করোনা যখন ফ্যাসিবাদীদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে ওঠে
koto

 

অবশেষে, করোনা অতিমারী মোদীর কাছে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ালো। শুধু মোদী নয়, দেখা যাচ্ছে বিশ্ব জুড়েই মোদীর মতো অতি দক্ষিণপন্থী শাসকদের কাছে আজকের এই মারাত্বক সংকট তাদের ফ্যাসিবাদী, স্বৈরাচারী শাসনকে সংহত করতে যেন বাড়তি শক্তি যুগিয়েছে। প্রায় সব জায়গায় ক্ষমতাসীন শাসক এই অতিমারিকে মোকাবিলা করতে নিজেই চলে এসেছে কেন্দ্রবিন্দুতে, বিরোধীদের “কোয়ারান্টিনে” পাঠিয়ে। করোনার মোকাবিলায় সোশ্যাল ডিস্টান্সিং, লকডাউন প্রকাশ্যে জনপরিসরকে একেবারেই সংকুচিত করার এক দারুণ হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

করোনাকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্র সর্বপ্রথম কারখানা আইন, ১৯৪৮-কে সংশোধিত করে বর্তমানে ৮ ঘণ্টার শ্রমদিবসকে ১২ ঘণ্টায় নিয়ে (৬ দিনের সপ্তাহে ৭২ ঘণ্টা) যাওয়ার প্রস্তাব হাজির করে। “খুবই ব্যতিক্রমী পরিস্থিতে ব্যতিক্রমী পদক্ষেপের” প্রয়োজনীয়তা থেকেই এই প্রস্তাব গ্রহণের কথা বলা হচ্ছে। ফ্যাক্টরিস্ অ্যাক্ট, ১৯৪৮-র ৫নং ধারায় বলা আছে যে “পাব্লিক এমারজেন্সি”র সময় সংশ্লিষ্ট সরকার এই ধারাটি সংশোধন করতে পারে। আর, “পাব্লিক এমারজেন্সির” সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ‘গ্রেভ’ বা গুরুতর আপৎকালীন পরিস্থিতি, যেমন, ভারতের নিরাপত্তা অথবা তার সীমানার কোনো এক অংশ যখন বিরাট বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে, যুদ্ধ, বহিঃশত্রুর দ্বারা আগ্রাসন অথবা বড় ধরনের আভ্যন্তরীণ গোলযোগ দেখা দিলে সেটাকে পাব্লিক এমারজেন্সি হিসাবে গণ্য করা হবে। কিন্তু মহামারী বা অতিমারীকে এই সংজ্ঞার আওতায় রাখা হয়নি। তা সত্ত্বেও, কেন্দ্র এবং কিছু রাজ্য সরকার এই সুযোগে শ্রমিক বিরোধী কানুন আনার জন্য কোমর বেঁধেছে ।

মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও একই মর্মে আইন সংশোধন করেছে। বিধিবদ্ধ শ্রম সময়ের অতিরিক্ত শ্রম দিলে ওভারটাইম হিসাবে তা গণ্য হয়, আর সেক্ষেত্রে দ্বিগুণ মজুরি আইনগত ভাবে প্রাপ্ত। কিন্তু, গুজরাট সরকার এক্ষেত্রে সেটাও দেবে না। যেহেতু শ্রম ক্ষেত্রটি সংবিধানের যুগ্ম তালিকায়, তাই রাজ্য সরকারগুলোকে দিয়ে এইভাবে আইনটার সংশোধন করে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বহু রক্তঝরা পথে আট ঘণ্টা শ্রম দিবসের অর্জিত অধিকার। আবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের তহবিল থেকে ৪৮০০ কোটি টাকা প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনায় স্থানান্তরিত করার প্রস্তাব আসছে। একই ভাবে ইএসআই-এর তহবিল থেকে বেশ কিছু পরিমাণ টাকা এমন সব খাতে বিনিয়োগ করার কথা ভাবা হচ্ছে যার সাথে ইএসআই-এর সুযোগ সুবিধার কোনো সম্পর্ক নেই। সারা দুনিয়া জুড়ে করোনা অতিমারীর পরিস্থিতে বিভিন্ন দেশে দুর্বল হয়ে পড়া সামাজিক সুরক্ষার রক্ষাকবচগুলোকে যখন আবার মজবুত করার প্রবণতা শুরু হয়েছে, তখন মোদী সরকার নিজের পুরনো অ্যাজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যে, গুজরাট চ্যাম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের তরফ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম দপ্তরের কাছে এক আবেদন জানানো হয়েছে। সেখানে বনিক সভা-টি বলেছে, ২০২০-২১-এর আর্থিক বছরে কর্মী ইউনিয়ন গঠন করার যে অধিকার শ্রম বিরোধ আইনে দেওয়া হয়েছে, তা প্রত্যাহার করা হোক। অর্থাৎ, ইউনিয়ন গঠন করার এই মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারটিকে করোনার অজুহাতে হরণ করার দাবি সামনে এসেছে। ইতিমধ্যে, কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারিদের মহার্ঘ ভাতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত আগামী দেড় বছর স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। যেহেতু ডিএ মজুরির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তাই ডিএ-তে হাত পড়ার অর্থ মজুরির উপর আক্রমণ। এর ফলে নিজ পাওনা থেকে বঞ্চিত হবেন প্রায় ৪৮.৩৪ লক্ষ কর্মচারি এবং ৬৫.২৬ লক্ষ পেনশনভোগী। এখন আবার কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের মজুরি নরেগার মজুরি অর্থাৎ ২০২ টাকায় বেঁধে দেওয়ার জোরালো প্রস্তাব সামনে আসতে শুরু করেছে।

