মোদী-২ : শ্রমিক শ্রেণীর ওপর আক্রমণ আরো তীব্র
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

লাগামহীন বেসরকারিকরণ

কেন্দ্রীয় সরকার এবং নীতি আয়োগ ইতিমধ্যে ৭২ টিরও বেশি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাকে বন্ধের জন্য চিহ্নিত করেছে। নীতি আয়োগ ৪২টি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাকে অবিলম্বে বন্ধের সুপারিশ করেছে ।

বিমান পরিবহণ শিল্প যখন দ্রুত উন্নতি করছে তখন এয়ার ইন্ডিয়ার মরার ব্যবস্থা হচ্ছে। টেলিকম ইন্ডাস্ট্রি যখন ৫জি-র দিকে এগোচ্ছে বিএসএনএল তখন ৪জি প্রযুক্তি নিতেই অস্বীকার করছে। ইতিমধ্যেই আম্বানি এবং মিত্তালদের কাছে বিএসএনএল-কে একটি বড় থালায় সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। এয়ারটেল এবং জিও যখন ফুলেফেঁপে উঠছে বিএসএনএল তখন ৫৪,০০০ কর্মীকে ছাঁটাইয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে। এটি বলা হচ্ছে যে সরকারী মালিকানাধীন ব্যাঙ্কগুলিকে এবং বীমা সংস্থাগুলিকে লাভজনক করে তুলতেই এবং উদ্বেগজনক বিশাল অঙ্কের অপরিশোধিত ঋণ যার বেশিরভাগ কর্পোরেটদের, তার খারাপ প্রভাবের হাত থেকে বাঁচাতেই শুধুমাত্র তাদের মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যেটা বলা হচ্ছে না সেটা হল বেসরকারি কর্পোরেশনের কাছে লাভজনক কোম্পানি হিসেবে তাদের সরাসরি বিক্রয় করার জন্য এভাবে আকর্ষণীয় করে তোলা হচ্ছে ।

রেলওয়ে : ১০০ দিনের অ্যাকশন প্ল্যান

রেলওয়ে ব্যবস্থার পুনর্গঠন নিয়ে বিবেক দেবরায় কমিটি এবং নীতি আয়োগও যে বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছে তা হল সরকারের শুধু মাত্র বেসরকারি অংশগ্রহণের বিষয়েই মাথা ঘামানো উচিত এবং তাও সেসব রেলওয়ে ব্যবস্থার নন-কোর ফাংকশনগুলি অর্থাৎ রেলওয়ে হাসপাতাল, স্কুল, উৎপাদন কেন্দ্র, কারখানা, রেলওয়ে পুলিশ ইত্যাদির ক্ষেত্রে এবং তাও করতে বলা হয়েছে ১০ বছরের মেয়াদে।

কিন্তু বিপুল নির্বাচনী বিজয়ের মাধ্যমে বলীয়ান হয়ে মোদী-২ সরকার ১০০ দিনের অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে আসছে, যেখানে লাভজনক রাজধানী, শতাব্দী এবং যাত্রী পরিবহণকারী ট্রেনগুলিকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ট্রেন, টিকিট, স্কুল, হাসপাতাল এই সমস্ত বেসরকারি হাতে হস্তান্তরিত হবে এবং টিকিটের দাম বর্তমানের দ্বিগুণ হতে চলেছে। এই অ্যাকশন প্ল্যান ভর্তুকি ছেড়ে দেওয়ার জন্যে যাত্রীদের অনুপ্রাণিত (প্ররোচিত) করবে। আর সেই জন্যে ‘‘ছেড়ে দিন’’ প্রচারাভিযান শুরু হতে চলেছে। টিকিট কাটার সময় আপনি যদি ভর্তুকির অপশন প্রেস/টিক না করেন তাহলে যতবার আপনি টিকিট কাটবেন ততবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার টিকিটের মূল্য নির্ধারিত টিকিটের মূল্যের দ্বিগুণ হয়ে যাবে ।

ভারতীয় রেলওয়ে-ভারতবর্ষের মতো এই বিশাল দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সহজলভ্য গণপরিবহন পদ্ধতি অভিজাত শ্রেণীর পরিবহণ ব্যবস্থায় পরিণত হতে চলেছে এবং গরিবদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে চলেছে।

