েছে।

একদিকে শিক্ষার অধিকার আইনকে প্রসারিত করার কথা বলা হচ্ছে অন্যদিকে স্কুলছুট বা ড্রপআউট হওয়াকেও মান্যতা দেওয়া হচ্ছে খসড়ায়। বস্তুত ড্রপ-আউট শব্দবন্ধটিই তুলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার খরচ, ভিনদেশে কাজে যাওয়া, শিশু শ্রমের বাধ্যবাধকতা, ঋতুস্রাব নিয়ে সামাজিক ভ্রান্ত ধারণা, বাল্য বিবাহ, জাতভিত্তিক বা অন্য ধরনের অবমাননার ফলে পড়াশোনায় আগ্রহ হারানো — স্কুলছুট হওয়ার এইসব বহুবিধ আর্থ-সামাজিক কারণকে স্বীকৃতি দিয়ে সেইমতো ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে ‘ড্রপ-আউট’-এর নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘এক্সিট’ এবং ‘রি-এনরোল’ শব্দগুলির দ্বারা। স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া এবং পরে কখনও আবার পড়তে ফিরে আসাকে ‘বাস্তব’ ও ‘প্রগতিশীল’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। একথা বলা হয়েছে পারিবারিক কাজের বাহানায়। ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের বাড়ির ব্যবসাতে (আসলে বলতে চেয়েছে ‘জাত-ব্যবসা’) শিশুশ্রমকে অনুমোদন দিয়েছে নয়া শিক্ষানীতি!

তিন বছর বয়স থেকে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত স্কুল শিক্ষাকে ৫+ ৩ + ৩ + ৪ এই চারটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। শেষ চার বছরকে মোট আটটি সেমেস্টারে ভাগ করা হয়েছে। ‘শ্রেণী’ বা ক্লাসের বদলে বলা হবে ‘গ্রেড’। প্রথম তিন বছর পর গ্রেড শুরু হবে। শেষের নবম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত চারটি গ্রেডে বিভিন্ন বিষয় শেখানো হবে। এই চারটি গ্রেড যেখানে পড়ানো হবে তাকে বলা হবে সেকেন্ডারি স্কুল।

‘স্কুল কমপ্লেক্স’ বা বেশ কিছু স্কুলের জোট গঠন করার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে যারা নিজেদের রিসোর্স পরস্পরের মধ্যে ভাগ করে নেবে। একটি সেকেন্ডারি স্কুল, যেখানে নবম থেকে দ্বাদশ গ্রেড পর্যন্ত পড়ানো হয়, তার আওতায় সংলগ্ন এলাকার প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক স্কুলগুলিকে (যেগুলিতে সর্বোচ্চ অষ্টম গ্রেড পর্যন্ত পড়ানো হবে) নিয়ে একটি স্কুলজোট তৈরি হবে যা হবে স্কুল ব্যবস্থার বুনিয়াদি প্রশাসনিক একক। শিক্ষকগণ এই স্কুল জোটের মধ্যে প্রয়োজন অনুযায়ি ঘুরে ঘুরে কাজ করবে (মাল্টিগ্রেড টিচিং)। কিন্তু প্রাত্যহিক ভিত্তিতে এই সমন্বয়ের বিষয়টি বাস্তবে কীভাবে সম্পন্ন হবে তা বোঝা যায় না। এর জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি বা কোনও আলাদা অফিস বা পদ তৈরি করা হয়নি, যদিও নিসন্দেহেই এটি একটি সময়সাপেক্ষ ও বড় দায়িত্ব। সেকন্ডারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ওপরই এই দায় ন্যস্ত করে দেওয়া হয়েছে।

বর্তমান ব্যবসায়ীকরণের পরিস্থিতিতে যেখানে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় আরও বেশি করে সরকারি সহযোগিতা ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সুসংহত জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার সেখানে বেসরকারি স্কুলগুলির ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ তুলে নিয়ে ‘অভিভাবকদের সংস্থা’-র ওপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

