এক দেশ এক নির্বাচন গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রবাদের উপর আক্রমণ

পর পর দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এসে মোদি সরকার তাদের নিজস্ব কিছু প্রিয় ধারণাকে চালু করতে মনে হচ্ছে তাড়াহুড়ো লাগিয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ ও শ্রম আইনের সংস্কার যেমন তাদের অগ্রাধিকারে আছে তেমনি এক দেশ এক ভোট চালু করা তাদের এই মুহুর্তের মুখ্য রাজনৈতিক ভাবনা। তাদের প্রথম দফাতেই মোদি সরকার এই ভাবনাকে হাজির করার চেষ্টা করে। নীতি-আয়োগ ও ল-কমিশন উভয়েই অশুভ লক্ষণযুক্ত এই ভাবনাকে কেবলমাত্র ক্ষতিহীন এক বিষয় হিসেবে তার পক্ষে যুক্তিই সাজায় না, এই ভাবনাকে বাস্তবায়নের জন্য একগুচ্ছ সাংবিধানিক সংশোধনের এক নকশাও হাজির করে। সরকার এই বিষয়ে ইতিমধ্যেই এক সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছে এবং মোদী ২ এর আমলে রাষ্ট্রপতির প্রথম ভাষণে এই ভাবনাকে বড় আকারে হাজির করার মধ্য দিয়ে এই প্রচেষ্টা ইতিমধ্যেই ভালো গতি পেয়ে গেছে।

সংবিধান গ্রহণের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রজাতন্ত্র যখন সংসদীয় গণতন্ত্র হিসাবে তার যাত্রা শুরু করে তখন লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন একইসঙ্গে অনুষ্ঠিত হতো। ১৯৬০ সালের দ্বিতীয় ভাগ থেকে নির্বাচন ক্যালেন্ডারের (সময়পঞ্জির) যে পরিবর্তন ঘটে তা কোন সংবিধান সংশোধনের জন্য নয়, তা হল উদ্ভূত নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে। কংগ্রেসের একচ্ছত্র আধিপত্যে ক্ষয় ঘটতে শুরু করে এবং যেহেতু পুরানো পার্টিগুলির মধ্যে বিভাজন ঘটে নতুন পার্টিগুলির উদ্ভব হয় এবং রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস ঘটতে শুরু করে, আমরা রাজনৈতিক পার্টির সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মধ্যবর্তী নির্বাচন ও কোয়ালিশন সরকারগুলিকে দেখতে পাই। কংগ্রেস, কমিউনিস্ট ও জনসংঘ ছাড়া অনেক আঞ্চলিক পার্টির জন্ম হয় এবং তখন এগুলি হালকা অর্থে সামাজিক ন্যায়ের পার্টি হিসেবে পরিচিত হয়। আজ ‘এক দেশ এক ভোট’ এর নামে বিজেপি রাজনৈতিক ঘড়ির কাঁটাকে উল্টো দিকে ঘোরাতে চায় এবং সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার কঠোর কেন্দ্রীকরণ ঘটাতে চায়।

একইসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য সরকারের যুক্তি আবর্তিত হচ্ছে দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে-এতে নাকি খরচ কমবে এবং নির্বাচনের সময় কালে ‘আদর্শ আচরণবিধি’র ফলে ‘উন্নয়ন’ এর কাজ কম ব্যাহত হবে। এ দুটোই হলো ভুয়ো যুক্তি। ‘আদর্শ আচরণবিধি’ উন্নয়নের কাজে কোন হস্তক্ষেপ করে না বা উন্নয়নের গতিকে ব্যাহত করে না; এটা কেবলমাত্র কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে থাকে যাতে সরকার ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য নতুন প্রকল্প ও পলিসি ঘোষণা না করতে পারে। সরকার ও তার উন্নয়নমূলক কাজকর্ম সম্পর্কে জনগণকে মতামত প্রকাশের সুযোগ করে দেয় নির্বাচন। মোদি সরকারের যুক্তি স্পষ্টতই জনগণের মতামত প্রকাশের মৌলিক অধিকারকে ছাপিয়ে সরকারকেই সুবিধে করে দেয়। এখন কোনো সরকারের নির্ধারিত ৫ বছর মেয়াদ পূর্তির আগেই যে কোনো নির্বাচনের প্রয়োজন হবে না তা সরকার কিভাবে নিশ্চিত করতে চায়?

