প্রতিবেদন
কৃষক-সম্মান কৃষক-বন্ধু খয়রাতি প্রকল্পের অনুগ্রহ নয় -- কৃষকরা চায় অধিকার, ফসলের ন্যায্য দামের গ্যারান্টি
gggg

দেশের কৃষকদের চরম অপমান করে মোদী সরকার এখন কৃষক-সম্মান নিধি প্রকল্পে সংকটগ্রস্ত কৃষকদের অনুদানের ঢাকঢোল বাজাচ্ছেন! একদিকে কেন্দ্রের মন্ত্রীরা কৃষক আন্দোলনকে “পিকনিক” বলে বিদ্রুপ করছে, অপরদিকে পশ্চিবঙ্গকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে মোদী বলছেন যে, বাংলায় কৃষক সম্মাননিধি (পিএম কিষাণ) প্রকল্পে কৃষকদের বছরে ৬ হাজার টাকার অনুদান দেওয়া হচ্ছে না। বলছেন, এই রাজ্যের কৃষকরা কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জবাবে তৃণমূল সরকার বলেছে তারা কৃষকবন্ধু প্রকল্পে এ রাজ্যের কৃষকদের বছরে একর পিছু সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা, জমির পরিমান কম থাকলে সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা দিচ্ছে। বাস্তবে কেন্দ্রীয় সহায়তা হলো দৈনিক ১৬ টাকা ৪৩ পয়সা। আর রাজ্যের কৃষকবন্ধু প্রকল্পে ৫ হাজার টাকা পেয়েছে কেবল তারাই যাদের এক একর জমি রয়েছে। বলা হচ্ছে ৭২ লক্ষ কৃষক এই প্রকল্পে টাকা পেয়েছে। কিন্তু এ রাজ্যে ৮৬ ভাগ কৃষকই ক্ষুদ্র প্রান্তিক বর্গের। তারা পেয়েছে ২ হাজার টাকা, অর্থাৎ দৈনিক ৫ টাকা ৪৭ পয়সা। লক্ষ লক্ষ ভাগ চুক্তি চাষিরা কিছুই পায়নি। এই যৎসামান্য “সহায়তা” নিয়ে কেন্দ্র বনাম রাজ্যের চাপান উতোর চলছে। এর মাধ্যমেই নাকি ক্ষুধার রাজ্যে কৃষকের স্বার্থে তথাকথিত উন্নয়নের প্রতিযোগিতা চলবে!

এটা সর্বজনবিদিত যে নয়া কৃষি আইনে কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি উৎপাদন ও কৃষি পণ্যের বণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে রাজ্যের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করছে। কেবলমাত্র রাজস্বের ক্ষতি নয়, কেড়ে নেওয়া হচ্ছে রাজ্যের অধিকার। কারন সংবিধানে কৃষি রয়েছে যুগ্ম তালিকায়। নিশ্চিতভাবে এটা বিজেপির দ্বারা দেশের সংবিধানকে ধ্বংস করার আরও একটি নমুনা। কারণ, ভারতের মতো বিশাল ও বৈচিত্র্যময় দেশে কৃষিব্যবস্থার অসম বিকাশের কারনে কৃষি ক্ষেত্রে রাজ্যেরও ক্ষমতা থাকা জরুরি। কেন্দ্র সেই ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে। বিগত দিনগুলিতে কৃষিতে বিনিয়োগ ক্রমশ কমিয়ে এনে এখন আম্বানী-আদানী কর্পোরেটরাজ কায়েম করছে। এর বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে দেশব্যাপী অভূতপূর্ব কৃষক প্রতিরোধ। চলমান আন্দোলনে মোদী সরকার প্রবল চাপের মুখে পড়েছে। কিন্তু তৃণমূল সরকার কি করছে? তারা ঐ কেন্দ্রীয় প্রকল্পকে বন্ধ রেখে চরম কৃষক-বিরোধী মোদী সরকারকে এ রাজ্যের বুকে “কৃষক-দরদী” সাজার সুযোগ করে দিচ্ছে। এভাবে অন্যান্য বহু ক্ষেত্রের মতো তৃণমূলের গাজোয়ারী-স্বৈরাচারী অপশাসনে রাজ্যে ফ্যাসিবাদের পথকে সুগম করে দিচ্ছে। তৃণমূল যদি কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া কৃষি আইনের প্রকৃত বিরোধিতা করতে চায় তাহলে এ রাজ্যে তারা কৃষক স্বার্থে আলাদা আইন করার প্রচেষ্টা করছে না কেন? অন্যান্য ফসলের কথা যদি বাদও দেওয়া যায়, প্রকৃত গরিব মাঝারি চাষিদের থেকে রাজ্য সরকার সময় মতো ধান সংগ্রহ করছে না কেন? এ রাজ্যের চাষিরা অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কেন? কিষাণ মান্ডিতে কেন মহাজন দালালরা আধিপত্য কায়েম করে রেখেছে, যেখানে নানান অজুহাতে চাষিদের ঢুকতেই দেওয়া হয় না?

