মোদী ২ সরকারের জমানায় ভারতীয় রেল কোন পথে?

২০১৪ সালে মোদী ক্ষমতায় আসীন হয়েই ভারতীয় রেলে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের রাস্তা খুলে দিল। যে যোজনা কমিশন সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনগণের স্বার্থে রেল লাইন সম্প্রসারিত করেছিল সেই সংস্থাকে তুলে দিয়ে গঠিত হল নীতি আয়োগ। কর্পোরেটদের স্বার্থেনীতি আয়োগ রেল পুনর্গঠন শুরু করল। নীতি আয়োগের সদস্য বিবেক দেব রায়ের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশ একশত ভাগ গৃহীত হল। ননকোর কাজ সাফাই, ক্যাটারিং পরিষেবা থেকে এমনকি কোচ ও ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণের কাজও আউট সোর্সিং হতে শুরু করল। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মোদীর দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন ভারতীয় রেলকে পাকাপাকিভাবে বেসরকারিকরণ করার পথকে সুগম করল। এর ফলে যাত্রী সাধারণের কাছে রেলযাত্রা নিরাপত্তাহীন ও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।

দেশে ব্যাপক বেকারত্ব ও জিডিপি-র অধোগতি ও রাজস্ব ঘাটতি মোদীকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, তাই ভারতীয় রেলকে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হচ্ছে। মোদী সরকার রেলে উদারনৈতিক সংস্কার কর্মসূচী কার্যকর করতে মারমুখী ও আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়েছে। তাই সর্বরোগহারক বেসরকারীকরণকে রেলে ত্বরান্বিত করতে ১০০ দিনের অ্যাকশন প্ল্যান শুরু করা হয়েছে। এতে কর্মসংস্থানহীনতায় সমস্যার সমাধান হবে না এবং পদবিলুপ্তির ফলে বেকার সংখ্যা আরও বাড়বে। এবার দেখা যাক এক নজরে কি আছে উক্ত ১০০ দিনের কর্মসূচীতে?

(১) ‘গিভ ইট আপ’ অভিযান ও প্যাসেঞ্জার ভাড়া পুনর্গঠনের নামে ভর্তুকি হ্রাস

যতবার আপনি টিকিট কাটবেন ততবারই আপনাকে মুচলেকা দিতে হবে এই মর্মেযে আপনি ভর্তুকি চাইছেন কিনা। উক্ত পেনশনে ধীরে ধীরে রেলকর্মীর অর্জিত সুযোগ-সুবিধা যেমন পাস, পিটিও ইত্যাদি চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। ধাপে ধাপে প্যাসেঞ্জার ভাড়ায় ভর্তুকি তুলে দেওয়া হবে। ফলত রেলের ভাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাবে। সামাজিক দায়বদ্ধতার বিপরীতে মুনাফাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

(২) ভারতীয় রেলে বেসরকারি সংস্থা দ্বারা ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত

প্রথম কিস্তিতে লাভজনক সব ট্রেন শতাব্দী ও রাজধানী এক্সপ্রেস আইআরসিটিসি সংস্থাকে ইজরা দেওয়া হবে। রেল লাইন, কোচ ও ইঞ্জিন ইত্যাদির জন্য রেলকে ভাড়া দিতে হবে। প্যাসেঞ্জার ট্রেন অর্থাৎ লোকাল ট্রেন এবং মেল/এক্সপ্রেস ট্রেন ফ্রানচাইজি প্রথায় দিয়ে দেওয়া হবে।

(৩) ৭টি উৎপাদন কেন্দ্র ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্কশপগুলোকে কর্পোটারাইজেশন করা হবে

রেল শ্রমিকের ঘামে ও রক্তে গড়ে তোলা সংশ্লিষ্ট ওয়ার্কশপ সহ ৭টি উৎপাদন কেন্দ্র আইসিএফ (পেরাম্বুর), আরডব্লিউএফ (বেঙ্গালুরু), আরসিএফ (কপুরথলা), এমডিডব্লউ (পাটিয়ালা), ডিএলডব্লিউ (বেনারস), এমসিএফ (রায়বেরিলি), সিএলডব্লিউ (চিত্তরঞ্জন) কর্পোরেটাইজেশন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। উক্ত কারখানাগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং দক্ষ শ্রমিকরা বহু বছর ধরে উৎপাদন করে চলেছিল। ৫৫০০ অশ্বশক্তি সম্পন্ন ডিজেল ইঞ্জিন ও আধুনিক ইলেকট্রিক ইঞ্জিন বারানসি ও চিত্তরঞ্জন কারখানায় তৈরি করে থাকে এবং এলএইচবি ও মেট্রো কোচ যথাক্রমে কপুরথলা ও চেন্নাইয়ে অবস্থিত কারখানায় তৈরি হয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে রপ্তানিও করা হয়। প্রতি বছর ৬০০ ডিজেল ও ইলেকট্রিক লোকো, ২ লক্ষ চাকা ও ৩ হাজার কোচ তৈরি করে উক্ত কারখানার দক্ষ শ্রমিকরা। রেলের জমি সহ উক্ত জাতীয় সম্পত্তি দেশী-বিদেশী পুঁজিপতির কাছে বিক্রি করা হবে ঘুর পথে। প্রথমে ‘ইণ্ডিয়ান রেলওয়ে রোলিং স্টক কোম্পানির অধীন থাকবে। ক্রমশ স্টক মার্কেটে রেজিস্ট্রেসন করে শেয়ার বিক্রি করার প্রক্রিয়ায় বেসরকারি মালিকের হাতে বিক্রি করে দেওয়া হবে। ১০০ দিনের মধ্যে রায়বেরিলির এমসিএফ কারখানাকে এইভাবে কর্পোরেটাইজশন করা হবে।