ঐতিহাসিক চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস (সিএলডডব্লিউ-পশ্চিমবঙ্গ), ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরি (আইসিএফ-চেন্নাই), ডিজেল লোকোমোটিভ ওয়ার্কস (ডিএলডব্লিউ-বেনারস), রেল কোচ ফ্যাক্টরি (আরসিএফ-কাপুরথালা) ইত্যাদি ভারতীয় রেলওয়ের সাতটি নিজস্ব উৎপাদন ইউনিট রয়েছে। প্রথমে এগুলির কর্পোরেটায়ন করা হবে, তারপর ব্যক্তিগত মুনাফাবাজদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট কারখানা সহ এই উৎপাদন সংস্থাগুলিকে প্রথমে মিশিয়ে একটা সংস্থায় পরিণত করা হবে, তারপর “ইন্ডিয়ান রেলওয়ে রোলিং স্টক কোম্পানি” নাম দিয়ে তার নতুন অস্তিত্ব ঘোষিত হবে। তারপর যখন সরকারি পয়সা বিনিয়োগ করে এই কোম্পানি লাভের মুখ দেখবে তখন তাকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হবে!! মডার্ন কোচ ফ্যাক্টরির (এমসিএফ-রাই বরেলি) সিইও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পাবে এবং পরবর্তীতে বাকি অন্যান্য উৎপাদন কেন্দ্রগুলি সরকার এবং রেলওয়ে বোর্ডকে এড়িয়ে পর্যায়ক্রমে হস্তান্তরিত হয়ে যাবে।

ভারতীয় রেলওয়েতে মালবাহী ট্রেন ধীরগতির যেখানে যাত্রী ট্রেনগুলি সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় থাকে। এখন পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। আগে সমস্ত মালবাহী ট্রেনগুলিকে পাস করিয়ে যদি ট্র্যাক খালি থাকে তাহলেই যাত্রীবাহী ট্রেন সবুজ সংকেত পাবে। আরো মালবাহী ট্রেন বাড়াবার জন্যে পূর্ব এবং পশ্চিমে ডেডিকেটেড ফ্রেইট কোরিডোর্স (ডিএফসিএস) তৈরি হচ্ছে। সুতরাং গরুই শুধুমাত্র মানবজাতির পদমর্যাদাকে অতিক্রম করে যায়নি, এখন মালবাহী ট্রেনও যাত্রীবাহী ট্রেনকে অতিক্রম করে যাচ্ছে।

এই ১০০ দিনের মধ্যে ৫০টি রেলস্টেশনকে “পুনর্নির্মাণ” এবং “বিশ্বমানের পরিষেবা”-র নামে বেসরকারিকরণের জন্যে চিহ্নিত করা হবে। সকলেই জানে আমাদের দেশে রেলস্টেশনগুলি গরিব গৃহহীন মানুষের আশ্রয়স্থল। এরপর টিকিট ছাড়া কেউ আর স্টেশনগুলিতে ঢুকতে পারবে না, তার টয়লেট ব্যবহার করতে পারবে না, প্ল্যাটফর্মের ছাউনিতে আশ্রয়ও নিতে পারবে না, যেমন নাকি এয়ারপোর্টগুলিতে হয়। এই সর্বস্বান্ত, নিঃস্ব মানুষগুলি তাদের এই সামান্য আশ্রয়টুকুও হারাবে ।

১০০ দিনের এই কর্ম পরিকল্পনা রেলওয়ে পুনর্গঠনের একটি নীল নকশাও তৈরি করবে। রেলওয়ে বোর্ডনখদন্তহীন হয়ে পড়বে কিন্তু কিছু নিয়ন্ত্রিত বাঁধাধরা কাজের জন্যে তাকে প্রস্তুত করা হবে। জোনাল জেনারেল ম্যানেজাররা এবং ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজাররা আঞ্চলিক এবং বিভাগীয় স্তরে আরো ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে। “মুনাফা করার জন্যে প্রতিযোগিতা-জনপরিষেবা দেওয়ার জন্যে নয়’’ এটাই হবে আঞ্চলিকভাবে মূল কেন্দ্রীয় ভাবনা। রেলওয়ে পুনর্গঠন-এই ভাবনার মধ্যেই রয়েছে বিশাল এই ভারতীয় রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণ করে দেওয়ার চাবিকাঠি।

