কৃষক, মজুর, বেকার, গরিবদের জন্য ‘শূন্য বাজেট’; বিলগ্নি, মূল্যবৃদ্ধি, বিদেশী ঋণ ও পুঁজির রমরমা পেট্রল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি

দৈনন্দিন জীবনে যে মূল্যবৃদ্ধির আঁচ আমরা টের পাচ্ছি তার সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতির হারের সামঞ্জস্য খুঁজে পাচ্ছি না আমরা। সেই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রল-ডিজেলের মূল্য কম থাকার অনুমানে উভয় পণ্যের উপরে লিটার পিছু উৎপাদন শুল্ক ও সেস ১ টাকা করে বাড়িয়ে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির পথকে সুগম করে তোলা হল বাজেটে। পেট্রল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির এক আজব যুক্তি খাড়া করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম কম থাকলে সরকার শুল্ক ও সেস বসিয়ে মূল্য নীচের দিকে স্থিতিশীল রাখবে, আর অশোধিত তেলের দাম বাড়লে দেশীয় বাজারে দামের বোঝা নাগরিকদের বইতে হবে। ফলে পেট্রল-ডিজেল সরকারের কাছে রাজস্ব সংগ্রহের উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাজেট সে বিষয়টিকে আরো জোরদার করল। অবশ্য তেলের উপরে শুল্ক ও সেস বাজেট ব্যতিরেকেই প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে ঘটতে থাকে। পেট্রল-ডিজেলের উপরে শুল্ক ও সেস বৃদ্ধির চাপ সাধারণ মানুষের উপরে পড়বে। পণ্য ও যাত্রী পরিবহণ খরচ বাড়বে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও বাড়বে। পড়াশোনার প্রতি ভারতীয় জনতা পার্টির এক প্রচ্ছন্ন বিরোধিতা আছে, বিশেষত বিদেশী জ্ঞান অর্জনের প্রতি। তাই বোধহয়, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত বই ও ছাপাখানার দ্রব্যাদির উপরে আমদানি শুল্ক ৫% বাড়িয়ে ওইসব সামগ্রীকে মহার্ঘ করে তোলা হল।

কর্পোরেটদের কর ছাড়, মধ্যবিত্তের হাতে রইল পেনসিল

সরকারে আসার আগে বিজেপি মধ্যবিত্তদের করের বোঝা কমানোর কথা বলেছিল। বলা হত, ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত করযোগ্য আয়ের উপর কোনো কর ধার্য করা হবে না। কিন্তু, এই বাজেটেও সেদিকে কোনো দৃষ্টিই দেওয়া হয়নি। মধ্যবিত্তদের করের কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে, ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির বাজারে তাদের প্রকৃতপক্ষে করযোগ্য আয়ের ন্যূনতম পরিমাণকে কমানোই হয়েছে। গৃহ নির্মাণ ব্যবসায়কে গতি দিতে গৃহঋণের সুদের পরিমাণে কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে। ৪৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মূল্যের গৃহ ক্রয়ের জন্য গৃহঋণের ক্ষেত্রে ছাড়যোগ্য সুদের পরিমাণ ২ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ৩.৫ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। তবে মনে রাখা দরকার গৃহ নির্মাণ ব্যবসায়ে গতি আনতেই এই ছাড়, মধ্যবিত্তরা এখানে নিমিত্ত মাত্র। একদিকে মধ্যবিত্ত করদাতাদের জন্য কোন ছাড় ঘোষণা না করলেও কর্পোরেট করে বিপুল হ্রাস ঘটানো হল। আগেই ২৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে এরূপ কর্পোরেটদের করের হার ৩০% থেকে ২৫% করা হয়েছিল। এই বাজেটে ওই সীমা ৪০০ কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়া হল।

নেহরু-ইন্দিরার আমলের রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্র বেচে পরের ধনে পোদ্দারি

