আমার দেখা আজীবন কমিউনিস্ট কমরেড সুদর্শন বসু (অনল)

sudarshan

কমরেড সুদর্শন বসু (অনল)-এর সাথে সম্পর্ক দীর্ঘ ৫৬ বছরেরও বেশি। ১৯৬৬ সালে দুর্গাপুর স্টীল প্ল্যান্টে অপারেটিভ ট্রেনি হিসাবে সুদর্শন সহ প্রায় ১৫০ জন আমরা ট্রেনিং নিতে শুরু করি, তারপর একসাথে ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্ল্যান্টের স্টীল মেন্টিং শপে ট্রেন অপারেটর হিসাবে কাজ করি। প্ল্যান্টের এই পাঁচ বছরে অনলকে দেখেছি ‘৬৭ সালেই ট্রেনিদের সংগঠিত করে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে (যিনি সরকারি কাজে ট্রেনিং ইন্সটিউটে এসেছিলেন) শ্রমিকদের দাবি নিয়ে সংগঠিত করে ডেপুটেশন দেওয়ার চেষ্টা করা। যদিও মুখ্যমন্ত্রীসুলভ দাপটের সামনে কারখানার সিপিএমের দাদাগিরির জন্য আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়নি। কিন্তু সেটাই ছিল আমাদের উদ্যোগে প্রথম প্রতিবাদ।

পরবর্তীতে নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রভাব দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে ভালই পড়ে। আমাদের শিফ‌ট ইনচার্জ যাকে দাসদা বলেই মনে আছে অনল আর আমাকে নিয়ে প্রথম নকশালবাড়ি সম্বন্ধে, সশস্ত্র সংগ্রাম সম্পর্কে আলোচনা করতেন। অনল থাকত স্টীল টাউনশিপের বি-জোনে তার দাদার কোয়ার্টারে। একই জায়গায় কমরেড পরেশ ব্যানার্জী, রানা (প্রদীপ ব্যানার্জী) ছাড়াও আরো কয়েকজন থাকতেন। আমি থাকতাম এ-জোনের আর ই কলেজের পাশেই কোয়ার্টারে। নকশালবাড়ির রাজনীতির প্রভাবে এই কলেজে জোর কলরব শুরু হয়, যার প্রভাব আমাদের মধ্যে পড়ে। কলেজে যাতায়াত শুরু হয় কমরেড ভি এম, ডি পি বক্সী, পাণ্ডেজী (ব্রিজ বিহারী পাণ্ডে) ও আরো অনেকের সাথে রাজনৈতিক আলোচনা শুরু হয়। অনল, আমি আরো ৩/৪ জন শ্রমিক কমরেডকে নিয়ে একটা টিম গঠন করা হয়। কমরেড বক্সী নিয়মিত আমাদের ক্লাস নিতেন। এই সময় স্টীল প্ল্যান্টে ইউনিয়নের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। নকশালবাড়ীর প্রভাবে তা জঙ্গী রূপ নেয়। পুলিশের গুলিতে আশীষ-জব্বর নামে দুই শ্রমিক মারা যান। কয়েকদিন ধরে কার্ফু, অবরোধ চলে। এই আন্দোলনেও অনলকে সক্রিয়ভাবে দেখা যায়। সেই সময় রেডগার্ড ধরনের অ্যাকশনের কায়দায় অনল আর আমরা কয়েকজন মিলে রাতের শিফটে কারখানার উঁচু উঁচু শেডের মাথায় লাল ঝাণ্ডা লাগিয়ে দিতাম, পরে তার প্রভাব উপভোগ করতাম। এমন ক্রেন অপারেটরদের দাবির আন্দোলনকে কিভাবে জঙ্গী করা যায় তা নিয়েও থাকত তৎপরতা।

অনলের সাথে শুরুতেই ওর ব্যবহারে নিজের কাছের মানুষ হিসাবে মনে হত। সদা হাস্যময় এমন স্বচ্ছ মনের মানুষ কমই দেখা যায়। এর মধ্যে সিপিএমের হামলা বেড়ে চললো, সাথে পুলিশী দমন ও ধরপাকড়, কমরেড ভি এম সমেত কয়েকজনকে দুর্গাপুরে গ্রেপ্তার করা হল। কলেজের ছাত্র কমরেড ওমস্বরূপকে হত্যা করা হয়। এই অবস্থায় আমি গ্রামে চলে যাই। দুর্গাপুরের কাজকর্ম, যোগাযোগ অনল আর পরেশদা রাখতেন। পার্টি জোর ধাক্কা খায়। নেতৃত্ব বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। সেই সময় বাঁকুড়ায় আমাদের পার্টির কিছু কাজকর্ম চলতো। তার পিছনে শক্তি বলতে দুর্গাপুরের অনল আর কয়েকজন কমরেড। বাঁকুড়ায় চারু মজুমদারের রচনাবলী ছাপার কাজে অনল যুক্ত হয়। আর বাঁকুড়াতেই গ্রেপ্তার হয়। তারপর তাকে বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে চালান করে।

ইতিমধ্যে ’৭২-র শেষে কমরেড ভি এম-রা ছাড়া পান, দুর্গাপুর আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। কমরেড অনলও বাইরে আসে। পার্টির সর্বভারতীয় কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু হয়। এসবের পিছনে ছিল কমরেড অনলের নিরলস পরিশ্রম। পশ্চিমবাংলায় দুর্গাপুর হয়ে ওঠে পার্টি পুনর্গঠনের সদর দপ্তর। দুর্গাপুরের কমরেডরা, আমরা নিজেদের ‘দুর্গাপুরের ব্যাচ’ বলে আজীবন গর্ববোধ করে যাব। অনলের মন ছোঁয়া অনাবিল হাসি, কখনো রাগ না করা, কোন কাজকেই ছোট করে না দেখা, পার্টির সব দায়িত্ব হাসিমুখে পালন করা — এটাই কমরেড ভি এমের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দুর্গাপুর ব্যাচ। আর কমরেড অনল ছিল তার কমিউনিস্ট রোল মডেল। কমরেড অনল তোমাকে কখনো কেউ ভুলবে না।

খণ্ড-26
সংখ্যা-20