সুনির্দিষ্ট মেয়াদি কর্মসংস্থান

কন্ট্রাক্ট সিস্টেম বা ঠিকা চুক্তি পদ্ধতি যখন দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে চলছে তখন সরকারের এবং মালিকদের প্রথম পছন্দ হল সম্পূর্ণ সাময়িক চাকরি, যার নাম দেওয়া হয়েছে “ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট” এবং এপ্রেন্টিসশিপ বা শিক্ষা-নবিশির সময়কালকে ক্রমাগত বাড়িয়ে যাওয়ার পদ্ধতি। এই দুটি পদ্ধতির কোনোওটিতে কর্মনিশ্চয়তা নেই। “হায়ার এবং ফায়ার” অর্থাৎ ইচ্ছেমতো কাজে নেওয়া বা ইচ্ছে মতো কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া — এই দুটোই খুব সহজ হয়ে গেছে।

এপ্রেন্টিস বা শিক্ষা নবীশদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরির কোনো নির্দিষ্ট মান নেই এবং ন্যূনতম মজুরির মাত্র ৭৫ শতাংশ দেওয়াই যথেষ্ট। সরকারের লক্ষ্য পরবর্তী তিন বছরে এই এপ্রেন্টিসদের সংখ্যা ৩ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ৩০ লক্ষ করা।

নতুন সংশোধনীতে সুপারিশ করা হয়েছে যে ঠিকা শ্রমিকেরা “সম কাজে সম বেতন” দাবি করতে পারবে না — তাঁরা শুধুমাত্র রাজ্যেই ন্যূনতম মজুরির দাবি করতে পারবে এবং সেটা নতুন সংশোধন/পরিবর্তন গুলির পরিপ্রেক্ষিতে শুধু মাত্র “ফ্লোর ওয়েজেস” হতে পারে।

জমি আত্মসাৎ

মোদী রাজত্বের প্রথম দফায় সে জমি অধিগ্রহণ বিল সংসদে উত্থাপিত করে ও সংশোধিত করে জমি দখলের পথ সুগম করার চেষ্টা করে, কিন্তু সে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তাই মোদী সরকার পুলিশি রাষ্ট্রের সহায়তায় এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার করে জমি দখল করতে চায় ও ল্যান্ড ব্যাঙ্ক তৈরি করতে চায় যেখানে শিল্পপতিরা আসবে আর কোনো কৃষক বা জমির মালিকের সঙ্গে কোনো দরকষাকষি ছাড়াই তাদের বিক্ষোভের মুখোমুখি না হয়েও সামান্য কিছু দাক্ষিণ্যে বিনা ঝঞ্ঝাটে হাজার হাজার একর জমি আত্মসাৎ করবে।

নীতি আয়োগের ভাইস চেয়ারম্যান রাজীব কুমার বলেছেন রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলির জমি সরকার অধিগ্রহণ করতে পারে। রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা ও সরকারের বিভিন্ন শাখাগুলির মালিকানাধীন জমি নিয়ে একটি পরিসংখ্যান তালিকা তৈরি করা হতে পারে। বিশেষত বৈদেশিক লগ্নির খাদ্য হিসেবে ছোট ছোট জমির মোড়ক বা সম্মিলিত একগুচ্ছ জমি (ল্যান্ড পার্সেলস এ্যান্ড ক্লাস্টার্স) তৈরি করা হবে।

এটা কর্পোরেট কা সাথ! কর্পোরেট কা বিকাশ! কর্পোরেট কা বিশ‌ওয়াস! এবং সমস্তটাই কৃষকের বুকের ওপর দিয়ে!

সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ সম্বন্ধীয় আইন

নিরাপত্তাহীন শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানোর নামে কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্যমান ওয়েলফেয়ার বোর্ডগুলিকে এবং সমস্ত সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। কোটি কোটি টাকার মিথ্যাচার করে পিএফ, ইএসআই, বিড়ি, নির্মাণ এর মতো বড় মাপের বোর্ড সহ আরো অনেক ওয়েলফেয়ার বোর্ডকে এক লহমায় তুলে নেওয়া হবে। মালিকদের আর শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়ার দায় থাকবে না, শ্রমিকদের দায় শ্রমিকদের ওপরেই বর্তাবে।

