খবরা-খবর
ঋণ মুক্তি কমিটির প্রথম রাজ্য কনভেনশন
fff

লকডাউনে বিপর্যস্ত দরিদ্র মানুষের উপর চেপে থাকা বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণের বোঝা ও সেই সংক্রান্ত বিভিন্ন ঋণদাতা সংস্থার কিস্তি আদায়ের জুলুমবাজি থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে গত মার্চ-এপ্রিল মাস থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ সংগঠিত হতে শুরু করেন, গড়ে ওঠে ঋণ মুক্তি কমিটি (আয়ারলার অন্তর্ভুক্ত)। এই সংগঠনের প্রথম রাজ্য কনভেনশন সংগঠিত হয়ে গেল গত ২৮ ডিসেম্বর চুঁচুড়ায়। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ২৫০ জন প্রতিনিধি ও সংগঠক উপস্থিত হন এই সম্মেলনে। ঋণভারে জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যাকারী সমস্ত মানুষ ও রাজধানীতে নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে থাকাকালীন মৃত অন্নদাতাদের অর্থাৎ রাষ্ট্রের জনবিরোধী নীতির দ্বারা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপরে শুরু হয় খসড়া প্রতিবেদন পাঠ ও তার উপরে আলোচনা। বক্তাদের মধ্যে ৯০% ছিলেন মহিলা। এছাড়াও কিছু আইনজীবী, গণআন্দোলনের সংগঠক, শিক্ষক প্রমুখ পরামর্শ ও অনুপ্রেরণামূলক বার্তা রাখেন।

আগে থেকে সতর্ক না হয়ে মাত্র ৪ ঘন্টার নোটিশে নামিয়ে আনা কুপরিকল্পিত লকডাউন গোটা দেশের অর্থনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের পক্ষে করোনা আক্রান্ত না হলেও বেঁচে থাকা একপ্রকার দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় কেন সরকার অতিমারীর মতো এত বড় বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াবে না ‘বিপর্যয় মোকাবিলা আইন’-এর ১৩ নং ধারা মোতাবেক তাদের ঋণ মকুব করে? সরকারী তথ্যই বলে দিচ্ছে যে, ১২.২ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন লকডাউনে! অতএব প্রকৃত সংখ্যাটা নিশ্চয়ই আরো অনেকটা বেশি। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলো ঋণফাঁদে পড়ে অসহায়, সদস্যরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, কৃষকদের অবস্থাও তথৈবচ, বিপন্ন শহুরে ঋণ নির্ভর বড় অংশের নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষও। মোদী সরকার ‘আত্মনির্ভরশীলতা’-র ঢাকঢোল পেটাতে ব্যস্ত! সংবিধানের ২১ নং ধারা অনুসারে নাগরিকদের জীবন জীবিকার অধিকার নিশ্চিত করার ইচ্ছা বা সময় কোনোটাই সরকারের নেই। দেশের বরিষ্ঠ আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টেও এসব প্রশ্নে তোলপাড় করছেন, শীর্ষ আদালত দিশেহারা। সরকার মাত্র ৬ মাসের সুদের উপর সুদ মকুব করেই “আর কিছু পারবো না” মনোভাব দেখিয়ে হাত তুলে রেখেছে। তবে এটুকুও হতো না বাংলা, পাঞ্জাব, অসম, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্র, তামিলনাড়ু সহ রাজ্যে রাজ্যে লাগাতার ঋণ মুক্তি আন্দোলন শুরু না হলে। অথচ এই সরকারটাই লকডাউনের প্রথমদিকে রামদেব, নীরব মোদী, বিজয় মাল্য সহ ৫০ জন শিল্পপতির ৬৮, ৬০৭ কোটি টাকা লোন মকুব (রাইট অফ) করে দিতে পেরেছে!

