আজীবন সংগ্রামী কমরেড বিল্বমঙ্গল চ্যাটার্জীর স্মরণ সভা

গত ২১ জুলাই ২০১৯ পলাশীপাড়ায় প্রয়াত পার্টি নেতা কমরেড বিল্বমঙ্গল চ্যাটার্জীর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। পলাশীপাড়ায় পঞ্চায়েত ভবনের পরিপূর্ণ সভাগৃহে এই স্মরণ সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পলিটব্যুরো নেতা কার্তিক পাল। তিনি নদীয়া জেলায় পার্টি গঠনে প্রয়াত নেতার উজ্জ্বল ভূমিকার কথা তুলে ধরে বলেন, ৫০ বছর ধরে, সমগ্র পরিবারকে সাথে নিয়ে তিনি প্রবল ঝড়ঝাপটার মধ্যেও পার্টিকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। পার্টি পুনর্গঠনের পর্যায়ে সুবোধ মজুমদারের সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, একজন দৃঢ় ও সাহসী পার্টি নেতার মতো ভূমিকা পালন করে গেছেন। ১৯৭৮ সালে জেল থেকে বেরিয়ে এসেই তিনি নতুন করে পার্টি বিস্তারের কাজ শুরু করেন। কালিগঞ্জ, করিমপুর, তেহট্ট, চাপড়া বিশেষ করে বার্নিয়া, পলশুন্ডা প্রভৃতি জায়গায় কাজ করেছেন। নওদা ব্লকেও কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁর সমগ্র পরিবার কার্যত পার্টির পরিবার হয়ে উঠেছিল। নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল রূপে বহুল ব্যবহৃত হত। এমন কী পরিবারের সদস্যরা নিজেদের খাবার বিছানা সব ছেড়ে দিত। এত ভালোবাসা আমরা কোনোদিন ভুলব না।

এছাড়া স্মরণ সভায় বক্তব্য রাখেন, রাজ্য় নেতা বাসুদেব বসু, জয়তু দেশমুখ, নদীয়া জেলা সম্পাদক সুবিমল সেনগুপ্ত, এপিডিআর নেতা তাপস চক্রবর্তী, জেলা পার্টি নেতা কাজল দত্তগুপ্ত, আলতাফ হোসেন, বিজয় সাহা, ধনঞ্জয় গাঙ্গুলী, দিলীপ মজুমদার, এলাকার পার্টি নেতা জয়দেব বিশ্বাস প্রমুখ। শ্রদ্ধাঞ্জলি পাঠ করেন রাজ্য নেতা কৃষ্ণ প্রামাণিক। তাতে ১৯৬০এর দশক থেকে বাম আন্দোলনে তাঁর উজ্জ্বল ভূমিকার কথা তুলে ধরা হয়। ষাটের দশকের শুরুতে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলনে তিনি সামনের সারিতে থেকে পুলিশী নির্যাতনের মুখে পড়েন।

২১ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালে অবিভক্তি কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক “সেল” পলাশীপাড়ায় গঠিত হয়েছিল তিনজনকে নিয়ে। বিল্বমঙ্গল চ্যার্টার্জী ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

নদীয়া জেলার গণনাট্য সংঘের সম্প্রসারণে তাঁর ভূমিকা স্মরণীয়। বিল্বমঙ্গল চ্যাটার্জী ও তাঁর স্ত্রী উভয়েই নাটক করতেন। ছয়ের দশকের প্রথমদিকে পলাশীপাড়ায় মূলত তাঁরই প্রয়াসে গণনাট্য সংঘের আসর বসেছিল। লোক কবিয়াল শেখ গুমানি ও লম্বোদর মুখোপাধ্যায়ের কবির আসর শ্রোতাকে মুগ্ধ করেছিল। সেই সময় জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় গণনাট্যের নাটকও অভিনীত হয়।

১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ির অভ্যুত্থানের পরেই তিনি নকশালবাড়ির রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন এবং সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে সিপিআই(এমএল)-এ যোগ দেন। সমাজ পরিবর্তনের লড়াই, কৃষি বিপ্লবী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ১৯৭১ সালে গ্রাপ্তার হন ও ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত জেলে থাকেন, পরবর্তীতে ঐ বছরেরই শেষদিকে পুনরায় গ্রেপ্তার হন, ১৯৭৮ সালে মুক্তি পান।

জরুরী অবস্থার সময় কুখ্যাত ‘মিসা’ আইনে আটক ছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৮০-৯০-এর দশকে পলাশীপাড়া-তেহট্ট এলাকার বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে ভূমিসংস্কার আন্দোলন এবং গ্রামীণ গরিবদের উপর সামন্তী নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি ধারাবাহিকভাবে নানাবিধ সংগ্রাম গড়ে তোলেন। নিশ্চিন্তিপুরে মৎসজীবীদের অধিকার রক্ষায় জলাশয় দখল এবং নেমে আসা সরকারী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯৮০-র দশকের শেষভাগ থেকে পার্টির গণরাজনৈতিক কাজে আইপিএফের সামনের সারির নেতা ছিলেন। দীর্ঘদিন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নদীয়া জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। শেষ জীবনে অশক্ত শরীরে নানাবিধ রোগব্যাধি সত্ত্বেও তিনি ছিলেন এক ক্লান্তিহীন কর্মী। রাজনৈতিক-সামাজিক যে কোনো কাজে হাসিমুখে, অমায়িক ব্যবহারে তিনি ছিলেন সকলের কাছের মানুষ, সহৃদয় অভিভাবকের মতো। তাঁর প্রয়াণে আমরা হারালাম এক আদর্শনিষ্ঠ এবং মানবদরদী নেতৃত্বকে। তাঁর স্মৃতি অবিনশ্বর হোক।

স্মরণ সভায় তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান এলাকার বেশ কয়েকজন বামপন্থী কর্মী এবং বিশিষ্ট নাগরিকেরা, সিপিআই(এম) এবং এসইউসিআই(সি) দলের ব্লক নেতারা। শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে তাঁর ত্যাগ ও তিতিক্ষার প্রতি উপস্থিত সকলেই বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। গণসংগীত পরিবেশন করেন স্থানীয় পার্টি কর্মী বাবলু হালদার। লালনের গান গেয়ে শোনান মনসুর ফকির। আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে স্মরণসভার কাজ শেষ হয়। শুরুতে প্রয়াত নেতার প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করা হয়, তাতে আন্যান্যদের সাথে অংশ নেন তাঁর দুই কন্যা, পুত্র ও পরিবারের সদস্যরা।

খণ্ড-26
সংখ্যা-22