migrant

 

করোনাকে মোকাবিলা করাটা মোদী এক যুদ্ধ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। যুদ্ধে একজন প্রধান সেনাপতি থাকেন, আর বলাই বাহুল্য তিনিই সেই ভূমিকায় দেশকে সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যুদ্ধের সময় প্রশ্ন, বিতর্ক করা যায় না। তাই লকডাউনের যাবতীয় যন্ত্রণা যাদের উপর চেপে বসেছে সেই পরিযায়ী শ্রমিকদের ১৪ এপ্রিলের ভাষণে তিনি শৃঙ্খলাবদ্ধ সেনানীর মতো আচরণ করতে বলেছেন, ঠিক যেভাবে কালো টাকা উদ্ধারের যন্ত্রণাকে সইতে নোটবন্দীকে মেনে নিতে বলা হয়। স্বাস্থ্য কর্মীদের ও তিনি “জাতির প্রহরী” এবং “করোনা যোদ্ধা” হিসাবে বর্ণনা করেন। যুদ্ধে সকলকেই অসীম কষ্ট সহ্য করতে হয়, যা মেনে নিতে হয় মুখ বুজে। তাই, কর্মক্ষেত্রের বিপন্নতা বা ঝুঁকি যেমন বর্মবস্ত্র বা মাস্ক না থাকলেও ডাক্তার-নার্সদের তা নিয়ে হৈচৈ করা অনুচিত। বেশ কয়েকটি রাজ্যে স্বাস্থ্য কর্মী এমনকি ডাক্তারদের উপর ও হামলা এ কারণেই হয়েছে।

যুদ্ধ করতে হয় এক বাইরের শত্রুর সঙ্গে। আর এই যুদ্ধে তাই ট্রাম্প যেমন চীন দেশ, চিনা ও এশিয়ানদের দাগিয়েছেন, আমেরিকার এই বিধ্বস্ত অবস্থার পেছনে ‘চিনা ভাইরাস’ কে দায়ী করেছেন, মোদী ও তার দলবল এ প্রশ্নে চিহ্নিত করেছে সংখ্যালঘুদের। ভাইরাসের তল্পিতল্পা নিয়ে যারা দেশে করোনা জিহাদ ঘোষণা করে দেশময় ছড়িয়েছে। আর, যুদ্ধে বৈধ গণতান্ত্রিক অধিকারের সৌখিনতা চলে না। তাই, এই সংকটাপন্ন আবহে আবার ছাত্র নেতা নেত্রী, মানবাধিকার আন্দোলনের সাথে যুক্ত প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার করা হয়। শীর্ষ আদালতও জানিয়ে দেয় যে এই সময়ে সরকারের সিদ্ধান্তকে আদালত বিরোধিতা করবে না।

দুনিয়া জুড়েই স্বৈরশাসকেরা এই অতিমারিকে কাজে লাগাচ্ছে নিজেদের শাসনকে সংহত করার জন্য। ইজ্রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর হাজতে থাকার কথা ছিল, বিরাট মাপের এক দুর্নীতির কারণে। কিন্তু এই করোনাই তাকে উদ্ধার করলো। বিশেষ পরিস্থিতির দোহাই তুলে এই সময়ে সমস্ত আদালতকে তিনি বন্ধ করে দেন, নাগরিকদের উপর কড়া নজরদারি রাখার আদেশ দিয়েছেন আর কোয়ারান্টাইন ভাঙ্গার অপরাধে যে কোন নাগরিককে ছ’মাসের জন্য কারারুদ্ধ করা যাবে।