এদিকে ঋণগ্রস্ত গরিব মানুষের ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে ঋণ সংস্থার এজেন্টদের হানাদারি, মহিলাদের উদ্দেশ্যে অশালীন কথাবার্তা, পুলিশ দিয়ে সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করানোর বেআইনি হুমকি। কিন্তু যেখানেই মানুষ সংগঠিত ও সচেতন সেখানেই কোম্পানি গুলোর এজেন্ট ও উচ্চতর কর্তাদের সাথে মুখে মুখে তর্ক ও প্রয়োজনে এলাকা ছাড়া করে চলছে জনতার সাহসী প্রতিরোধ। কৃষকদের দাবির সাথে ঋণ মুক্তির দাবিকে যুক্ত করে পোস্টার, হ্যান্ডবিল সহ ব্যাপক প্রচার চালিয়ে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। এলাকা স্তরে বিডিও, মহকুমা শাসক, জেলাশাসক সর্বত্র বিক্ষোভ, ডেপুটেশন সংগঠিত হয়েছে ঋণ মুক্তি কমিটির তরফে। প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে হাজার হাজার পোস্টকার্ড পাঠানো হয়েছে। মাইক্রো ফিনান্স সংক্রান্ত আইনবিধিকে সামনে এনে এজেন্টদের জুলুমবাজির বিরুদ্ধে থানা ডেপুটেশন, বন্ধন, উজ্জ্বীবন সহ বিভিন্ন মাইক্রো ফিনান্সের অফিস ঘেরাও অভিযান সংগঠিত হয়েছে। থানায় গণস্বাক্ষর সহ জুলুমকারী এজেন্টদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন গুড়াপ, আরামবাগের মহিলারা। এইসব লড়াই না থাকলে ঐ কঠিন দিনগুলোতে জুলুমবাজির অপমানের জ্বালায় রাজ্য জুড়ে চলতো আত্মহত্যার মিছিল। ঋণ মুক্তি কমিটি এই সত্য তুলে ধরেছে যে, লকডাউনের আগে মার্চ মাসের গোড়া পর্যন্ত যাঁরা (বিশেষত মহিলারা) নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেছেন তাঁরাই আজ কিস্তি দিতে পারছেন না সরকারের সর্বনাশা নীতি ও আকস্মিক কুপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে, কাজেই সরকারকেই তাঁদের সুরক্ষার দায় নিতে হবে। ঋণ জর্জরিত মানুষ আত্মবিশ্বাসের সাথে আজ জেনেবুঝে প্রশ্ন করছেন যে, কোম্পানিগুলো কেবল নিজেদের মুনাফার সংকীর্ণ স্বার্থে কেন বেআইনিভাবে এক একজন ব্যক্তিকে একসাথে ৪/৫টি করে লোন দিয়ে ফাঁদে ফেলেছে? যেখানে ২০১৪ সালের মাইক্রো ফিনান্স সংক্রান্ত আইনি নির্দেশাবলী বলছে, কোনো ব্যক্তির নেওয়া একটি ঋণের অন্তত ৭০% শোধ না না হলে তাকে দ্বিতীয় ঋণ দেওয়া যাবে না এবং একজনকে একসাথে ১.২৫ লক্ষ টাকার বেশি ঋণ দেওয়া চলবে না। সুতরাং আইন ভেঙে মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে তাদেরকে একের পর এক ঋণ নিতে প্রলুব্ধ করে ঋণফাঁদে জড়িয়ে দেওয়ার দায় অবশ্যই কোম্পানিগুলোর, ঋণগ্রহিতার নয়। সুতরাং কেবল সরকারের নয়, কোম্পানিগুলোরও দায়িত্ব হল মেহনতি মানুষকে ঋণছাড় দিতে এগিয়ে আসা।

gggg

 

এইসব প্রশ্ন, আরো বিস্তারিত আইনী পরামর্শ ও বিভিন্ন প্রতিরোধের অভিজ্ঞতা এবং আগামী পরিকল্পনায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো সংগঠনের প্রথম রাজ্য কনভেনশন। ক্ষোভ প্রকাশিত হল রাজ্য সরকারের প্রতিও, কারণ এই সংকটে কেবল স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর একাউন্টে এককালীন ৫ হাজার টাকা দিয়েই দায় সেরেছে মমতা ব্যানার্জীর সরকার। পুজো কমিটিগুলোকে ৫০০০০ টাকা করে সাহায্য করলেও লক্ষ লক্ষ ঋণগ্রস্ত গরিব মানুষের জন্য সরকারের কোনো প্রকল্প নেই। বাড়িতে বাড়িতে এজেন্টদের জুলুমবাজি দেখেও রাজ্য প্রশাসন নির্বিকার! তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, কর্ণাটকে মহাজনি জুলুম বন্ধ করতে আইন রয়েছে অথচ এ’রাজ্যে নেই। আগামীদিনে তাই এই ব্যাপারে রাজ্য সরকারের কড়া হস্তক্ষেপ দাবি করতে এক রাজ্যব্যাপী ‘কলকাতা চলো’ কর্মসূচীর ডাক দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে, যে কর্মসূচী প্রবল ঠান্ডায় দিল্লির রাস্তায় বসে থাকা কৃষকদের থেকে শিক্ষা নিয়ে কেন্দ্রের সরকারকেও এই হুঁশিয়ারি পৌঁছে দেবে যে, সাধারণ মানুষের সম্মিলিত শক্তিকে অবহেলা করলে ফল ভুগতে হবে।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন প্রথম থেকেই এই আন্দোলনের পাশে সর্বতোভাবে রয়েছে বলে জানিয়েছে। ঋণ মুক্তি কমিটির সমস্ত সদস্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, আসন্ন নির্বাচনগুলিতে তাঁরা প্রতিটা রাজনৈতিক দলের দাবি সনদে এই ঋণ মুক্তির দাবিটা আছে কিনা তা খুঁটিয়ে দেখবেন। এই দাবি ইস্তেহারে জায়গা না পেলে একটিও ভোট নয়। আগামীর লড়াইয়ে আরো সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত নেতৃত্বদানের জন্য একটি রাজ্য নেতৃত্বকারী কমিটির প্রাথমিক কাঠামো তৈরি হয়েছে, যেটি কিছুদিনের মধ্যেই আরো কিছু মানুষকে সামিল করে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে চলেছে। আগামী ৮ জানুয়ারী রাজ্যের সমস্ত ব্লকে ব্লকে দরিদ্র মানুষের ঋণ মুক্তির দাবিতে ও দিল্লিতে চলমান কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে গণ অবস্থান কর্মসূচী গৃহীত হয়েছে।

- সৌরভ রায়    

খণ্ড-27
সংখ্যা-47