মোদী সরকার যদিও নেহেরু-ইন্দিরা গান্ধির সরকারের দেশ শাসনকে গালি না দিয়ে জল খায় না, কিন্তু গত কয়েক বছর রাজস্ব ঘাটতি কমাতে পূর্বতন কংগ্রেস সরকার সমূহের আমলে সৃষ্ট রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের কোম্পানিগুলির বিলগ্নিকরণকে পাথেয় করেছিল। ২০১৮-১৯ সালে বিলগ্নিকরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০ হাজার কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫ হাজার কোটি টাকা আদায় হয়েছে ওই বছরে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের বাজেটে ২০১৯-২০ সালের জন্য লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছিল ৯০ হাজার কোটি টাকা। নির্বাচনে বিপুল জয়ে উদ্বেল সরকার ওই লক্ষ্যমাত্রাকে বাড়িয়ে ১ লক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকা করেছে। অর্থমন্ত্রী আরো বলেছেন এপর্যন্ত সরকার নিজের হাতে রাখতে চাওয়া কোম্পানিগুলির শেয়ারের অন্তত ৫১% নিজের কাছে রেখে বিলগ্নিকরণ করত। এরপরে যেখানে সরকার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে চাইবেও, সেখানেও নির্দিষ্ট কোম্পানিকে ভিত্তি করে শেয়ারের মাত্রা ৫১%-এর নীচেও নিয়ে যাবে। সামগ্রিকে বিলগ্নিকরণ এখন সরকারের অর্থ সংগ্রহের অন্যতম প্রধান সূত্র হয়ে উঠেছে। এয়ার ইন্ডিয়া, স্কুটারস ইন্ডিয়া, ভারত পাম্পস, ব্রিজ এন্ড রুফের মত ২৪টি লোকসানে চলা রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলির মালিকানা বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে এই সরকারের। পাশাপাশি ৫২টি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার তালিকা করা হয়েছে যেগুলি মূলত লাভজনক, সেগুলির শেয়ার বাজারে বিক্রি করে টাকা তোলা হবে।

রেলওয়েকে বেসরকারিকরণের পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ

ভারতীয় রেলওয়েজকে বেসরকারিকরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে বিজেপি সরকার। বর্তমানে বেসরকারিকরণের অন্যতম পন্থা হল পাবলিকপ্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) বা সরকারি- বেসরকারি অংশীদারি। রেলওয়ের পরিকাঠামো তৈরির জন্য ২০১৮-৩০ এই ১২ বছরে ৫০ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে অনুমান করা হয়েছে। কিন্তু রেলওয়েতে বার্ষিক মূলধনী খরচ ১.৫-১.৬ লক্ষ কোটি টাকা। ফলে ওই ১২ বছরে মূলধনী বিনিয়োগের জন্য অতিরিক্ত ৩০ লক্ষ কোটি টাকা প্রয়োজন। সেই ঘাটতি মেটাতে বেসরকারি উদ্যোগের মুখাপেক্ষী হতে হবে সরকারকে। ফলে বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থার হাতে রেলকে আংশিক ভাবে হলেও তুলে দেওয়া হবে, যেমনটি করা হল এই সেদিন আদানিদের কাছে ৩ টি বিমানবন্দরকে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে।

