বিশিষ্ট কথাকার ও চিন্তাবিদ দেবেশ রায়ের প্রয়াণে শ্রদ্ধার্ঘ্য
Debesh Roy

একই দিনে চলে গেলেন দুই বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের দুই স্তম্ভ। বাংলাদেশের আনিসুজ্জামান এবং এই বাংলার দেবেশ রায়। দুজনেই ছিলেন চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী। এমন ধরনের লেখক যাঁদের লেখার মূল ভিত্তি গবেষণা ও অনুসন্ধিৎসা।

আনিসুজ্জামানের মতো দেবেশ রায়ও ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ও অধ্যাপক। সৃজনশীল কথাসাহিত্য ও মননশীল গবেষণা কর্মকে মেলানোর এক বিস্ময়কর দক্ষতা পাওয়া যায় তাঁর লেখালেখির মধ্যে।

দেবেশ রায় ঊনিশ শতকের বাংলা সাংবাদিক গদ্য বা রবীন্দ্রনাথের আদি গদ্য নিয়ে যে বইগুলি লিখেছেন সেগুলিই যে শুধু পূর্ণাঙ্গ গবেষণা গ্রন্থ তা নয়। তাঁর যে কথাসাহিত্যের জগত, সেটিও ব্যাপক গবেষণা কর্মের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়ে উঠত। এর প্রমাণ রয়েছে তাঁর তিস্তাপারের বৃত্তান্ত বা বরিশালের যোগেন মণ্ডলের মতো মহাকাব্যিক রচনাগুলিতে।

উপন্যাস প্রকরণটি নিয়ে তিনি ভেবেছেন গভীরভাবে। এর ছাপ রয়েছে “উপন্যাস নিয়ে” বা “উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে”র মতো বইগুলিতে। এ কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস তাত্ত্বিক রুশ লেখক মিখাইল বাখতিনের উপন্যাস ভাবনা নিয়ে যাঁরা বাংলায় আলোকসম্পাতি লেখা লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে দেবেশ রায় অগ্রগণ্য।

বহুস্বর বা পলিফনি এবং নানামাত্রিক সংলাপের বিনিময় বা ডায়ালজিক বৈশিষ্ট্য কীভাবে উপন্যাসের আত্মা নির্মাণ করে, তার ব্যাখ্যা সূত্র হাজির করতে করতে দেবেশ রায় আধুনিক সময় ও শিল্প সাহিত্যের মৌলিক নন্দনতত্ত্বকে বিশ্লেষণের জায়গায় চলে যান।

ছাত্রজীবন থেকেই বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষটি বরাবরই নীচুতলার মানুষের সংগ্রামকে ছুঁয়ে থেকেছেন জীবন ভাবনায়। না হলে তিস্তার ধারের বাঘারুদের এইরকম জীবন্ত রূপায়ণ সম্ভব হত না। বাঘারুদের চোখ দিয়ে উন্নয়নকে, তার শ্রেণি দৃষ্টিকোণটিকে প্রশ্ন করতে শেখান তিনি।

২০১০ সালে প্রকাশিত হল দেবেশ রায়ের সুবৃহৎ উপন্যাস “বরিশালের যোগেন মণ্ডল”। নিকট ইতিহাসকে অবলম্বন করে লেখা এই উপন্যাসের কালপর্ব মোটামুটিভাবে স্বাধীনতার আগের দুটি দশক। সময়টা একদিকে যেমন ঘটনাবহুল, তেমনি নানা বিতর্কের আধার। যোগেন মণ্ডল বাংলার রাজনীতি বা ইতিহাসের আলোচনায় মাঝে পরিণত হয়েছিলেন এক বিস্মৃত মানুষে। খুব সম্প্রতি তাকে নিয়ে নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে। আর সেই চর্চায় সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাধারার পাশাপাশি দেবেশ রায়ের এই উপন্যাসটির একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে।

দেবেশ রায় গোটা আখ্যান জুড়ে অনুপুঙ্খ বিস্তারে দেখাতে থাকেন যোগেন মণ্ডল বরিশালের মাটি থেকে উঠে এসে কীভাবে গোটা উপমহাদেশের রাজনীতিতে বড়সড় প্রভাব ফেলছেন। বিশেষত বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলন কীভাবে তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনের সময়ে তিনি রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন, তখন যোগেন মণ্ডলের বয়েস ৩৩। আইনসভায় প্রবেশের পর যোগেন্দ্রনাথ একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নেন। বিভিন্ন দলের (বা নির্দল) প্রতিনিধি হিসেবে মোট ৩১ জন তপশিলী প্রার্থী আইনসভায় বিজয়ী হয়ে এসেছিলেন। দল-নিরপেক্ষভাবে তপশিলী প্রতিনিধিদের একটি মঞ্চে যোগেন মণ্ডল সমন্বিত করেন। বিভিন্ন ইস্যুতে নিজেদের জাতের স্বার্থে যেন তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন - এটাই ছিল এই সমন্বয়ের মূল লক্ষ্য। তাঁর ঘোষণা ছিল নমঃশূদ্রদের স্বার্থে কাজ হলে তাঁরা সরকারকে রাখবেন, নচেৎ তার বিরুদ্ধে গিয়ে সরকার ফেলে দেবার চেষ্টা করবেন। দেবেশ রায় তাঁর উপন্যাসে দেখিয়েছেন বাংলার আইনসভায় নমঃশূদ্র ব্লকের এটাই ছিল প্রথম স্বাধীন আত্মঘোষণা।

দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপক্লিষ্ট সময়ের ছবি সাহিত্যে কীভাবে ধরা পড়েছে, তার পরিচয় আমাদের সামনে তুলে ধরেন সম্পাদক দেবেশ রায়। তাঁর সম্পাদিত এবং সাহিত্য অকাদেমী থেকে প্রকাশিত দু-খণ্ডের সংকলন গ্রন্থ “রক্তমণির হীরে”র একটি খণ্ডে রয়েছে বাংলা সাহিত্যের থেকে চয়ন, অন্যটি বাংলা ছাড়া বাকি ভারতের সাহিত্য থেকে চয়ন। দেবেশ রায়ের মূল্যবান ভূমিকা বিষয়টির অসামান্য প্রবেশক হিসেবে আমাদের সামনে থাকে। একই কথা বলা যায় দস্তয়েভস্কির “অপরাধ ও শাস্তি” উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ গ্রন্থটিতে তাঁর লেখা ভূমিকাটি প্রসঙ্গে।

দেবেশ রায় একই সঙ্গে ছিলেন সাহিত্যিক ও সাহিত্য চিন্তক। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হয়েছিল তাঁর সাহিত্যের পথচলা। অসুস্থ হবার আগে অবধি সেই সক্রিয়তা বজায় ছিল ছয় দশক ধরে। বাংলা সাহিত্যের মননশীল পাঠককে বারবার ফিরে যেতেই হবে তাঁর সৃজনের কাছে।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) লিবারেশন এর পক্ষ থেকে বিশিষ্ট সাহিত্যিক তথা চিন্তাবিদ দেবেশ রায়ের প্রয়াণে আমরা গভীর শোক ব্যক্ত করছি।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) লিবারেশন
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি
১৪/০৫/২০২০

খণ্ড-27