ইউরোপ, আমেরিকা সহ অনেক দেশেই প্রধান বিরোধী দলগুলো করোনার সংকটে সমস্ত রাজনৈতিক বিরোধকে পেছনে সরিয়ে শাসক দলকে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

হাঙ্গেরির স্বৈরশাসক ভিক্টার ওরবানকে দেশের সংসদ অনির্দিষ্টকালের জন্য ডিক্রি জারি করে শাসন করার পূর্ণ অধিকার দিল। মিথ্যা সংবাদ বা বিকৃত খবর পরিবেশন করার অপরাধে যে কোনো সাংবাদিককে পাঁচ বছর জেলে পুরে রাখার অধিকার তাঁকে দেওয়া হলো। ফিলিপাইন্সের রাষ্ট্রপতি রড্রিগো দ্যুতার্তেকে তাঁর দেশের আইনসভা আপৎকালীন প্রচুর ক্ষমতা দিয়েছে, যে আইনসভায় তাঁর একচ্ছত্র প্রাধান্য রয়েছে। তিনি দেশের বামপন্থীদের সাথে সমস্ত দ্বৈরথের ‘অবসান’ ঘটিয়েছেন করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। একই সঙ্গে কোয়ারান্টাইন কারফিউ লঙ্ঘন করার অপরাধে দেখা মাত্র গুলি চালানোর অধিকার আদায় করে নিয়েছেন।

চিলিতে তো সেনাবাহিনী এখন রাস্তার দখল নিয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনকারীরা লাগাতার সরকার বিরোধী বিক্ষোভে রাজপথ কাঁপিয়েছিল, তাঁদের আর কোনো ধরনের প্রকাশ্য বিক্ষোভের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না, করোনার কারণে। বলিভিয়াতে সেনাবাহিনীর মদতে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার পর নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি দেয় শাসক বর্গ। এখন করোনার অজুহাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য তা স্থগিত করা হয়েছে। ৩১ জানুয়ারী ইতালিতে প্রথম দু’জনের মধ্যে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়। এই ঘটনার পরই দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এতো করেও ঠেকানো গেলনা ইতালিতে করোনার সর্বনাশা থাবা। দেখা গেল, জরুরি অবস্থা আটকাতে পারলো না ইতালির সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী অঞ্চল লোমবার্ডিতে ব্যাপক সংক্রমণ। ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রর হাতে এখন অধিকার রয়েছে নাগরিকদের আটক রাখা, সীমানাকে বন্ধ করার। করোনা অতিমারি আবির্ভাবের আগে দেশে দেশে ক্ষমতাসীন শাসকদের বিরুদ্ধে বড় বড় বিক্ষোভ, আন্দোলনের এক বহুবর্ণ সংগ্রামের চিত্রপট রচিত হয়েছিল। কিন্তু করোনার হামলা সব কিছুকে তছনছ করে দিল। নিভৃতবাস, লকডাউনের বাধ্যতামূলক পরিস্থিতি হরণ করেছে প্রকাশ্য আন্দোলনের সমস্ত পরিসর।

কিন্তু এর মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে উঠে আসছে প্রতিবাদ জানানোর নতুন নতুন রূপ ও পদ্ধতি। লকডাউনের নিয়ম বিধিকে মেনে প্রকাশ্যে বা ঘরের অভ্যন্তরে আমাদের পার্টি ও বামপন্থীরা নিজেদের প্রাসঙ্গিকতাকে বজায় রাখতে বেশ কিছু কর্মসূচি নিচ্ছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের মতো প্রোটেস্ট ফ্রম হোম এখনকার নতুন প্রতিবাদের ভাষা। দেখা যাচ্ছে, এটাকেও বরদাস্ত করা হচ্ছে না। তামিলনাড়ু, উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় ঘরের মধ্যে অনশন করার জন্য পুলিশী হেনস্থা, এমনকি গ্রেপ্তার ও করা হয়েছে।

করোনা ফ্যাসিস্ট শাসকদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াই এবার ক্রমে ক্রমেই ক্ষুধার বিরুদ্ধে ব্যাপক মানুষকে নিয়ে আরও বড় এক গণজাগরণের অপেক্ষায় দিন গুনছে।

খণ্ড-27