এক প্যাকেজের গল্প ও এক অব্যক্ত বেদনা
package

ম্যাডাম, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব? যদি কিছু মনে না করেন। হ্যাঁ,বলুন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় উত্তর দিলেন। সবাই ওকে মারিয়াম বলে ডাকছিল। খুবই ব্যস্ত। কর্পোরেট হাসপাতালে এধরনের কাজে যুক্ত সিস্টাররা *ফ্লোর ইনচার্জ* হিসাবে পরিচিত। বললেন, একটু দাঁড়ান, আমি আসছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ বলে আমি অপেক্ষা করছি। ফিরে এসে বললেন, হ্যাঁ, বলুন। বললাম, দুটো কথা আছে। একটা কাজের, একটা নিতান্তই ব্যক্তিগত। কয়েক দিনের যাতায়াতে আমার পরিচয়টা ওর কিছুটা জানা। প্রথমে কাজের কথাটা বলে নিই। আমার এক ঘনিষ্ঠ জনের হার্টের বাইপাস সার্জারি হবার জন্য ভর্তি হয়েছেন ১০ দিন হয়ে গেল। প্রতিদিনই তাঁর ব্লাড, ইউরিন টেস্ট হচ্ছে।রোজই সন্ধ্যায় দেখছি একই রিপোর্ট, ওর কি সেপ্টিসেমিয়া হয়েছে, নাকি কিডনি অকেজো হয়েছে? তাহলে প্রতিদিন টেষ্ট করছেন কেন? তাছাড়া আপনাদের প্যাকেজ অনুসারে ওর তো অপারেশন হয়ে বাড়ি চলে যাবার কথা। আসাম থেকে কমরেড এসেছেন, কলকাতার অত্যন্ত নামী হাসপাতালে দামী চিকিৎসকের আন্ডারে ভর্তি হয়েছেন।বাইপাস সার্জারির রিপোর্ট তো বলছে গ্লোবাল ব্লক। জরুরি অপারেশন করতে হবে। রোজই নখ কাটছে, দাড়ি কাটছে। ভাবখানা এমন যেন এখুনি অপারেশন হবে। এর কারণটা জানতে চাইছিলাম। অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় মারিয়াম বললেন, খোঁজ নিচ্ছি, আধ ঘণ্টা পরে জানিয়ে দেব। আমি চলে আসার উদ্যোগ নিতেই বললেন, আর একটা ব্যক্তিগত কথা কি বলবেন বলছিলেন না। রাগ করবেন না, বলুন। এবার ঐ অব্যক্ত বেদনার কাহিনী নিয়ে কথা শুরু হল। আচ্ছা, আজ সকাল ৭-১০ মিনিটে আপনার সঙ্গে আমার গুড মর্ণিং বিনিময় হলো, আর এখন বাজে সন্ধ্যা ৭-২৫/২৭। আপনাদের ডিউটি আওয়ার্স কতক্ষণ? মারিয়াম এমনিতেই নীচু স্বরে কথা বলেন, হঠাৎ গলার স্বর আরও নীচু হয়ে গেল, কিছুটা বাকরুদ্ধ হলে যেমন হয়। বললেন, এর কোনো সময়সীমা নেই। আমাদের নিয়ে আসার জন্য সকাল ৬-৩০ টায় মধ্যে হাসপাতালের বাস চলে আসে। ৫ মিনিট দেরি হলেই বাস ছেড়ে চলে যাবে। সকাল ৬-৪৫/৫০ মিনিটে রিপোর্টিং, সকাল ৭ টায় জয়েনিং। আর বিকাল বেলা ফিরিয়ে নিয়ে যাবার বাস প্রতিদিন দেরিতে আসবে। বাস না আসলে পরের ব্যাচকে চার্জ হ্যান্ড ওভার না করে তো যাওয়া যাবে না। মারিয়াম কেরলের মেয়ে। যত বলছিলেন তত গলার স্বর নীচে নামছিল। জিজ্ঞেস করলাম, কেন আপনাদের এ্যাসোসিয়েশন বা ইউনিয়ন নেই? বললেন, একবার আমরা চেষ্টা করেছিলাম, কিছুটা জানাজানি হতেই চাকুরি থেকে বরখাস্ত করার হুমকি এসেছিল। বন্ডেড লেবার তো আমরা। আমরা কেরলের জনা ৫০/৫২, ওড়িশার ১৪/১৫, উত্তর পূর্বাঞ্চলের ৮/১০ জন। সবাই অবশ্য একই স্টেজে নেই। কেউ কেউ ট্রেনি। যেমন আপনাদের ইন্টার্নশিপ। ওরা চলে যেতে চায়। কেউ কেউ চলে গেছেন, যেমন মনিপুরের বোনেরা। সব মিলিয়ে ১৮৫ জন। ত্রাহি ত্রাহি রব। কেউ কেউ ভয় দেখাচ্ছেন, “বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের” অমুক ধারা, তমুক ধারা প্রয়োগ করা হোক, কেউ কেউ‌ নীতি আদর্শের কথা তুলছেন, “চিপ পলিটিক্স"। রোজই এরা টিভির পর্দায় নীতি আদর্শের জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেন। আমরা শুনি ও তারিফ করি!