(৪) ৫০টি স্টেশন বিশ্বমানের করতে ও উন্নয়নের নামে বেসরকারিকরণ করা হবে

ইতিমধ্যে মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত হাবিবগঞ্জ স্টেশন বিক্রি হয়ে গেছে। এবার ১০০ দিনের মধ্যে ৫০টি বড় স্টেশনকে জমি সহ বিক্রি করা হবে। গরিব মানুষেরা আশ্রয় খুঁজতে রেল স্টেশনে ঢুকতে পারবে না।

(৫) ভারতীয় রেলকে দ্রুত পুনর্গঠন করা হবে রেল বোর্ডকে ঢেলে সাজানো হবে। বাইরে থেকে প্রাইভেট বিশেষজ্ঞদের আনা হবে। নীচুতলায় ২০ শতাংশ আমলাদের রাইটসাইজিং ও কর্মদক্ষতা পর্যালোচনার মাধ্যমে বিদায় দেওয়া হবে। রেল বোর্ড হবে ঠুঁটো জগন্নাথ। আসল ক্ষমতা থাকবে ডিভিশন ও জোনে। বিদেশীকরণের নামে জোনের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হবে যাতে জোনের সমস্ত ট্রেন অপারেশনগুলোকে বেসরকারিকরণ করা যায়। এছাড়াও ডিজিটাইজেশন অর্থাৎ পেপারলেস রেলওয়ে প্রশাসনকে পুনর্গঠিত করতে ৩১ মার্চ ২০২০-তে ভারতীয় রেলের ৫টি প্রিন্টিং প্রেসকে বন্ধ করে দেওয়া হবে। পাস-পিটিও এবং টিকিট (পিআরএস/ইউটিএস দুটোই) ডিজিটাইজ করা হবে।

রেলওয়ে রেগুলেটরিং অথরিটি গঠন

যাত্রীভাড়া ও পণ্যমাশুল নির্ধারণ ছাড়াও উক্ত রেগুলেটরের অনেক কাজের মধ্যে অন্যতম হল বেসরকারি অপারেটররা যাতে রেলের পরিকাঠামো ব্যবহার করতে পারে তার তত্ত্বাবধান করা। শুরুতে বেসরকারি মালিকদের ট্র্যাক, সিগন্যাল ইত্যাদি পরিকাঠামো চুক্তির ভিত্তিতে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে। পুরোপুরি বেসরকারিকরণ হলে এটা আর দরকার হবে না।

রেলের জমি প্রসঙ্গে

ভারতীয় রেলের কাছে ৪ লক্ষ ৫৫ হাজার হেক্টর জমির মালিকানা স্বত্ত আছে। মোদী সরকার কেন্দ্রীয় ল্যাণ্ড ব্যাঙ্ক গঠন করেছে এবং তার সাথে রেলের জমি যুক্ত করা হবে। ইতিমধ্যে দেশী- বিদেশী কর্পোরেটদের স্বার্থেস্টেশন সংলগ্ন জমি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। হোটেল শপিংমল ইত্যাদি তৈরি হবে। গোপন অ্যাজেণ্ডা হল রেলের জমিতে বসবাসকারি অসংখ্য গরিব মানুষ ও ছোট দোকানদার আর হকারদের পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ করা হবে।

মোদী সরকার জল মাপছে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে — বেরিলি করখানার মালিকানা স্বত্তকে কর্পোরেশনে রূপান্তরণের জন্য পরামর্শদাতা হিসেবে ‘রাইটস’-কে নিযুক্ত করেছে। রাইটস-এর রিপোর্ট জমা পড়লেই কারখানা হস্তান্তরের কাজ শুরু হবে।