কিন্তু আসল প্রশ্নটা হলো শাসকের ছুঁড়ে দেওয়া এই রুটির টুকরো বা যৎসামান্য আর্থিক অনুদান কিংবা খয়রাতি সাহায্য কি কৃষকরা আদৌ চেয়েছে? মোটেই নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সারা দেশের কৃষকরা দীর্ঘ দিন ধরে দাবি তুলেছে, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) চাই, সঠিকভাবে হিসাব করে উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দাম চাই। সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র মধ্য চাষিরা চেয়েছে কৃষি উপকরণের দাম কমাও, কম সুদে কৃষি ঋণ দাও! ঋণমুক্তি চাই! কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করেছে। রাজ্য সরকারও ঘোষিত দামে ফসল কিনছে না। এসবের যোগফলে ঋণগ্রস্ত কৃষকের লোকসানের পরিমান হয়ে উঠছে বিপুল! ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার অধিকার কেড়ে নিয়ে কৃষককে সম্মানের নামে চরম অপমান করা হচ্ছে বা বন্ধু সেজে দেওয়া হচ্ছে ধোঁকা। গালভরা অনুদান প্রকল্পের বিজ্ঞাপনের আড়ালে চাপা দেওয়া হচ্ছে ফসলের ন্যয্য দাম পাওয়ার অধিকারের প্রশ্নটাকে। সরকারী প্রকল্পকে অনুগ্রহ বা দান হিসাবে দেখিয়ে ওরা ফয়দা তুলতে চাইছে ভোটের বাক্সে। এই তথাকথিত অনুদান ও কৃষকের প্রকৃত লোকসান — এ দুটোকে পাশাপাশি রেখে তুলনামূলক ভাবে বিচার করে দেখা যেতে পারে। যেমন এক বিঘা জমিতে ভালো ফলনে ৮ কুইঃ ধান উৎপাদন হয়। সঠিকভাবে ( C2+ ৫০%) বা উৎপাদন খরচের দেড়গুণ ধরে হিসাব করলে তার দাম হয় কুইঃ পিছু ২৪০০ টাকা। কেন্দ্র সরকার দর নির্ধারণ করেছে ১৮৬৫ টাকা। অর্থাৎ ৮ কুইঃ ধানে চাষির লোকসান ৪ হাজার ২৮০ টাকা।

অপর দিকে রাজ্য সরকার ধান না কেনায় কুইঃ পিছু ১৮৬৫ টাকার বদলে সেই ধান চাষি অভাবী বিক্রি করছে সর্বাধিক ১৩০০ টাকায়। সবমিলিয়ে এক একর জমিতে চাষির লোকসান কমবেশি ১৭ হাজার ৮৪০ টাকা। অপর দিকে রাজ্য সরকার ধান না কেনায় কুইন্টাল পিছু ১৮৬৫ টাকার বদলে সেই ধান চাষি অভাবী বিক্রি করছে সর্বাধিক ১৩০০ টাকায়। সবমিলিয়ে এক বিঘা জমিতে চাষির লোকসান কমবেশি ২১ হাজার ২০০ টাকা। আর রাজ্য সরকার তাকে দিচ্ছে মাত্র ৫ হাজার টাকা! কেন্দ্র দেবে বলছে ৬ হাজার টাকা! সবটা পেলেও কেবল একটা ফসলেই কৃষকদের বড় ধরনের লোকসান! তাহলে এই অনুদান প্রকল্পে কৃষকের প্রকৃত লাভ কোথায়? আসলে এই ভাবে সরকার কৃষকদের বোকা বানিয়ে, ভোটের সস্তা রাজনীতি করতে চাইছে।