এখানেই সংবিধান সংশোধনের কথা আসছে যেখানে এক সংখ্যালঘু সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় থেকে যাওয়া সম্ভব হবে, তার পক্ষে দল ভাঙ্গানো আরো সুবিধাজনক হবে এবং যেখানে কোনো সরকার চলা সম্ভবই হচ্ছে না সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসনের মাধ্যমে বা কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে রাজ্যের প্রশাসন চলবে। এই সমস্ত পদক্ষেপ স্পষ্টতই গণতন্ত্রকে আরো ফাঁপা করে দেবে এবং শাসন চলবে আরো কেন্দ্রীভূতভাবে। প্রকৃতপক্ষে একই সঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার ভাবনা কেন্দ্রীকরণকে বাড়িয়ে তোলার পক্ষেই কাজ করবে। স্থানীয় সংস্থা, বিধানসভা ও সংসদ নির্বাচনে আলাদা আলাদা নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট ও জনগণের আলাদা আলাদা ভাবনা থাকে। একই সঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাকে বাধ্যতামূলক করার অর্থ হল সমস্ত নির্বাচনকে ব্যাপক অর্থে কেন্দ্রীয়/জাতীয় প্রেক্ষাপটের অধীনস্থ করা। সংসদীয় ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই চাপের মধ্যে পড়েছে যেখানে নির্বাচনী রাজনীতিতে বেড়ে উঠছে ব্যক্তি গরিমার আধিপত্য এবং মুখ্যমন্ত্রীদের তুলে ধরা হচ্ছে মুখ্য কার্যনির্বাহী অফিসার হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও মুখ্যমন্ত্রীর অফিসগুলোর ক্রমবর্ধমান আধিপত্য যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থাপনা ও দায়বদ্ধতার ক্ষয় ঘটাচ্ছে। ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ এর লক্ষ্য হলো বিকেন্দ্রীকরণ ও যুক্তরাষ্ট্রের দাবিকে উপেক্ষা করে আরো বেশি কেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতি ধরনের শাসনকে সংহত করা।

বিজেপি এ বিষয়ে ভালোই ওয়াকিবহাল, বর্তমান সন্ধিক্ষণে যে সামঞ্জস্যহীন আধিপত্য সে অর্জন করেছে তা এই কারণে যে একই সাথে অ-বিজেপি সমস্ত পার্টিগুলি – কংগ্রেস ও বামেদের থেকে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক দল ও সামাজিক ন্যায় শিবিরের পার্টিগুলি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই সময়টাকেই কাজে লাগিয়ে বিজেপি সমস্ত সম্ভাব্য উপায়েই তাদের এই আধিপত্যকে স্থায়ী ও গভীরতর করতে চায়। একইসঙ্গে নির্বাচনের জন্য এই প্রচেষ্টা হলো ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার এক পরিকল্পিত ও নতুন রূপ দেবার লক্ষ্যে এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।

এটা যথেষ্টই লক্ষণীয় যে বিজেপি সরকার যখন একইসঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন তখন অমিত শাহ ও স্মৃতি ইরানির পদত্যাগের ফলে (উভয়েই লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়) গুজরাট থেকে রাজ্যসভার দুটি খালি আসন পূরণেভোটের জন্য দুটি আলাদা আলাদা ব্যালট পেপারের পরিকল্পনা করছে যাতে করে উভয় আসনেই বিজেপির জয়ের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু প্রেফারেনশিয়াল ও ট্রান্সফারেবল ভোটের প্রচলিত পদ্ধতির মাধ্যমে ভোট হলে নেতৃত্বকারী বিরোধী পার্টির একটি আসনে জয়ের সম্ভাবনা থাকে।

এটা তাৎপর্যপূর্ণযে একইসঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা সম্পর্কেডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে আমন্ত্রিত ৪০টি পার্টির মধ্যে ১৯ টি পার্টি এই বৈঠক বয়কট করে। বৈঠকে উপস্থিত হয়ে সিপিআইএম ও সিপিআই নির্দিষ্টভাবে সরকারের এই ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করে। যুক্তরাষ্ট্রবাদ ও গণতন্ত্র রক্ষার প্রতি দায়বদ্ধ সমস্ত শক্তির একসঙ্গে আসা এবং মোদি সরকারের এই ঘৃণ্য পদক্ষেপকে দৃঢ় ভাবে প্রতিহত করা দরকার।

(এম এল আপডেট, সম্পাদকীয় ২৫ জুন ২০১৯)

খণ্ড-26
সংখ্যা-19