বাজার ভারতীয়, লগ্নি বিদেশী

কেবল রেলওয়েজই নয়, পরিকাঠামো ক্ষেত্রটিকেই বিপুল পরিমাণ বেসরকারি পুঁজি নির্ভর করে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এই সরকার। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৫ বছরে সরকার ১০০ লক্ষ কোটিটাকার বিনিয়োগ করবে পরিকাঠামো তৈরিতে। অর্থাৎ বছরে ২০ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৯-২০ সালের বাজেটে রেলওয়েকে বাদ দিয়ে মূলধনী বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছে মাত্র ৩,৩৮,৩৫০ কোটি টাকার। ফলে সরকারি বাজেট বরাদ্দ বাদ দিয়ে বছরে ১৭ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগের বন্দোবস্ত করতে হবে। প্রভূত পরিমাণ বেসরকারি বিনিয়োগ বা বিপুল সরকারি ঋণ ব্যতীত এই বিনিয়োগ সম্ভব নয়। অর্থমন্ত্রী অবশ্য বিভিন্নভাবে ঋণ নিয়ে ওই বিনিয়োগ ঘাটতি মেটানোর কথা বলেছেন। তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল সভেরেন বন্ড বা বিদেশী মুদ্রায় সরকারি ঋণপত্র ছাড়ার ঘোষণা। এইভাবে বিদেশী মুদ্রায় ঋণ নিলে ভারতীয় অর্থনীতিকে যথেষ্ট ঝুঁকি বহুল করে তোলার শঙ্কা রয়েছে। বাজেটে বীমা মধ্যস্থতাকারীদের জন্য ১০০% বিদেশী বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে প্রচার মাধ্যম (মিডিয়া), এ্যানিমেশন, বিমা, বিমান শিল্পে বিদেশী লগ্নির বিধি নিষেধকে শিথিল করার কথা। একক ব্রান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশী পুঁজিকে আকৃষ্ট করার জন্য স্থানীয় সূত্র থেকে পণ্য ক্রয়ের বিধিনিষেধকেও শিথিল করার কথা বলা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের বাজারকে বিদেশীদের মৃগয়া ক্ষেত্র করার পরিকল্পনা ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

জনকল্যাণমূলক খাতে বরাদ্দ সংকোচন

জনকল্যাণমূলক যে সমস্ত বরাদ্দ রয়েছে সেই সমস্ত ক্ষেত্রে একটি জনপ্রিয় সরকার আগেকার তুলনায় বাজেট বরাদ্দ বাড়াবে এমনটা আশা করা যেতে পারে। কিন্তু ভোট পাওয়ার জন্য যারা নির্বাচনী বছরে কিছু জনপ্রিয়তাবাদি প্রকল্প গ্রহণ করে এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পুলওয়ামায় ব্যর্থতাকে যারা ধূর্ততার সঙ্গে পাকিস্তান-বিরোধী জিগিরে পরিণত করে সামরিক জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে ভোটে জয়ী হতে কুন্ঠিত হয় না তারা ভোটে জিতে আসার পরে কর্পোরেটমুখি ও বেসরকারি পুঁজি তোষণকারী বাজেট তৈরি করবে এমন আশঙ্কাও ছিল। আশঙ্কাটিই বাস্তবে পরিণত হয়েছে। ২০১৮-১৯ সালের সংশোধিত বরাদ্দের তুলনায় বাজেট বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামগ্রিক বাজেটের অনুপাতে বাজেট বরাদ্দ কমেছে।

তালিকা: কয়েকটি জনকল্যাণমূলক খাতে বাজেট বরাদ্দ ও মোট বরাদ্দের নিরিখে অনুপাত

table

 

লক্ষ্যণীয় যে, স্বাস্থ্য গবেষণা, কৃষি গবেষণা, বিজ্ঞান গবেষণা প্রভৃতি গবেষণা খাতে বরাদ্দের অনুপাত কমেছে। অবশ্য আয়ুর্বেদ গবেষণার ক্ষেত্রে তা সামান্য হলেও বেড়েছে। দক্ষতা উন্নয়ন বা স্কিল ডেভেলপমেনট ও মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোগ নিয়ে বহু চর্চা হতেই থাকে এই সরকারের আমলে। কিন্তু সেই সব ক্ষেত্রেও বরাদ্দের অনুপাত কমেছে।