স্কুলশিক্ষার এই প্রতিটি স্তরেই ‘ভারতীয় ও স্থানীয় ঐতিহ্য’ ছাত্রছাত্রীদের মনের গভীরে প্রোথিত করা প্রধান দিক হিসেবে থাকবে। প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানচর্চার ধারাকে ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। প্রাচীন সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তায় গবেষকেরা সংস্কৃত রপ্ত করবেন এতে কারও অসুবিধা থাকার কথা নয়; আর্যভট্ট বা কণাদের সময়কার ভারতীয় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার উৎকর্ষও অজানা বিষয় নয়। কিন্তু তাকে কি আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার বিপ্রতীপে দাঁড় করানো চলে? প্রাচীন ভারতীয় ও প্রাচীন গ্রীক জ্ঞানবিজ্ঞান সমন্বিত হয়ে অষ্টম-দ্বাদশ শতকে আরবীয় সভ্যতায় যে চরম উৎকর্ষলাভ করেছিল তা-ই তো শিল্প বিপ্লবের যুগে ইউরোপের হাত ধরে আধুনিক বিজ্ঞানের রূপ পেয়েছে। তথাকথিত এই ইউরোপীয় বিজ্ঞানের বিকাশে অন্য অনেকানেক দেশের মতো আধুনিক ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অবদানও তো উত্তরোত্তর মাত্রায় স্বীকৃত হয়েছে ও হচ্ছে। তাহলে ‘ভারতীয় শিক্ষা বোর্ড’ গড়ে অতীতের প্রতি এক রোমান্টিক আবেগ তথা ভারতীয় জ্ঞানচর্চার ধারাকে ‘ফিরিয়ে আনা’ বলতে আসলে কোন উদ্দেশ্য ঘোষিত হয়? কোনও ‘ভারতীয় শিক্ষা বোর্ড’-ই কি সিবিএসই বা সিআইএসসিই-র সমকক্ষ হতে পারে?

বৈদিক যুগের গণিত, জ্যোতিষ আর গোমুত্র সেবনে ক্যান্সার নিরাময়ের নিদান শিখে কেউ হয়তো লোকঠকানো ব্যবসা খুলে বসতে পারে অথবা ভিএইচপি/আরএসএস-এর একজন উৎকৃষ্ট শাখা-সংগঠক হতে পারে, কিন্তু তা দিয়ে বিশ্ববিজ্ঞানের দরবারে ভারত কীভাবে আবার শ্রেষ্ঠ আসন লবে!

এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রকের নাম ‘মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক’ বা (এমএইচআরডি), খসড়ায় তা পাল্টে সরাসরি ‘শিক্ষা মন্ত্রক’ (এমওই) নাম দেওয়ার কথা বলেছে যা ২০১৯-এর মধ্যেই করে ফেলা হবে। কিন্তু এ নিছক নাম বদল নয়। শিক্ষা, দক্ষতার বিকাশ ও মানবসম্পদ হিসেবে সমাজোন্নয়নে তার মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার — এই সামগ্রিকতায় স্থাপিত হয়েছিল মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। এখন ‘শিক্ষা মন্ত্রক’ কেবলমাত্র শিক্ষাব্যবস্থা সংক্রান্ত বিষয়টিই দেখবে, বাকি দক্ষতা বিকাশ ও তার বাণিজ্যিক ব্যবহার সংক্রান্ত বিষয়টির জন্য স্থাপিত হবে আলাদা মন্ত্রক। এভাবে শিক্ষার প্রশ্ন থেকে শিক্ষান্তে কাজের প্রশ্নটিকে সম্পূর্ণ আলাদা করা হয়েছে। বস্তুত সমগ্র খসড়াতেই এই দিকটি মূল সুর হিসেবে আছে। বহু মনোহর বাক্যে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে পাতি মুখস্থবিদ্যার বদলে এমনভাবে শিক্ষা দেওয়া হবে যাতে শিক্ষার্থি সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজেই নিজের ইচ্ছে মতো বিশ্বচরাচরে চরে খেতে পারে। কথাটা শুনতে ভালো। কিন্তু ব্যাঙ্ক, বীমা, রেল সহ সমস্ত ক্ষেত্রেই যখন রিক্রুটমেন্ট প্রায় বন্ধ, প্রায় সমস্ত সরকারি সংস্থাই যখন লুপ্ত হয়ে যাওয়ার মুখে, বিএসএনএল হোক বা জেট এয়ারওয়েজ — কাজ হারিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা যখন নিত্যঘটনা, কর্পোরেট সংস্থায় চলছে নয়া দাস ব্যবস্থা, সারা দেশের শিক্ষিত যুবসমাজ যখন কাজের নিশ্চয়তা, মর্যাদাপূর্ণ মজুরি ও নিরাপত্তার দাবিতে রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের লাঠিগুলি খাচ্ছে তখন চরে খাওয়ার গল্পের প্রকৃত অর্থ কী হতে পারে তা কে না বোঝে?

গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ‘হায়ার এডুকেশন ফাইনান্সিং অথরিটি’ বা (এইচইএফএ) গঠন করে। গত ফেব্রুয়ারী মাসে কানাডা ব্যাঙ্কের সাথে একটি মৌ-চুক্তি স্বাক্ষর করে (এইচইএফএ) জানায় যে মোট এক লক্ষ কোটি টাকা ফান্ড গঠন করে কাজ শুরু হচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ভারত সরকার দেবে। বাকি সাড়ে একানব্বই হাজার কোটি টাকা কোত্থেকে আসবে? একটি বিবৃতি দিয়ে জানান হয় যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি ল্যাবরেটরি ও অন্যান্য পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য দশ বছরের ভিত্তিতে ঋণ হিসেবে ফান্ড পাবে। এবং এই ঋণ সুদ সহ ফেরত দেবে সেই প্রতিষ্ঠান। বলাই বাহুল্য ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ফি হিসেবে এই টাকা তুলবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি। নতুন শিক্ষানীতি আসলে এই ব্যবসায়ীকরণের রাস্তা আরও প্রসারিত করতে চায়।

খসড়াতে একথা বলা আছে যে প্রথম শ্রেণিতে নাম লেখানো ছাত্রছাত্রীদের ৪৯% দশম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা করেনা। কিন্তু উচ্চশিক্ষার অবজেক্টিভ হিসেবে খসড়াতে প্রথমেই ঘোষণা করা আছে যে ২০৩৫ সালের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় ‘গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও’ ৫০% এ নিয়ে যেতে চায় এই শিক্ষানীতি। অর্থাৎ নতুন শিক্ষানীতি বলে দিচ্ছে যে বর্তমানে গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও যা আছে মোটামুটি সেই অনুপাতই বজায় থাকবে। যারা পড়াশোনা চালাতে পারল না তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করার চেয়ে বরং যারা পারবে তাদের জন্য দেশজুড়ে ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস বহুবিভাগীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ তৈরি হবে। একথাও স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে “নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার বদলে, কারণ তাতে তো প্রভূত অর্থ ব্যয় হবে, বর্তমান প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রসারিত করাই অগ্রাধিকার হবে”। তারপর আবার ‘মিশন নালন্দা’ ও ‘মিশন তক্ষশীলা’ নামে দেশের প্রত্যেক জেলায় উচ্চস্তরের বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা হচ্ছে! কিন্তু কীভাবে তা হবে তার কোনও প্ল্যান নাই। খসড়া বলছে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণকে বন্ধ করা হবে। কিন্তু কীভাবে? — সেবামূলক (ফিলান্থ্রপিক) উদ্যোগকে ‘বিরাট মাত্রায় উৎসাহিত’ করে। সমস্ত রাজ্য সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে দ্রুত লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে