ভেঙে পড়ল ইয়েস ব্যাঙ্ক : অর্থনীতির ক্ষেত্রে মোদীর অরাজক পরিচালনা বিপুল ক্ষতি সৃষ্টি করে চলেছে

মোদী জমানায় ভেঙে পড়ল আরো একটা ব্যাঙ্ক। আরবিআই সর্বশেষ যে ভারতীয় ব্যাঙ্কটিকে রুগ্ন এবং অকার্যকর বলে ঘোষণা করেছে সেটি হল ইয়েস ব্যাঙ্ক যা এইচডিএফসি, আইসিআইসিআই, এক্সিস ব্যাঙ্ক এবং কোটাক মাহিন্দ্রর পর পঞ্চম বৃহত্তম বেসরকারী ব্যাঙ্ক। অর্থ মন্ত্রী যখন এই বলে আমানতকারীদের আশ্বস্ত করছেন যে তাদের টাকা সুরক্ষিত রয়েছে, আরবিআই তখন ঐ ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার ওপর সীমা বেঁধে দিয়েছে এবং যে সমস্ত আমানতকারীদের তাৎক্ষণিকভাবে টাকার দরকার তাদের ভয়ানক সংকটের মধ্যে ফেলছে। গত বছরের শেষের দিকে পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্র কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কে একই ধরনের সংকটের পর ইয়েস ব্যাঙ্কের এই ভাঙন দেখা গেল, কিন্তু মাত্রার দিক থেকে ইয়েস ব্যাঙ্কের সংকট অনেক বড় এবং গোটা ব্যাঙ্ক ক্ষেত্রের জন্য ভয়াবহ তাৎপর্যে পরিপূর্ণ।

ইয়েস ব্যাঙ্কের এই ভেঙে পড়াটা অর্থনৈতিক নীতিমালা এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে মোদী সরকারের সার্বিক অযোগ্যতার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। আপাত দৃষ্টিতে, ক্রমেই ভয়াবহ আকারে বেড়ে চলা অনুৎপাদক সম্পদের ভারেই ইয়েস ব্যাঙ্ক ভেঙে পড়েছে। প্রধানত কর্পোরেট সংস্থাগুলোর অপরিশোধিত বড় অঙ্কের ঋণই সরকারী অভিধায় হল অনুৎপাদক সম্পদ এবং তা ভারতের বড়-বড় ব্যাঙ্কের গোটা বিন্যাসটিকে ক্ষতিগ্ৰস্ত করে চলার ক্ষেত্রে এক সাধারণ সমস্যা। তবে ইয়েস ব্যাঙ্কের কাহিনির মধ্যে কিন্তু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ব্যাঙ্কটি স্থাপিত হয় ২০০৪ সালে, ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তার উদ্যোক্তাদের মধ্যে সংঘাত বাধে এবং এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাণা কাপুরকে অর্থ নয়ছয় করার অভিযোগে এখন গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে। যানা গেছে, তিনি এফ এম হুসেনের আঁকা রাজিব গান্ধির একটি প্রতিকৃতি প্রিয়াঙ্কা গান্ধি বঢরার কাছ থেকে দু-কোটি টাকা দিয়ে কিনেছেন। আর তাই মোদী জমানার প্রচারকরা তাঁকে ইউপিএ জমানার ঘনিষ্ঠ রূপে তুলে ধরে গোটা সংকটটার জন্য তাঁর অপকর্মগুলোকেই দায়ী করতে চান।

এই যুক্তিধারা একেবারেই খাটে না। ঘটনা হল, ব্যাঙ্কের ঋণ মূলত মোদী শাসনের বছরগুলোতেই লাফিয়ে বেড়ে চলে, ২০১৪ সালের মার্চ মাসের ৫৫৬৩৩ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে ঐ ঋণ গিয়ে দাঁড়ায় ২৪১৪৯৯ কোটিতে। আরো রহস্যজনক ব্যাপার হল, ঋণ বিমুদ্রাকরণ পরবর্তী পর্যায়েই বাড়ে ১০০০০০ কোটি টাকারও বেশি যখন বিনিয়োগের পরিমণ্ডল একেবারেই নৈরাশ্যজনক এবং ব্যবসাও সমস্ত ক্ষেত্রে দুর্দশাগ্রস্ত ও ঝিমোনো অবস্থায় রয়েছে। জনশ্রুতি অনুযায়ী আরবিআই এবং অর্থ মন্ত্রকের নজরদারিতে থাকা অবস্থাতেই এটা ঘটে। আরো কৌতূহলের ব্যাপার হল, রাণা কাপুর ২০১৯-এর নভেম্বর মাসে ব্যাঙ্কে তাঁর সমস্ত শেয়ার বিক্রি করে দিতে সক্ষম হন, ফলে ব্যাঙ্ক থেকে কার্যত সরে দাঁড়ান। যে ঋণের পরিশোধ হওয়ার সম্ভাবনা কম সেই ধরনের ঋণ ব্যাঙ্কে পুঞ্জীভূত হতে দেওয়া হল কেন, জনগণের কাছে তার জবাবদিহি আরবিআই এবং অর্থ মন্ত্রককেই করতে হবে।