ভারতীয় কৃষির সাম্প্রতিক অবস্থা

২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত ৪ বছরে ভারতের কৃষি উৎপাদন বা আয় গড়ে বার্ষিক ৩.৭% হারে বেড়েছে (২০১৫-১৬ : ০.৬%, ২০১৬- ১৭ : ৬.৩%, ২০১৭-১৮ : ৫% ও ২০১৮-১৯ : ২.৯%)। যদি উৎপাদন বা আয় উপরোক্ত গড় হারে বাড়ে তাহলে ১৬ বছর বাদে অর্থাৎ ২০৩৫ সালে কৃষিক্ষেত্রে আয় দ্বিগুণ হবে। যদি উৎপাদন বা আয় মোদী সরকারের আমলের সর্বোচ্চ বার্ষিক ৬.৩% হারে বাড়তে থাকে তাহলে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হতে সময় লাগবে মার্চ, ২০১৯ থেকে ৯ বছর। ফলে ২০২৮ সালে তা ঘটতে পারে। যদি ২০২২ সালের স্বাধীনতা দিবসের মধ্যে ২০১৪-১৫ সালের উৎপাদনের নিরিখে কৃষি আয় দ্বিগুণ হওয়ার কথা ধরা হয়, তাহলে মার্চ, ২০১৯ থেকে আগস্ট ২০২২ পর্যন্ত কৃষি ক্ষেত্রের বৃদ্ধি বার্ষিক ১৭% হারে হতে হবে। এই সব হিসেবের ক্ষেত্রেই এও মনে রাখা দরকার যে কৃষি ক্ষেত্রে আয় দ্বিগুণ হওয়া মানেই কৃষকের আয় দ্বিগুণ হওয়া নয়, কারণ ওই ক্ষেত্রে জনসংখ্যাও বাড়বে। তাই ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হওয়া একটি অলীক ভাবনাই মনে হয়। যদিও অর্থমন্ত্রী সেই মোদীজিকে অনুসরণ করে এমনটাই বলেছেন বাজেটে। কৃষি ক্ষেত্রটি খালি কৃষকদের নিয়েই গঠিত নয়। সেখানে কৃষি বা গ্রামীণ মজুররাও রয়েছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রামীণ মজুরির বৃদ্ধির প্রকৃত (অর্থাৎ স্থির মূল্যে) হার বার্ষিক ০.৫%। যদি এই বৃদ্ধির হার বজায় থাকে তাহলে ১৫০ বছর বাদে গ্রামীণ মজুরদের আয় দ্বিগুণ হবে।

