খবরা-খবর
অধিকার ছিনিয়ে নিতে রুখে দাঁড়াচ্ছে বিষ্ণুপুর

মন্দির শহর বিষ্ণুপুরের শ্রমজীবী মানুষ জোট বাঁধছেন। ছাত্র-যুব-মহিলা ও বিভিন্ন অসংগঠিত দিনমজুরদের মধ্যে আইসা, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ও এআইসিসিটিইউ ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। নাগরিকত্ব প্রশ্নে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সাম্প্রতিক বিভাজন-বিদ্বেষের রাজনীতির বিরুদ্ধেও ধাপে ধাপে জন সচেতনতা গড়ার উদ্যোগ চলে। সর্বশেষ, বিগত দেড় মাস ধরে কমবেশি পাঁচ-ছয়টি মহল্লায় বাড়ি বাড়ি প্রচার চালিয়ে একটি করে ‘এনপিআর সংক্রান্ত আলোচনা সভা’ আয়োজিত হয়। শাসক শক্তিগুলির বিভিন্ন স্তরের বাধাকে অতিক্রম করে বিষ্ণুপুর নাগরিক মঞ্চের প্রান্তিক দাসগুপ্ত, মোসারফ হোসেন খান, সেখ ইদ্রিস সহ তিতাস গুপ্ত ও বিল্টু ক্ষেত্রপাল সহ বেশ কয়েকজনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সভাগুলি স্থানীয় মানুষের একতা তৈরী করতে থাকে। এই সভাগুলিতে এনআরসি ও সিএএ নিয়ে বিস্তারিত চর্চা হয় ও একের পর এক মহল্লায় এনপিআর (এনআরসি প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ) বয়কটের সিদ্ধান্ত নেন সমবেত মানুষজন। ঠিক হয় এনপিআর আটকাতে পাড়ায় পাড়ায় একতা গড়ার কাজ আরও প্রসারিত করতে হবে, বেশ কিছু ওয়ার্ড মজবুত ভাবে রুখে দাঁড়াতে সক্ষম হলে সারা শহর জুড়েই এক জনজাগরণ সৃষ্টকারী আলোড়ন পড়বে, এনপিআর আটকে এনআরসির মতো ভয়ঙ্কর বিপর্যয়কে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। এই সভাগুলিতে সিপিআই(এমএল) কর্মীরা ফ্যাসিবাদের সামগ্রিক বিপদ সম্পর্কেই সচেতন করেন শহরবাসীদের। জন-একতা যে শুধুমাত্র এনআরসি-বিরোধী পরিকল্পনা করেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের দায়বদ্ধতা শেষ করতে পারে না – তা স্পষ্ট করে তুলে ধরেন তাঁরা। সেখানে প্রথম সভা থেকেই ঠিক হয় যে এই ‘একতা’ বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে সমস্ত গরিব ও মেহনতি মানুষের সব রকম শোষণ ও বঞ্চনার প্রশ্নগুলোকেও সামনে নিয়ে আসবে, অধিকারগুলি ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে এবং তা ছিনিয়ে নিতে সক্রিয় থাকবে।

bk

 

প্রথম সভাটি আয়োজিত হয় ৬নং ওয়ার্ডের বাউরী পাড়াতে। উপস্থিত শ’খানেক মানুষের মধ্যে মহিলারাই ছিলেন অর্ধেকের বেশি। এরপর একইরকম মিটিং বা আলোচনা সভা হয় ৫নং ওয়ার্ডের রূপকথা, ৬নং এর মনসাতলা, হাঁড়িপাড়া, বিশ্বাসপাড়া, ৯নং এর সেখপাড়া, আকুঞ্জিপাড়া সহ আরো বেশ কিছু এলাকায়, এবং এইসব সভা থেকেই পরিকল্পনা নেওয়া হয় মহকুমা আধিকারিকের দপ্তরে ডেপুটেশন জমা দেওয়ার। ইতিপূর্বে ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষদের স্বাক্ষর সহ তালিকা বাঁকুড়া জেলা আধিকারিকের কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল গত সেপ্টেম্বর মাসে। তখন থেকেই, যেসব মানুষের কাছে সিপিআই(এমএল) কর্মীরা গিয়েছেন সকলের কাছেই “বাস্তুহীন ও ভূমিহীনদের পাট্টা সহ ঘর” পাওয়ার অধিকারের দাবিকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রচার চালিয়েছেন। সেই সূত্রে ব্যাপক সংখ্যায় বস্তিবাসী, বিশেষত মহিলারা যাঁরা এনআরসি-র দুশ্চিন্তায় আছেন, এগিয়ে আসতে শুরু করেন। গরিব ও মহিলারা বুঝতে পারছেন যে বিজেপির এনআরসি অভিযান তাঁদের জীবন জীবিকা ও পরিবারকে ছিন্নভিন্ন বিপর্যস্ত করে দেবে, অধিকার চাওয়ার অধিকারটুকুও আর অবশিষ্ট থাকবে না, আধুনিক দাস ব্যবস্থা চেপে বসবে সমাজে। বহু মহিলা বিবাহ সূত্রে নিজেদের জন্মভূমি বহু পূর্বে ত্যাগ করে কোনরকম কাগজপত্র ছাড়াই নতুন সংসার গড়েছেন – তাঁরা সবরকমভাবে এই ‘অধিকারের লড়াই’কে সক্রিয় সমর্থন যোগাচ্ছেন। এআইসিসিটিইউ-র তরফে পৌরসভার সাফাইকর্মী, তাঁত শিল্পী, বিড়ি বাঁধা শ্রমিক, নির্মাণ ও আরো বেশ কিছু অসংগঠিত শ্রমিকের সাথে সংযোগ গড়ে তাঁদের জীবিকা সংক্রান্ত অধিকারের প্রশ্নগুলি প্রচার করা হয় ও দাবি সনদ প্রস্তুত করা হয়, আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরাও পাশে এসে দাঁড়ান এই কাজে।