এবারে ঘোষিত ও প্রকৃত এমএসপি-র পার্থক্যটা বিচার করে দেখা যাক। মোদি সরকার এ বছর প্রতি কুইন্টাল ধানের গড় উৎপাদন ব্যায় ১২৪৫ টাকা ধার্য করেছে। যেখানে গত বছর সি-২ অনুযায়ী ধানের উৎপাদন ব্যায় কুইন্টাল প্রতি ছিলো ১৭২২ টাকা, এর সাথে ৫০% মুনাফা যুক্ত করলে গত বছরই ধানের প্রকৃত সহায়কমূল্য কুইন্টাল প্রতি ২৫৮৩ টাকা হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু উৎপাদন খরচের হিসাবে কারচুপি করা হয়েছে। কেবল সার, বীজ ও পারিবারিক শ্রমের দামকে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। কিন্তু জমির খাজনা ও সুদ সহ ঋণ শোধের দায়কে (C2) রাখা হয়েছে হিসাবের বাইরে।

পাঞ্জাবের কৃষিমন্ত্রক গত বছর ধানের গড় সহায়ক মূল্য কুইন্টাল প্রতি ২৭৪০ টাকা ধার্য করেছিল। কেরল সরকার কৃষকদের ধান কিনছে প্রতি কুইন্টাল ২৬৯০ টাকায়। অন্যদিকে ছত্তিশগড় সরকারও গত বছর থেকে কৃষকদের ধান কিনছে কুইন্টাল প্রতি ২৫০০ টাকা হারে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিনছে ১৮১৫ টাকা, তার সাথে পরিবহন বাবদ ২০ টাকা যোগ করে, ১৮৩৫ টাকা কুইন্টাল দরে। এক বছর পর, যখন ফসল উৎপাদনের ব্যয় আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, তখন মোদি সরকার ধানের সর্বনিম্ন সমর্থন মূল্য কুইন্টাল প্রতি ১৮৬৮ টাকা নির্ধারণ করেছে, যা গত বছরের মোট ব্যয়ের সাথে ৫০% মুনাফার হিসাবে প্রতি কুইন্টালে ৫৬০ টাকা কম। নয়া কৃষি আইনে এই ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য বা এমএসপি তুলে দেওয়া হবে। এর বিপরীতে মোদীর কর্পোরেট তোষণের নমুনা হলো এ বছর কৃষিপণ্যের ব্যবসার জন্য বড় পুঁজিপতিদের আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে ১ লক্ষ কোটি টাকা। অথচ সেচ, কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ, কৃষিপণ্য ক্রয় ও তার ব্যবস্থাপনা, কৃষি উপকরণে ভর্তুকি এসব ক্ষেত্রে ব্যায়বরাদ্দ ক্রমশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য কেন্দ্রীয় প্রকল্পের মধ্যে মোদী সরকারের স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পে শৌচাগার নির্মানে দেখা যাচ্ছে ৯০ ভাগই অব্যবহৃত। জনধন যোজনারও ৮০ ভাগ এ্যাকাউন্টে কোনো টাকা ঢোকেনি। ফসল বীমা যোজনায় ২০১৭-১৮ সালে বড় বীমা কোম্পানিগুলি ২৫০০ কোটি টাকা লাভ করেছে। মোদীর গুজরাট মডেলের চিত্র বিচার করে দেখা যাচ্ছে ২০০১-২০১১ সালে ৩.৩৫ লক্ষ কৃষক হারিয়ে গেছে, বিপরীতে নথীভূক্ত ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বেড়েছে ১৭লক্ষ, এটাই হলো রপ্তানিমুখী কৃষির ফলাফল। এ পথেই নাকি ওরা “সোনার বাংলা” বানাবে!

- জয়তু দেশমুখ     

 

খণ্ড-27
সংখ্যা-47