কৃষকের জন্য দ্বিগুণ আয়ের গালভরা গল্প

বাজেট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ভারতের কৃষি ক্ষেত্রের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে এতটা বলার কারণ হল যে, মোদীকে অনুকরণ করে ভারতের প্রথম পূর্ণসময়ের অর্থমন্ত্রীও কৃষকদের সম্মান জানিয়েছেন। উদ্ধৃতি দিয়েছেন মহাত্মা গান্ধীর (গডসের কথা বলতে ভুলে গিয়েছেন বোধহয়)। কিন্তু শব্দ অনেক খরচ করলেও কৃষকদের জন্য তেমন কোনো বরাদ্দ করেননি যার দ্বারা ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে কোনো গুণগত পরিবর্তন দেখা যাবে যার দ্বারা আগামী সাড়ে তিন বছরে বার্ষিক বৃদ্ধির হার বর্তমান বছরের (২০১৯- ২০) ২.৯% থেকে বেড়ে বার্ষিক গড়ে ১৭% পৌঁছবে। যদিও ২০১৮-১৯ সালের সংশোধিত বাজেট বরাদ্দের (৭৫৭৫২ কোটি টাকার) তুলনায় কৃষি ক্ষেত্রের মোট বাজেট বরাদ্দ ৮০%-এর বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ১৩৮৫৬৩ কোটি টাকা করা হয়েছে, তবুও তা কৃষি ক্ষেত্রে কোনো বুনিয়াদি পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে করা হয়নি। এই ৬২৮১১ কোটি টাকার বৃদ্ধির ৮৮% (৫৫ হাজার কোটি টাকা) কৃষকদের বার্ষিক ৬০০০ টাকা করে (পিএমকেএসএনওয়াই) দেওয়ার জন্য ব্যয়িত হবে। ওই খাতে ২০১৮-১৯ সালের সংশোধিত বরাদ্দ ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা, যা বর্তমান বছরে বেড়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও বিবেচনার অভাব রয়েছে। পীযুষ গোয়েলের বাজেটেও ওই খাতে বরাদ্দ ছিল ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যখন সমস্ত কৃষক এর অন্তর্ভুক্ত ছিল না, পরে জমির ঊর্ধসীমার বিষয়টিকে তুলে দেওয়ার ফলে অধিক সংখ্যক কৃষক এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে বাজেট বরাদ্দ বাড়া উচিৎ ছিল। এছাড়া সুদের ভর্তুকির জন্য অতিরিক্ত ৩ হাজার, ফসল বীমা ও সহায়ক মূল্য উভয়ের জন্য বাড়তি ১ হাজার কোটি করে টাকা বাদ দিলে কৃষি পরিকাঠামো বৃদ্ধির জন্য কোনো বরাদ্দই তেমন বাড়েনি। উপরন্তু ২০১৮-১৯ এর মূল বরাদ্দের তুলনায় সেচের জন্য প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঞ্চন যোজনাতে বরাদ্দ কমে ৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা হয়েছে, জমির স্বাস্থ্য ও উর্বরতা নিয়ে বহু বাগাড়ম্বরের পরেও ১৮-১৯ এর মূল বরাদ্দের তুলনায় তা ৪০০ কোটি টাকা থেকে কমে ৩২৪ কোটি টাকা হয়েছে। তৈলবীজের জাতীয় মিশনে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি (২০১৮-১৯-এ ছিল ৪০০ কোটি টাকা), বাঁশ নিয়ে যে জাতীয় মিশন সেখানে বরাদ্দ কমে ৩০০ কোটি টাকা থেকে ১৫০ কোটি টাকা হয়েছে। জৈব চাষ, কৃষি-বনসৃজনে বরাদ্দ হয় কমেছে বা বাড়েনি। কৃষি বিপণনে বরাদ্দ ২০১৮-১৯ এর মূল বরাদ্দের তুলনায় ৪৫০ কোটি টাকা কমে ৬০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে বরাদ্দকে এভাবে কাটা ছেড়া করার কারণ হল, অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বিশেষ করে বাঁশ উৎপাদন, তৈলবীজ উৎপাদনের কথা বলেছেন।

‘শূন্য বাজেট চাষ’ না শূন্য গর্ভ বাজেট

শূন্য বাজেট চাষের কথা বলেছেন যা, বাজার থেকে উপকরণ, ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার না করার দিকে ইঙ্গিত করে। কিন্তু একই সঙ্গে জৈব কৃষির জন্য বাজেট বরাদ্দ কমিয়ে স্ববিরোধী আচরণ উপস্থাপিত করছেন। কেবল তাই নয়,বাজেটে কৃষি গবেষণা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ১২৫ কোটি টাকার। শূন্য বাজেট চাষকে কার্যকরী রূপ দিতে গেলে প্রয়োজন কৃষি ক্ষেত্রে কার্যকরী ও ফলপ্রসূ গবেষণার, যা ব্যতিরেকে তথাকথিত উদ্ভাবনী কৃষি কথার কথাই হয়ে থাকে। ভারতীয় কৃষি জল সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। সেই জলসঙ্কট সমাধানের কোনো কথাই এই বাজেটে নেই। মাটির তলার জলের ৮০%-এর বেশি কৃষিতে ব্যবহৃত হয়। সারা দেশ জুড়ে যে জলসঙ্কট আছে তা বাজেটে অর্থমন্ত্রী স্বীকারও করেছেন, জানিয়েছেন যে, ২৫৬টি জেলার ১৫৯২টি ব্লকে জলের অভাব রয়েছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বাজেটে এই সমস্যা সমাধানের কোনো রূপরেখা দেখা যায়নি। আগেই বলেছি, মোদী ১.০ সরকারের বহুনন্দিত জল সেচ প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী জল সিঞ্চন যোজনাতে ২০১৮-১৯ মূল বাজেট বরাদ্দের তুলনায় এবারে বরাদ্দ ২৫% কমিয়ে ৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।

