ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দেওয়া হল বিজেপি ঘনিষ্ঠ প্রতারকদের অপরিশোধিত ঋণ

h17

সম্প্রতি আবার খবরের শিরোনাম হল নীরব মোদী, মেহুল চোক্সী, বিজয় মাল্যরা। এরা হল সেই বিজেপি ঘনিষ্ঠ হীরে ব্যবসায়ী, সুসময়ের সম্রাটরা যারা জালিয়াতির মাধ্যমে ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলোর টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়েছে, বা যেমন বলা হয়ে থাকে, তাদের পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক তাদের খাতা থেকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ৬৮,৬০৭ কোটি টাকার অপরিশোধিত ঋণ মুছে দিয়েছে। ব্যাঙ্কের খাতায় থাকা অনুৎপাদক সম্পদের (এনপিএ) পরিমাণ থেকে ঋণ মুছে দেওয়ার এই কথাটা সরকার নিজে থেকে প্রকাশ করেনি। তথ্য জানার অধিকার আইনের আশ্রয় নিয়ে সকেত গোখলে নামে জনৈক ব্যক্তি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে আবেদন জানালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানায়, ২০১৯-২০ অর্থ বর্ষের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক কর্তৃক তাদের হিসাবের খাতা থেকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের মুছে দেওয়া ঋণের পরিমাণ হল ৬৮,৬০৭ কোটি টাকা। সেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের একটা তালিকাও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দেয়। মুছে দেওয়া ঋণের পরিমাণ বেশি, তালিকায় থাকা এমন কয়েক জনের উল্লেখ এখানে করা হচ্ছে কোম্পানির নাম ও মুছে দেওয়া ঋণের পরিমাণ

১। মেহুল চোক্সীর গীতাঞ্জলি জেমস ৫৪৯২ কোটি
২। সন্দীপ ঝুনঝুনওয়ালা ও সঞ্জয় ঝুনঝুনওয়ালার আরইআই এগ্র, ৪৩১৪ কোটি টাকা
৩। যতীন মেহেতার উইনসাম ডায়মণ্ড অ্যাণ্ড জুয়েলারি, ৪০৭৬ কোটি টাকা
৪। বিক্রম কোঠারির পান পরাগ খ্যাত রোটোম্যাক গ্লোবাল প্রাঃ লিঃ, ২৮৫০ কোটি টাকা
৫। বিজয় মাল্যর কিংফিশার এয়ারলাইনস, ১৯৪৩ কোটি টাকা
৬। জিলি ইন্ডিয়া (মেহুল চোক্সিদের) ১৪৪৭ কোটি
৭। নক্ষত্র ব্র্যাণ্ডস (মেহুল চোক্সীদের) ১১০৯ কোটি

ব্যাঙ্কের টাকা লুট করে পালিয়ে যাওয়ার আরও একটা আখ্যানের উন্মোচন ঘটেছে অতি সম্প্রতি। বাসমতি চাল রপ্তানির কারবার ছিল রামদেব ইন্টারন্যাশান্যাল-এর। এসবিআই, কানাড়া ব্যাঙ্ক, ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া, আইডিবিআই, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া এবং কর্পোরেশন ব্যাঙ্ক -- এই ছটা ব্যাঙ্ক থেকে ৪১৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে শোধ না করে দুবাই পালিয়ে গেছে কোম্পানির ডিরেক্টর সুরেশ কুমার, নরেশ কুমার ও সঙ্গীতা। পালানোর আগে ওরা এদেশে থাকা ওদের প্রায় সমস্ত সম্পত্তিই বিক্রি করে দেয়। তারা যে নেই সে কথা জানা যায় ২০১৬ সালেই। এ সত্ত্বেও সিবিআই-এর কাছে এসবিআই অভিযোগ জানায় এ বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারী। আর, সিবিআই পলাতক ডিরেক্টরদের বিরুদ্ধে এফআইআর করে ২৮ এপ্রিল। ঋণ গ্ৰহিতাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এ কথা জানার পর তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে এসবিআই-এর লেগে গেল চার চারটে বছর! একটু অনুসন্ধান চালালে পলাতক ডিরেক্টরদের সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের সংযোগ খুঁজে পাওয়াটা বোধকরি অসম্ভব হবে না।