রেল শ্রমিকদের উপর উক্ত ১০০ দিনের সংস্কার কর্মসূচীর প্রভাব। ব্যাপক রেল শ্রমিকদের আশঙ্কা রেল বেসরকারিকরণ হলে বহু ক্ষেত্রে রেলকর্মীকে ‘উদ্বৃত্ত’ বলে ঘোষণা করা হবে। কাজের বোঝা বৃদ্ধি সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা কেড়ে নেওয়া হবে। কারণে অকারণে এক বিভাগ থেকে আর এক বিভাগে স্থানান্তরিত করা ও বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুন শ্রম কোড চালু হলে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার সংকুচিত হবে। সর্বোপরি নিরাপত্তাহীনতায় বাঁধা মজদুরের মতো দিন যাপন করতে হবে। বর্তমানে রেলের কর্মী সংখ্যা ১২,৪৬,৫০০। বেসরকারীকরণ হলে কর্মী সংখ্যা দ্রুতই হ্রাস পাবে। ইতিমধ্যে যাদের চাকুরি ৩০ বছর ও বয়স ৫৫ বছর হয়েছে তাদের কর্মদক্ষতা পর্যালোচনার জন্য নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়াতে ৩ লক্ষ রেলকর্মী কর্মক্ষমতা রিভিউ-এর মাধ্যমে বিদায় জানানো হবে অর্থাৎ ‘বাধ্যতামূলক অবসর’ নিতে বাধ্য করা হবে। রেলের নিজস্ব স্কুল ও হাসপাতাল বেসরকারি মালিকের হাতে তুলে দেওয়া হবে। ফলত, বেসরকারীকরণের ফলে রেল কর্মী ও পরিবারের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ওপর খরচ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাবে।

সাধারণ যাত্রী তথা জনগণের ১০০ দিনের কর্মসূচীর প্রভাব

ভারতীয় রেল সর্বস্তরের মানুষকে স্পর্শ করে, প্রভাবিত করে। কারণ এটি এমন একটি গণপরিবহন ব্যবস্থা যা এখনও আম আদমি গড়ে ৩১.৫৩ পয়সায় ১ কিলোমিটার রেলযাত্রা সম্পন্ন করতে পারে। বেসরকারিকরণের ফলে লোকাল ট্রেন ও মেট্রো পরিষেবার ভাড়া দ্বিগুণ হবে, ভর্তুকি ধীরে ধীরে তুলে দেওয়া হবে। মোদী সরকার দ্রুতই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সরে এসে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ যেমন ঠিকা শ্রমিক, সব্জি বিক্রেতা, ছোট দোকানদার যারা ভেণ্ডার ও মাসিক টিকিট কেটে যাতায়াত করেন তাদের ওপর আর্থিক বোঝা চাপাতে বদ্ধপরিকর। যে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকরা দূরপাল্লার ট্রেনে চেন্নাই বা দিল্লী, কেরালা পেটের দায়ে যাতায়াত করেন তাদেরও বর্ধিত ভাড়া গুণতে হবে।

১০০ দিনের রেল সংস্কার কর্মসূচীর বিরুদ্ধে ইণ্ডিয়ান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ফেডারেশন (আইআরইএফ) সমস্ত ইউনিয়নকে ঐক্যবদ্ধ করে সমস্ত কারখানা ও ওপেন লাইনে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছে। জাতীয় স্তরে শীঘ্রই আই আর ই এফ গ্রহণ করবে ও একটি ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গঠন করার দিকে এগোবে। ইতিমধ্যে আইআরইএফ-এর নেতৃত্বে ৭টি কারখানা ও ১০টি জোনাল রেলে ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু হয়েছে।

১৯৭৪ সালের ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটের প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা আছে। সেকাল ও একালের মধ্যে দুস্তর ফারাক। সেদিন ২০ দিনব্যাপী ধর্মঘটের অন্যতম দাবি ছিল বোনাস, ক্যাজুয়াল কর্মীর স্থায়ীকরণ ও বেতন পুর্নবিন্যাসের মতো অর্থনৈতিক ইস্যু। আর আজ তার চেয়েও পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। স্বাধীনতার পরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা জাতীয় সম্পত্তি দেশী ও বিদেশী পুঁজির কাছে জলের দরে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। রেলের সংস্কারবাদী ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্ব পুঁজির কাছে আত্মসমর্পণ গত ৪৫ বছরে রেল শ্রমিকদের জাতীয় স্তরে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রকৃত লালঝাণ্ডার ফেডারেশন তথা সংগ্রামী রেল শ্রমিক আওয়াজ তুলেছে — ‘‘রেল বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’’। তাই আজ জাতীয়স্তরে সমস্ত বাম ও গণতান্ত্রিক ধারার ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ নেতৃত্বে সার্বিক ঐক্য গড়ে তোলা সময়ের দাবি। ফ্যাসিবাদী হামলাকে রুখতে দ্রুতই জাতীয় স্তরে একটি ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী মঞ্চ গড়ে তুলতে হবে। অবশ্যই এই লক্ষ্য পূরণে নবগঠিত আইআরইএফ এবং এআইসিসিটিইউ-কে ভূমিকা নিতে হবে।

rail movement banaras
উত্তরপ্রদেশের বারানসীতে মিছিল
খণ্ড-26
সংখ্যা-19