কৃষকের আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হল ঋণের দায়। মোদী সরকার কখনোই এই বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। ঋণের সমস্যা সমাধানের জন্য পণ্যকে বাজারজাত করার পরিকাঠামো তৈরির কথাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয় যাতে কৃষক বাজারজাত না করতে পেরে স্বল্পদামে বিক্রি করতে বাধ্য না হয়। কিন্তু ওইসব পরিকাঠামো উন্নয়ন মজুতদার, ধনীচাষি যারা সে অর্থেমহাজনও বটে তাদেরই সুবিধে করে। ছোট চাষীদের কোনো সুবিধে দেয় না। প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সুবন্দোবস্ত ব্যতিরেকে ঋণের এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু এই বাজেট তেমন কোনো নুতন ভাবনা কৃষিঋণ সম্পর্কে হাজির করেনি।

বরাদ্দ নেই ১০০ দিনের কাজেও

কৃষি ক্ষেত্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত গ্রামীণ মজুরদের সম্পর্কে বাজেট ভাবনার দিকও যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। ১০০ দিনের কাজ বা এমএনআরইজিএ প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ সংশোধিত বরাদ্দের থেকে ৬১০৮৪ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা করে দেওয়া হয়েছে, এমন এক সময়ে যখন গ্রামীণ ভারতে বেকারি বাড়ছে। ২০১৮-১৯ সালের বাজেটে ৫৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। তৎকালিন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন প্রয়োজনে আরো বরাদ্দ হবে। গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক যখন জানুয়ারি, ২০১৯ এ ১৮ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়েছিল তখন ৬ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ করা হয়। ফলে ১২ হাজার কোটি টাকার বকেয়া মজুরি রয়েছে। যেহেতু এমএনআরইজিএ একটি চাহিদা ভিত্তিক কল্যাণ প্রকল্প তাই ওই বকেয়া মজুরি বাদ দিলে এ বছরের বরাদ্দ থাকবে মাত্র ৪০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ বিত্ত বর্ষে এতাবৎ কালের সর্বোচ্চ ২৫৫ কোটি জনদিবসের কাজ হয়েছে। প্রভূত বেকারি খারাপ বর্ষা, গ্রামীণ দুরবস্থা সব মিলিয়ে এই কাজের চাহিদা। যদি এই খাতে উপযুক্ত বরাদ্দ না করা হয়, মজুরি বিপুল পরিমাণে বকেয়া থাকে তাহলে এই কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পটি গুরুত্ব হারাবে। সে দিক থেকে মোদী ২.০ সরকার তার কর্তৃত্ববাদি আচরণের মধ্য দিয়ে এই প্রকল্পটিকে গুরুত্বহীন করে দিতে চাইছে।