সামাজিক নিরাপত্তা আইনের উদ্দেশ্য মূলত, পুঁজিবাদীদের তার কাছে কর্মরত শ্রমিকদের প্রতি যেকোনো দায়িত্ব ও জবাবদিহির সামান্যতম আভাস থেকেও মুক্তি দেওয়া। এই আইনের মোদ্দা কথা সামাজিক সুরক্ষার ধারণা থেকে একেবারে উল্টো ধারণার পথে হাঁটা — যে ধারণায় মালিক এবং রাষ্ট্র, কর্মচারীদের স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় সুবিধা, অবসরকালীন সুবিধা এবং আরো অন্যান্য সুবিধাগুলির দায়িত্ব বহন করত।

“বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০১৯” এর ৩৫৩ নং অনুচ্ছেদে কাজের চরিত্র বদল এবং কাজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলা হয়েছে “বর্ধিত সামাজিক সহায়তা এবং বীমা, শ্রম নিয়ন্ত্রণে ঝুঁকির বিষয়গুলি মোকাবিলায় বোঝা অনেক কমিয়ে দেয়। জনসাধারণ উন্নত সামাজিক সহায়তা ও বীমা ব্যবস্থার মাধ্যমে অধিকতর সুরক্ষিত হয়ে ওঠে, শ্রম ব্যবস্থাপনাকেও, কাজের মধ্যেকার গতিবিধিকে সহজতর করার জন্যে, যেখানে যেমন দরকার সেখানে তেমন নমনীয় করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি জীবনধারণের উপযোগী একটি আয়ের ব্যবস্থা করতে হয়, দেশগুলিকে আরো বেশি করে সামাজিক সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে পরিপূরক উপার্জনের ব্যবস্থা হয় এবং ন্যূনতম মজুরির ওপর চাপ কমে। শ্রম উৎপাদনশীলতার থেকে ন্যূনতম মজুরির বেশি মাত্রায় নির্ধারিত হয় । অনুরূপভাবে, বিচ্ছিন্নভাবে বেকার ভাতা না দিয়ে বরং বেকার সুবিধার ব্যবস্থা করে বেকারদের আয় সহায়তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।”

সুতরাং, বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রেসক্রিপশনটির উদ্দেশ্য পুঁজির মালিকদের নিজেদের শ্রমিকদের দায় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া এবং সেই দায়িত্ব সমাজের এবং সেই সংশ্লিষ্ট কর্মীর ঘাড়ে চাপানো। মোদী সরকার এখন এই প্রেসক্রিপশনটিকেই কার্যকরী করতে চাইছে।

“প্রধানমন্ত্রী রোজগার প্রোৎসাহন যোজনা”-তে নতুন চাকুরি প্রাপ্তদের মধ্যে যারা মাসিক ১৫০০০ হাজার টাকার কম বেতন পান তাদের এমপ্লয়ী প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং এমপ্লয়ী পেনশন স্কিম-এ দেয় অংশ সরকার তিন বছরের জন্য দিয়ে দেবে। পুনরায়, মালিকদের শ্রমিক দায় থেকে মুক্তির এটা আরো একটা পন্থা, কারণ শ্রমিকদের ইএসআই ফান্ডে মালিকপক্ষের যে অংশটি দিতে হয় ইতিমধ্যেই তার জন্য শ্রমিকদের মজুরির ১.৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে । থ্রেশোল্ড লেভেল অর্থাৎ যে স্তরে থেকে শ্রমিকেরা বুনিয়াদি সুবিধাগুলি পেতে শুরু করে। কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি প্রস্তাব দিয়েছে এই থ্রেশোল্ড লেভেলকে ১৫০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫০০০ হাজার টাকা করে দেওয়া হোক।

শিল্প সম্পর্কসম্বন্ধীয় আইন

ট্রেড ইউনিয়নের গঠন প্রক্রিয়াটি জটিল করে দেওয়া হচ্ছে এবং সাধারণ শ্রমিক ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন ইতিমধ্যেই অস্বীকৃত। শ্রমিকদের ধর্মঘট করার মৌলিক বিভিন্ন প্রকারে কেড়ে নেয়া হচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতিও ধ্বংস করা হচ্ছে।

শুধুমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর বিপুল আত্মত্যাগ ও অনেক জঙ্গি আন্দোলনের পরে এই সকল বিদ্যমান আইনগুলি কার্যকরী হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে, শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনে আজ শতাব্দী প্রাচীন দিন প্রতি ৮ ঘন্টা কাজের দাবি ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিয়েও লড়তে হচ্ছে।

ভারতীয় ও বিদেশি কর্পোরেটরা তার বিশাল নির্বাচনী প্রচার খরচের জন্যে যে বিপুল অংকের টাকা দিয়েছে, মোদী-২ সরকার শ্রম সুরক্ষা ও রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রে সমগ্র পরিকাঠামোকে ভেঙ্গে ফেলে তা পরিশোধ করছে।

ভারতের শ্রমিকশ্রেণীকে সরাসরি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মোকাবিলা করতে হবে এবং ঐক্য ও সংহতির জোরালো বন্ধন গড়ে তুলতে হবে। শ্রমিকদের অধিকারের উপর এই হামলার বিরুদ্ধে, এই ঐক্য ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী তীক্ষ্ণতা শ্রমিক শ্রেণীর কার্যকরী প্রতিরোধের প্রথম শর্ত।

ভারতীয় রেলওয়ের কর্পোরেটায়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আসুন কর্পোরেটায়নের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করি ।

(রেল সহকর্মীদের কাছে কাপুরথালা আরসিএফ কর্মচারী ইউনিয়নের আবেদন)

ভারতীয় রেলওয়ের ৭টি উৎপাদন সংস্থাকে কর্পোরেটায়ন (এবং খুব দ্রুত বেসরকারিকরণ) করতে রেলওয়ের জন্যে মোদী সরকার ১০০ দিনের অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে এসেছে। যার অর্থ :

(১) রেলওয়ের বিভিন্ন সুবিধে যেমন পাস, পিটিও, পেনশন এবং চিকিৎসার সুযোগ — এসব কেড়ে নেওয়া হবে।

(২) কোম্পানির শর্তাবলীতে শ্রমিকদের নতুন করে চাকরিতে যোগ দিতে বাধ্য করা হবে।

(৩) শ্রমিকদের বলপূর্বক অবসর নিতে বাধ্য করা হবে।

(৪) বেতন মান একটি নতুন ভিত্তিতে সংশোধন করা হবে; বেতন কমিশন, মহার্ঘ ভাতা এবং অন্যান্য ভাতার অবসান হবে।

(৫) নতুন শ্রমিকদের ঠিকা পদ্ধতিতে প্রতীকী বেতনে নিযুক্ত করা হবে, আর তার ফল হবে চরম শোষণ।

(৬) বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা সময় মতো দেওয়া হবে না; চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার খাঁড়া সর্বদা শ্রমিকের মাথার ওপর উপর হুমকি হিসেবে ঝুলবে; কর্মীদের নিরাপত্তা গুরুতর বিপদের মুখে পড়বে।

(৭) উৎপাদনের গুণমান নিয়ে আপস করা হবে, ফলে রেল যাত্রীদের জীবন বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে।

(৮) দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, শ্রমশক্তি এবং প্রাকৃতিক উৎসগুলি অবাধে লুটপাট করা হবে এবং অনিয়ন্ত্রিত দূষণ, নৈরাজ্য এবং লুন্ঠণ রূপে জনগণকে এর মূল্য চোকাতে হবে।

(৯) সাধারণ নারী পুরুষ যাদের কাছে ট্রেনই একমাত্র যাতায়াতের সম্বল, ট্রেন যাত্রার অধিকার কেড়ে নেওয়ার বঞ্চনায় ছটফট করবেন, কারণ ট্রেনে চড়ার খরচ অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হবে।

(১০) যুদ্ধপরিস্থিতি, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা এরকম দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও কর্মীদল নিশ্চল হয়ে পড়বে। পুঁজিবাদীরা বিনাবাধায় দেশ লুটপাট করবে। দেশ আরো একবার ক্রীতদাস ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবে।

আমরা এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আরসিএফ কর্মচারী ইউনিয়ন, শ্রমিক ও তাদের পরিবারের কাছে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াবার আবেদন করছি।

(লিবারেশন জুলাই ২০১৯ থেকে) ভাষান্তর : মৃণাল

খণ্ড-26
সংখ্যা-21