bankura

 

১৬ মার্চ একটি প্রাণবন্ত মিছিল ৫, ৬ ও ৯ নং ওয়ার্ড সহ পৌরসভা চত্বরের পাশের পথ হয়ে সকাল ১১ টা নাগাদ মহকুমা আধিকারিকের করনে উপস্থিত হয়। সেখানে আগে থেকেই মিছিলকে স্বাগত জানাতে একত্রিত হয়ে অপেক্ষায় ছিলেন ২০-২৫ জন সমর্থক যাদের প্রায় সকলেরই বয়ষ ষাট-সত্তরের ঘরে। মিছিল আত্মবিশ্বাস জাগাচ্ছিল। প্রথমত, মিছিলের বড়ো অংশই প্রথমবার কোনও রাজনৈতিক মিছিলে পা মিলিয়েছেন, দ্বিতীয়ত, জমায়েতের অর্ধেক অংশই মহিলা, এবং সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল অতিবয়স্ক প্রবীণেরাও মিছিলকে উৎসাহিত করতে হাজির হয়েছিলেন। পরিশেষে ফারহান হোসেইন খান, বিল্টু ক্ষেত্রপাল ও দিলবার খান – এই তিন জনের প্রতিনিধি দল স্মারকলিপি জমা দিতে যান। স্মারকলিপিতে থাকা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো –

অবিলম্বে বিষ্ণুপুর পৌরসভার ৩০০ অস্থায়ী কর্মীর স্থায়িকরণ সহ ২-৩ মাসের বকেয়া মজুরি মিটিয়ে সরকার-নির্ধারিত মজুরি চালু করা ও সাফাইকর্মীদের কর্মক্ষেত্রে আহত হওয়ার আশঙ্কা কাটিয়ে নিরাপত্তা সামগ্রী ও পরিচ্ছন্নতার সামগ্রী সরবরাহ করা। এআইসিসিটিইউ-এর পক্ষ থেকে দিলবার খান জানান – কর্মী ছাঁটাই রুখে পৌরকর্মীদের অবস্থার দ্রুত উন্নতি ঘটাও, এনপিআর বন্ধ করে ভূমিহীন-বাস্তুহীনদের তালিকা বানাও আর বাস্তু পাট্টা সহ ঘর দাও, পৌরসভা শ্রমিক সহ সমস্ত চুক্তিভিত্তিক প্রকল্প কর্মীদের মাসে সরকার নির্ধারিত ন্যুনতম ১৮,০০০ টাকা মজুরি দাও; নিকাশি নালাগুলির সংস্কার কর, আবর্জনা ফেলার স্থায়ী সমাধানের জন্য খাস জমিতে স্বল্প স্থানেই দূষণমুক্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবর্জনা পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যবস্থা স্থাপন কর; ৬০ বছরের উর্দ্ধে সমস্ত গরিব মানুষকে মাসে ৬০০০ টাকা পেনশন দাও; তাঁত শিল্পী, বিড়ি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক সহ সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের দ্রুত ‘সামাজিক সুরক্ষা’ প্রদান করো; শহরের জলাশয় ও বাঁধগুলিকে সংস্কার করে মাছ চাষের মধ্যে দিয়ে কর্মদিবসের সৃষ্টি করো ও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলো; কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের সুরক্ষা ও ‘নির্ভয় স্বাধীনতা’ সুনিশ্চিত করো; বিষ্ণুপুর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নত করা সহ ডাক্তার ও সহকারী কর্মীর সংখ্যা বাড়াও, দালালচক্রের হাতে রোগী পরিবারের হয়রানি বন্ধ করো এবং করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় আইসোলেশন ওয়ার্ড-মাস্ক-গ্লাভসের ব্যবস্থা সহ সচেতনা বাড়ানের জন্য প্রচার করো।মেহনতি গরীব মানুষের ন্যূনতম প্রাপ্য অধিকারগুলির কথা প্রশাসনের কানে ঢোকাতেও যে অনেক বাদানুবাদ চালাতে হয় তা সকলেরই জানা, আর গরিবের কথা কানে ঢুকলেও মনে জায়গা তো অত সহজে পায় না! ফলত আসল লড়াইটা জন-একতা গড়ার, অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার, ঐক্য নিরন্তর প্রসারিত করে চলার। বিষ্ণুপুর সেই লড়াই চালিয়ে যাবে।

খণ্ড-27
সংখ্যা-8