বিভাজিত ভারতের বাজেট

সব মিলিয়ে গ্রামীণ উন্নয়ন, কৃষি উন্নয়নের যে সমস্ত উচ্চারণ বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী করেছেন সেগুলি কেবল কথার কথা বলেই মনে হচ্ছে। দেশ যখন গত ৫ দশকের সর্বোচ্চ বেকারির হারে জর্জরিত, মজফরপুরে এনকেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় দু’শ শিশুর মৃত্যু বুঝিয়ে দিচ্ছে আয়ুষ্মান ভারতের সাফল্য সেই সময়ে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর জন্য তেমন কোনো বরাদ্দ না করে, কর্মসংস্থানের কথা একবারের জন্য উচ্চারণ না করে, বারম্বার বিদেশী লগ্নি, বিলগ্নিকরণ, কর্পোরেটদের ছাড় ইত্যাদিকে উচ্চারণ করে অর্থমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন এই দেশকে কাদের জন্য ভারতীয় জনতা পার্টি রক্ষা করতে চান। সেই শতকোটিপতিদের ভারতে উচ্ছিষ্ট বিতরণ করা হবে গ্রামীণ দরিদ্র ও ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষি ও খেতমজুরদের। শহুরে শিক্ষিত বেকারদের চাকুরির জন্য নির্ভর করতে হবে বাজারের উপরে। চাকুরি পেলেও নুতন শ্রম কোড তাদের দেবেনা কোন চাকুরির স্থায়িত্ব। বিভাজিত নুতন ভারতে একদিকে বাস করবে বর্ধিত সম্পদের ৭৩% এর অধিকারি ১% ধনী অধিবাসী, অন্যদিকে অনুরূপ ১% এর ভাগিদার ৫০% হতদরিদ্র ভারতীয়, বাস করবে ধর্মের নামে বিভাজিত সম্প্রদায় সমূহ।

৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি, কৃষকের দ্বিগুণ আয় — সম্ভব কেবল পরিসংখ্যানের কারচুপিতে

বাজেটটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে এর অনুমানের ভিত্তি। সেখানেই ভুল বা কারচুপি রয়েছে। ২০১৯-২০ সালের যে বাজেট পীযুষ গোয়েল পেশ করেছিলেন সেখানে সংশোধিত রাজস্ব আদায়ের অনুমান ছিল ১৭.৩ লক্ষ কোটি টাকা, যার মধ্যে কররাজস্ব আদায়ের অনুমান ছিল ১৪.৮ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে ১১.৫% কম কর রাজস্ব আদায় হওযার কারণে প্রকৃত রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৫.৬ লক্ষ কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতিকে জিডিপির ৩.৪% রাখার জন্য সংশোধিত বাজেটের ব্যয়ের তুলনায় প্রকৃত ব্যয়কে ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা কমাতে হয়েছে। ২০১৯-২০ সালের নির্মলা সীতারামনের বাজেটের রাজস্ব আদায়ের অনুমান পূর্বতন বছরের আদায়ের উপর ভিত্তি করেই প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু সেই ভিত্তি সংশোধিত বাজেট অনুমানের, বাস্তব তথ্য যা অর্থনৈতিক সমীক্ষায় পাওয়া যাচ্ছে তার উপরে নয়। সুতরাং বাজেট প্রস্তাব পেশের সময়ে জানা তথ্যকে লুকিয়ে পছন্দের তথ্যকে পেশ করার সেই মোদী ১.০ সরকারের পুরোনো অভ্যেস দেখা গিয়েছে। সম্ভাবনা রয়েছে রাজস্ব আদায় বাজেট অনুমানের তুলনায় কম হওয়ার, এবং তার ফলে মোট ব্যয় ও বিভিন্ন খাতে ব্যয় কম হওয়ার।

অন্যদিকে বাজেট বরাদ্দ বা বাজেটের দিশা না গ্রামীণ মজুরদের সচ্ছল জীবনের দিকে ইঙ্গিত করছে না কৃষকদের আয় ২০২২ সালের মধ্যে দ্বিগুণ করার কোনো পথ দেখাচ্ছে। ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি গড়ে তুলতে গেলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার দরকার বার্ষিক ৯%, কৃষকের আয় স্বাধীনতার ৭৫ বছরে দ্বিগুণ করতে গেলে কৃষি ক্ষেত্রের বৃদ্ধি প্রয়োজন ১৭%। মোদীজি যতই বলুন না কেন কেবল হতাশাবাদীরাই এসবের সম্ভাবনা দেখছে না, অতীত ইতিহাস ও বাস্তব অবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে বলা যায় পরিসংখ্যানের কারচুপি করেই কেবল এইসব লক্ষ্যে মোদী ২.০ সরকার পৌঁছতে পারবে। অবশ্য সে এলেম তাদের আছে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-21