প্রাইভেট সংস্থাগুলির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে অসুবিধা না হয়। তবে ‘ইতি গজ’-র মতো বলা আছে যে তাদের ‘প্রকৃতই নন-প্রফিট সংস্থা’ হতে হবে এবং দেখতে হবে যে ‘লং টার্ম সাস্টেনিবিলিটি’-র যোগ্য আর্থিক ক্ষমতা সেই সংস্থার আছে কিনা। ছোট খাটো প্লেয়ারদের সরিয়ে বড়ো প্লেয়ারদের জন্য মাঠ ফাঁকা করার প্রসঙ্গ সমগ্র খসড়া জুড়েই আছে। তবে ওই ‘সেবামূলক’ হওয়া চাই। কিন্তু হায়! কে না জানে যে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের নামেই ভারতে শিক্ষার ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে! বৃহৎ পুঁজির মালিকদের ‘সেবামূলক কার্যকলাপ’-এর নিদর্শনও কি আমরা আমাদের জল-জঙ্গল-জমির বুকে নিত্যদিন দেখছি না! অন্যদিকে আরএসএস-এর মতো ‘সেবামূলক সংস্থা’ তো শিক্ষাজগতের বিপুল পরিসর ইতিমধ্যেই গ্রাস করেছে (এবং এখানে জানিয়ে রাখি যে খসড়ায় সেকেন্ডারি স্কুল ডিগ্রি দেওয়ার প্রতিষ্ঠানকেও ‘হায়ার এডুকেশন ইন্সটিটুট’-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে)। খসড়ায় বলা হয়েছে যে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের সংস্থাকেই সমান চোখে দেখা হবে। প্রাইভেট সংস্থাগুলিকে পূর্ণ স্বায়ত্ততা দেওয়া হবে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে ইচ্ছেমতো ডিগ্রি বেচার ছাড়পত্র দেওয়া হবে —“প্রয়োজনে নতুন আইন বানানো হবে। রুলস/ রেগুলেশনস খাড়া করা হবে যাতে বিদেশের যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতে পাঠরত ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিজেদের ডিগ্রি অফার করতে পারবে”।

উদার ও প্রসারিত ও বিবিধ ধারার কলা (প্রাচীন ভারতে চৌষট্টি কলা শিক্ষার উল্লেখ করা হয়েছে) শিক্ষাতে মূল জোর থাকবে স্নাতক স্তরে। কিন্তু আবার ভার্সিটিগুলিকে আনা হবে সিভিল সার্ভিসের মতো আচরণবিধির আওতায়! সরকারি নীতিকে সমালোচনা করে প্রবন্ধ ছাপতে পারবেন না কোনও অধ্যাপক। আর চৌষট্টি কলা বিকাশের নামে আসলে বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রগতিকে প্রাচীন-পুরান-পুঁথির অধীনস্থ করে দেওয়া হবে। সায়েন্স কংগ্রেসে ইতিমধ্যেই সেই এজেন্ডা খোলাখুলি প্রকাশ হতে দেখেছি আমরা। খসড়ায় ‘পছন্দের ক্ষেত্রে গবেষণাকে উৎসাহিত করা’, ‘সামাজিকভাবে টেকসই এমন গবেষণাকে অর্থ সাহায্য দেওয়া’ ইত্যাদি বাক্যবন্ধের আড়ালে সেই এজেণ্ডাকে লুকাতে চাওয়া হয়েছে। সবশেষে, ‘শিক্ষাজগৎ-কে বদলে দেওয়া’ শীর্ষক চ্যাপ্টারে মন কি বাত শোনানো হয়েছে: শিক্ষাজগৎ-কে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করার সর্বোচ্চ সংস্থা হিসেবে স্থাপিত হবে ‘রাষ্ট্রীয় শিক্ষা আয়োগ’ যার সর্বাধিনায়ক পদে থাকবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।

খণ্ড-26
সংখ্যা-18