এই অপরিশোধিত ঋণ এনপিএ-র হিসাব থেকে মুছে দেওয়া প্রসঙ্গে বিরোধী দল কংগ্ৰেস বলেছে যে, মোদী জমানার প্রথম পাঁচ বছরে মুছে দেওয়া ঋণের পরিমাণ ৬.৬৬ লক্ষ কোটি টাকা। এবং এই পরিসংখ্যান নিয়ে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ বা বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়নি। এই সুবিশাল পরিমাণ ঋণ অপরিশোধিত থাকায় ব্যাঙ্কগুলোর এনপিএ বা অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে, যার ভারে ব্যাঙ্কগুলো নুয়ে পড়ছে এবং আর্থিক ক্ষেত্রের কর্মকাণ্ডও ধাক্কা খাচ্ছে। বিরোধী নেতারা আরও বলছেন, যারা পলাতক, জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাঙ্কগুলোকে যারা প্রতারিত করেছে তাদের ক্ষেত্রে এনপিএ-র ভার কমানোর নামে ঋণকে মুছে দেওয়াটা সঠিক পদক্ষেপ নয়। অপরিশোধিত ঋণ হিসাবে ব্যাঙ্কের খাতায় দেখিয়ে যাওয়াটাই যথাযথ হবে। আর অপরিশোধিত ঋণের জমে পাহাড় হওয়ার পিছনে যে সরকার-ব্যাবসা গাঁটছড়া তথা দোসর শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারের প্রত্যক্ষ মদতের অবদান যথেষ্ট রয়েছে তা নিয়ে এখন বোধকরি আর কেউ প্রশ্ন তুলবেন না।

ঋণ শোধ না করা ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের মদত দেওয়ার অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠায় মোদী মন্ত্রীসভার সদস্যরা, বিজেপি নেতারা সেই বরাবরের যুক্তিই দিচ্ছেন যে, এনপিএ-র পরিমাণ থেকে অপরিশোধিত ঋণ মুছে দেওয়ার অর্থ ঋণ মুকুব করা নয়। এর পরও ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিন্তু অপরিশোধিত ঋণ একবার মুছে দিলে সেই ঋণ আবার আদায় করার আগ্ৰহ কতটা থাকে এবং কতটাই বা সম্ভব হয়? যে ৬.৬৬ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ পাঁচ বছরে মুছে দেওয়া হয়েছে তার অন্তত কিছু পরিমাণেরও আদায় যে হয়েছে তার কোনো নজির সরকার কিন্তু হাজির করতে পারছে না। এছাড়া আরও যুক্তি দেওয়া হয় যে, অপরিশোধিত ঋণের জন্য ব্যালান্স শিটে সংস্থান করার পরই ব্যাঙ্ক ঋণ মুছে এনপিএ-র পরিমাণকে কমানোর পথে যায়। সে ক্ষেত্রেও তো ব্যাঙ্কের লাভের পরিমাণ কমে যায় এবং ব্যালান্স শিটের ওপর চাপ বাড়ে। ব্যাঙ্কের কার্যকলাপকে সচল রাখা এবং ঋণের আবেদনকারীদের ঋণ পাওয়াকে অব্যাহত রাখার জন্য সরকার ২০১৫ সাল থেকে ব্যাঙ্কগুলোতে ২.৫ লক্ষ কোটি টাকা ঢেলেছে, আর এর সবটাই সাধারণ জনগণের টাকা। ব্যাঙ্কের হিসাবনিকাশ পরিষ্কার করতে ঋণকে মুছে দিয়ে এনপিএ-র ভার কমানোর এই পদক্ষেপ আসলে ব্যাঙ্ক থেকে আপনার-আমার, সাধারণ জনগণের টাকাকেই সাফ করে দেওয়া।