পরিশোধের সম্ভাবনা কম থাকা ঋণ ব্যাঙ্ক যাদের দিয়েছে তাদের মধ্যে এমন সমস্ত কর্পোরেট সংস্থা রয়েছে যারা বর্তমান শাসক জমানার ঘনিষ্ঠ। ব্যাঙ্কের দেওয়া সমস্ত ঋণের মধ্যে দশটা বড় বাণিজ্য গোষ্ঠীর ৪৪টা কোম্পানিকে দেওয়া ঋণের পরিমাণই হল ৩৪০০০ কোটি টাকা। অনিল আম্বানি গোষ্ঠীর অন্তত পক্ষে নটি কোম্পানিরই ঋণের পরিমাণ হল ১২৮০০ কোটি টাকা, আর এসেল গোষ্ঠীর ১৬টা কোম্পানি পকেটস্থ করেছে ৮৪০০ কোটি টাকা (এই এসেল গোষ্ঠী হল জি টিভি-র প্রতিষ্ঠাতা সুভাস চন্দ্রর নিয়ন্ত্রণাধীন মিডিয়া কনগ্লোমারেট)। এই অনিল আম্বানি হলেন তিনি যাঁকে নরেন্দ্র মোদীর সাক্ষর করা রাফাল চুক্তি দুর্নীতিতে এক বড় অংশ দেওয়া হয়েছিল, আর জি-টিভি তো কার্যত মোদী সরকারেরই এক প্রচার মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এই বিষয়টা জানাও যথেষ্ট শিক্ষামূলক যে, আরবিআই ৫ মার্চ ইয়েস ব্যাঙ্ক থেকে নগদ টাকা তোলার ওপর নিয়ন্ত্রণ জারির ঠিক আগে আদানি গোষ্ঠী সহ গুজরাট ভিত্তিক বেশ কিছু কোম্পানি ইয়েস ব্যাঙ্ক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নেয়।

ইয়েস ব্যাঙ্ক সংকটের শিকড় এইভাবে সুস্পষ্ট রূপে রয়েছে বেসরকারীকরণ ও উদারিকরণের নীতিমালার বর্তমান পরিমণ্ডলের গভীরে। এই নীতিমালা দক্ষতা এবং বৃদ্ধির উপায় হিসাবে নির্বিচার বেসরকারীকরণকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এরই সাথে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলে স্যাঙাতি পুঁজিবাদের সংস্কৃতি যার পরিণতিতে কার্যক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং আর্থিক দায়বদ্ধতার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে ব্যবসা এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার আধিপত্যকারী গাঁটছড়ার খেয়ালখুশি এবং সংকীর্ণ স্বার্থের অধীন করে তোলা হয়েছে। বর্তমান শাসকদের অধীনে এই গাঁটছড়া যতটা নির্লজ্জ এবং আগ্ৰাসী হয়ে উঠেছে আগে কোনোদিন ততটা হয়নি। ইয়েস ব্যাঙ্ককে রক্ষা করার যে নিদান আরবিআই ঘোষণা করেছে তাতে ঐ সংকটের গভীরতর হয়ে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যাঙ্কটির শেয়ার কিনে নিয়ে তাকে সংকট থেকে উদ্ধার করতে এসবিআই-কে আসরে নামানো হয়েছে—২৪৫০ কোটি টাকা লগ্নি করে ব্যাঙ্কের ৪৯ শতাংশ শেয়ার অধিগ্ৰহণের নির্দেশ এসবিআই-কে দেওয়া হয়েছে এবং এমন একটা সময়ে ঐ নির্দেশ দেওয়া হল যখন ব্যাঙ্কের শেয়ার সমস্ত মূল্যই হারিয়েছে। এর আগে একই কায়দায় আইডিবিআই-কে সংকট থেকে উদ্ধার করতে এলআইসিআই-কে বাধ্য করা হয়েছিল। এটা জনগণের অর্থের বিপথে চালনা যাকে কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না এবং এটা ক্ষতির জাতীয়করণ ও লাভের বেসরকারীকরণের এক প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। তথাকথিত অপরিশোধনীয় ঋণগুলোর আদায়কে সুনিশ্চিত করতে সরকার এবং আরবিআই-কে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইয়েস ব্যাঙ্কের এই ভেঙেপড়াটাকে ভারতের ব্যাঙ্ক ক্ষেত্রকে রক্ষা করার এক চেতাবনি হিসাবেই দেখতে হবে এবং তা করতে হবে বেসরকারীকরণের বর্তমান নীতিমালাকে বাতিল করে এবং আরবিআই-এর স্বায়ত্ততা ও প্রাতিষ্ঠানিক সততাকে পুনর্বহাল করে।

এটাও খেয়াল করতে হবে যে বর্তমান সংকটের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে বিমুদ্রাকরণ পরবর্তী পর্যায়ে যখন সাধারণ জনগণকে তাদের সব টাকা ব্যাঙ্কে জমা করতে বাধ্য করা হয়েছিল। যদিও একই সময়ে ঋণ শোধ না করা বড়-বড় কর্পোরেট কর্তাদের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছিল অথবা আরো কয়েক দফা ‘অপরিশোধনীয় ঋণ’ দিয়ে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছিল। অর্থনীতির এই অরাজক পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা আরোপ করার সময় অবশ্যই সমুপস্থিত।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১০ মার্চ ২০২০)

খণ্ড-27
সংখ্যা-8