কোনো নীতিআদর্শবান কর্মকর্তা বা চিকিৎসক বন্ধু কি ওদের সাথে কথা বলেছেন একবারও। কেন ওরা এই নিম্ন আয়ের মজুরি দাসত্ব থেকে মুক্তি চায়। একবারও কেউ কি আবাসন নামের যে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ওদের থাকতে হয়, দেখে এসেছেন? সময় কোথায়? ততক্ষণে দুটো এ্যঞ্জিওপ্লাস্টি হয়ে যাবে ? বিজ্ঞাপনে থাকবে ৮-১০ হাজার টাকায় সুলভ চিকিৎসা! বাড়ি ফেরার সময় ৯০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা। নীতিবানরা একবারও কেউ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কে জিজ্ঞেস করেছেন এত ফারাক কেন?

nur

 

মারিয়াম খুব অস্হির হয়ে উঠলেন, “আপনার কাজের কথায় কোনো খোঁজ নেওয়া হলো না”! এবার আমার মুখের রং-টা আরেকটু কালো হলো। সত্যিই তো কোনটা কাজের কথা! মারিয়াম দের প্রতিদিনের জীবন কিভাবে কাটে সেটা জানাটা কাজের কথা নয়? আমি একটু লজ্জায় পড়ে বললাম, ঠিক ‌আছে, অপারেশনে জটিলতা ঠিক কোথায়, আগামীকাল বললেও চলবে। মারিয়ামের উত্তর, “তাতো কাজে অবহেলা হয়ে যাবে” ! একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসছি। গল্প করে অনেকটা সময় চলে গেছে। তাছাড়া আমার তো ডিউটি শেষ হয়ে গেছে। ফেরার পথে একবার নীচে গিয়ে খোঁজ নিয়ে বলব। কাল আবার দেখা হবে। দুজন থাকলে কফি খাওয়াব। দুজনের বেশি গেষ্টকে কফি খাওয়ানোর অনুমতি নেই। মারিয়াম খোঁজ দিয়ে ফেরার বাসে উঠে পড়লো, শুধু বলে গেল অনেক বড় যুদ্ধ করতে হবে।

এবার সেই প্যাকেজের গল্প। কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানলাম, “রেড চাকতি” আসেনি। আপনার পেশেন্টের আবার এঞ্জিওগ্রাম করতে হবে, ২৫০০০ টাকা দ্রুত জমা দিন। একটু উত্তেজিত ভাবে বলেছিলাম, আমার পকেটে সাড়ে পাঁচ টাকা আছে। আচ্ছা, বলুন তো নতুন করে এঞ্জিওগ্রাম করার এ্যাডভাইসটা কে করেছেন? কেন? ডাক্তারবাবু। তিনিও একজন নামী ডাক্তার। ডঃ দেবী শেঠি। সত্যিই তিনি করতে বলেছেন? আর ইউ সিওর? কতবার। এক কথা বলব, উত্তর ভেসে এলো। ও তাই। ঠিক আছে ডঃ শেঠির সাথে একটু বলে টাকাটা জমা দিয়ে দেব। রাত তখন ১২-১০ ডঃ দেবি শেঠি অপারেশন থিয়েটার থেকে নেমে এমার্জেন্সি আউট ডোরে ঢুকালেন। আমার ছোট্ট একটা জিজ্ঞাসা ছিল, কার্ডিও থোরাসিক সার্জেন এঞ্জিওগ্রাম প্রেসক্রাইব করেছেন কিনা? ডঃ শেঠি নম্রভাবেই একটু অপেক্ষা করতে বললেন। একজন মা তাঁর এক ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে অপেক্ষা করছেন, বাচ্চাটার হার্টের ৪টি ভালভই খারাপ। ফ্যালট’স টেট্রোলজি। তিনি আবার ট্যাক্সি করে হাওড়া ফিরবেন। তাঁর দেখানো শেষ হতেই, চেম্বারে আমার প্রবেশ। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্কে প্রশ্ন। আপনি আমার পেশেন্টের আবার এঞ্জিওগ্রাম করতে বলেছেন। প্রেসক্রিপশন কোথায়? আমি! আমি বলেছি এঞ্জিওগ্রাম করার কথা? “এ হাসপাতাল ছেড়ে না দিলে মান ইজ্জত কিছুই থাকবে না”। বিড়লা কর্পোরেট হাউস পরিচালিত ক্যালকাটা হার্টের কথা বলছি।

তারপর সিস্টেম ম্যানেজার, ফ্লোর ম্যানেজার হয়ে ফাইন্যান্স অফিসার হয়ে যুদ্ধ থামলো। পরের দিন সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে অপারেশন শুরু হলো। পেশেন্ট এখন সুস্থ। দায় দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন।

নির্মলা সীতারামনের প্যাকেজের গল্প শুনতে শুনতে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিক যেমন ক্লান্ত, বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। মারিয়মরাও তেমনই আ‌স্থাহীন ও বিরক্ত। ওরাও তো নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে লেখা পড়া শিখে নার্সিং কাজে দুবাই বা সিঙ্গাপুর চলে যায়, কেউবা বাংলা, ব্যাঙ্গালুরু বা দিল্লীতে। কারও থেকে ওদের নীতি আদর্শ দায়িত্ববোধ কম নয়। ওরা রাত জাগে আর্ত রোগীর বেডের পাশে দাঁড়িয়ে। ওরা লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প। কখনো ঐ ঝাড়ুদার, সাফাই কর্মী, ঐ অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার, প্যাথ ল্যাবের বন্ধুদের সাথে কথা বলেছেন কোভিড ১৯ মোকাবিলায় তাঁদের কি মতামত ও অভিজ্ঞতা হলো? এঁদের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা ছাড়া করোনা মোকাবিলা মুখ থুবড়ে পড়বে। কথা বলুন, মতামত নিন। কারো থেকে ওদের নীতি আদর্শ কম নয়। হুমকি দিয়ে, ভয় দেখিয়ে, গালাগালি দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলবেন না।

-- পার্থ ঘোষ

খণ্ড-27