অপরিশোধিত ঋণ তথা এনপিএ-র সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠার পিছনে ক্রোনি পরিঘটনা তথা সরকার-ব্যবসায়ী গাঁটছড়ার অবদানের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই ক্রোনি পরিঘটনা আসলে শাসক দল ও কর্পোরেটদের পরস্পরকে মদত যোগানো, পরস্পরের মধ্যে লেনদেন-এর সম্পাদন। শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দলগুলোকে, বিশেষভাবে শাসক দলকে টাকা দেয়, আর শাসক দলও তার বিনিময়ে তাদের ভালো রকম সুবিধা পাইয়ে দেয়। অর্থ প্রদানের মধ্যে দিয়ে শাসকদের সঙ্গে অর্জন করা ঘনিষ্ঠতা শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে গৃহীত ঋণ পরিশোধ না করা সম্পর্কে এক প্রত্যয়ের জন্ম দেয়। তারা মনে করে, ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণ শোধ না করলেও তাদের শাস্তির মুখে তো পড়তেই হবে না, বরং বিপদ থেকে তাদের উদ্ধারের ব্যবস্থাও হবে। বিজেপি ঘনিষ্ঠ বিজয় মাল্য, নীরব মোদী, মেহুল চোক্সীদের বিদেশে পালিয়ে যেতে দেওয়ার অভিযোগের মধ্যে দিয়ে যে বিষয়টির বিশ্বাসযোগ্যতা জোরালো হচ্ছে। কংগ্ৰেসের বিরুদ্ধে শিল্পপতি-ব্যবসায়ী সখ্যতার অভিযোগ জোরালোভাবেই উঠেছিল, আর আজ বিজেপি যেন এই ক্রোনি পরিঘটনা লালনপালনের সাক্ষাৎ প্রতিভূ হয়ে উঠেছে। কর্পোরেটদের সঙ্গে আঁতাতবদ্ধ হওয়াকে, তাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়াকে ওরা একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপও দিয়েছে, যার নাম হল ইলেক্টোরাল বণ্ড। ইলেক্টোরাল বণ্ড যে ভারতীয় নির্বাচনে কালো টাকার খেলাকে জোরালো করে তুলবে, সে সম্পর্কে আরবিআই ও নির্বাচন কমিশন সতর্ক করা সত্ত্বেও মোদী সরকার ভারতের জনগণের কাছে সে কথা গোপন করে, সংসদের কাছে এ সম্পর্কে মিথ্যাচার করে এবং বণ্ড প্রকল্প চালু করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এই বণ্ড প্রকল্প অর্থদাতা ও প্রাপকের পরিচয় ভারতীয় জনগণের কাছে গোপন রাখে, নির্বাচনে অর্থ জোগানকে সম্পূর্ণ রূপে অস্বচ্ছ করে তোলে এবং কর্পোরেট ও বিদেশী সংস্থার গোপন অর্থ জোগানকে মসৃণ করে। এই পথে দুর্নীতিও সুগম হয়। ইলেক্টোরাল বণ্ডের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে কালো টাকা, শেল কোম্পানিগুলোর টাকা পৌঁছানোর প্রশস্ত পথকে বিজেপির দুয়োরের দিকেই এগিয়ে যেতে দেখা গেছে। কেননা, ইলেক্টোরাল বণ্ডের মধ্যে দিয়ে প্রাপ্য টাকার ৯৫ শতাংশেরই লাভবান সে হয়েছে। অপরিশোধিত কর্পোরেট ঋণের মাত্রা যদি ক্রমবর্ধমান হতে থাকে তবে তার পিছনে রাজনীতি-কর্পোরেট গাঁটছড়ার ভূমিকা অবিসংবাদী হয়েই দেখা দিচ্ছ। মোদী জমানায় অপরিশোধিত ঋণ তথা এনপিএ ফুলে ফেঁপে উঠেছে শুধু তাই নয়, ব্যাঙ্কের টাকা মেরে দিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়াকেও প্রতারকরা একটা জলভাত ব্যাপার করে তুলেছেন। ফলত, “না খায়ুঙ্গা, না খানে দুঙ্গা” মার্কা জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম তার অপরূপ শোভা নিয়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

খণ্ড-27