যথাস্থিতি ভাঙ্গবে কি?
h7

মোদী সরকার চতুর্থ দফা লক ডাউন ঘোষণার ইঙ্গিত দিল। লক ডাউনের মধ্যেই কিভাবে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ক্রমে ক্রমে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায় এবং তার জন্য কী কী ছাড় দেওয়া সম্ভব, শুরু হচ্ছে সেই ভাব বিনিময়। শাসকদের এই চৈতন্য প্রদর্শনের পেছনে মুখ্য কারণ দেশের অগণিত কোটি কোটি কোবিড-দূর্গত মানুষের বর্ণণাতীত বঞ্চনা-লাঞ্ছনা-যন্ত্রণার কথা ভাবা নয়, সেই মনোভাব থাকলে সদিচ্ছার অভাব হোত না; শাসকশ্রেণী বিপর্যয়কর ত্রুটির অকপট স্বীকারোক্তি, সংশোধন ও দুরাবস্থা পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি, দায়-দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে এতো অমানবিক প্রতারণা চালিয়ে আসত না।

poor

 

ভারতবর্ষে দারিদ্রসীমা মাপার মানদণ্ড কত লোককে রেশন কার্ড দেওয়া হয়েছে তা দিয়ে বিচার হতে পারে না। ওটা হচ্ছে সরকারী বরাদ্দের মতিগতি অনুযায়ী নিছক ‘কোটা’য় গরিবী স্বীকারের ধূর্তামি। প্রকৃত বাস্তবে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা জনসংখ্যার অস্তিত্ব প্রায় ৮৭ কোটি। দিনরাত সরকারি হুঁশিয়ারির ফোয়ারা ছোটানো হয়ে আসছে, করোনার বিপদ থেকে বাঁচতে ‘ঘরে থাকুন’, ‘নিভৃতবাসে থাকুন’; কিন্তু কত ব্যাপক শতাংশ মানুষের ‘ঘরের মতো ঘর’ বা ‘ঘরের মধ্যে ঘর’ নেই!! সমীক্ষা করলে দেশ উজার হয়ে যাবে। ‘নিভৃতবাসে’ থাকবে কি! ‘হা-ঘর’ অবস্থা ৮৪ কোটি মানুষের! মানুষের জীবন-জীবিকাকে ক্রমাগত কি নিদারুণ পরিণতিতে এনে ফেলা হচ্ছে তার পরিচয় মিলছে দেশজুড়েই। ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ গাইতে চাওয়াটা হবে নির্দয় রসিকতা। দিল্লীশ্বরদের শাসনের দৌলতে রাষ্ট্রের ভান্ডারে যুদ্ধাস্ত্রের মজুদ অঢেল, তবু কোবিড জর্জরিত অবস্থায়ও মোদী সরকার যুদ্ধবিমান কেনার বরাত থেকে সরে আসেনি। সরকারি গুদামে উপচে পড়ছে খাদ্যশস্য, সরকারি প্রচার মোতাবেক অন্তত ছয়মাস খাওয়ানোর সংস্থান রয়েছ। অথচ অন্যদিকে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে করে দেওয়া হয়েছে সাতকাহনযুক্ত ঝাঁঝড়া, বলি দেওয়া হয়েছে বেসরকারিকরণ-বাজারিকরণের হাঁড়িকাঠে। আর গণবণ্টন ব্যবস্থার নমুনা! গরিব জনতাকে মাসে পরিবারপিছু প্রয়োজন পঞ্চাশ কেজি পরিমাণ খাদ্যশস্য দেওয়া, বাস্তবে দেওয়া হচ্ছে তার পাঁচ-দশ শতাংশ মাত্র! তাই নিয়ে আবার তার ওপর চলে মিথ্যাচার, দুর্নীতি, কেন্দ্র-রাজ্য কামড়া-কামড়ি। কেন্দ্র বলছে রাজ্যকে সহযোগিতা করছি, রাজ্যগুলো বলছে কেন্দ্রের সহযোগিতা মিলছে না। এই সংঘাতে পিষ্ট হচ্ছে জনগণের জ্বলন্ত দাবিগুলো। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর ভাড়ায় রেলের ৮৫ শতাংশ ভারবহন করার বুক বাজানো যে কতবড় মিথ্যাচার তা ধরা পড়ল পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসতে ভাড়া দিতে বাধ্য হওয়া টিকিট হাতে ধরা শ্রমিকদের থেকে।

fc

 

মোদী সরকার চাইছে লকডাউনের যথাস্থিতি ধাপে ধাপে তুলে অর্থব্যবস্থার চাকা ঘোরাতে। কারণ চাপ বাড়ছে প্রধানত পুঁজির রাঘব-বোয়াল মায় অ-একচেটিয়া ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি -- সব ধরনের শিল্প মালিকদের দিক থেকে। পিএম কেয়ারস ফান্ডে কর্পোরেট ‘অনুদান’ ঢুকেছে শুধুমুুদু নয়। মুকেশ আম্বানী শুনিয়ে রেখেছেন লক ডাউনে তাদের শিল্পগোষ্ঠীর ক্ষতি হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। নির্মাণক্ষেত্র ও উৎপাদনক্ষেত্রের পুঁজি গোষ্ঠীগুলো যে ছলে-বলে-কৌশলে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফিরতে দিতে চাইছিল না, তার পেছনে বরাবরকার উদ্দেশ্য হল দাস ব্যবস্থার মতো ব্যবহার করে আদিম প্রকৃতির পুঁজির পাহাড় বানানোর সস্তা শ্রমের বাজারকে ধরে রাখা। কোবিড সংকটের পরিস্থিতিকে বিশেষ ছুতো বানিয়ে বিজেপির গুজরাট-উত্তরপ্রদেশের রাজ্য সরকারগুলো শ্রমিক বিরোধী শ্রম আইন সংস্কারের যাবতীয় আয়োজন শুরু করে দিয়েছে। মোদী সরকারের লক্ষ্য হল এই উদ্দেশ্যে নির্বিশেষে রাজ্য সরকারগুলোর ওপরে চাপ তৈরি করা। রাজ্য সরকারগুলোও কায়েমী স্বার্থকে কেন্দ্রে রেখে, পুঁজির শক্তিগুলোকে প্রাধান্যে রেখে চলার সহাবস্থানপন্থী। এই ঐকমত্যের ভিত্তির কারণেই যোগসাজশ করে অর্থনীতির চাকা আবার ঘোরানোয় একমত হচ্ছে পুঁজি আর শাসক শক্তি। সিএমআইই সমীক্ষা রিপোর্ট উল্লেখ করেছে, চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত চিত্রটা ছিল প্রতি ৪ জন কর্মরত পিছু কাজ গেছে ১ জনের। এরপরও যদি লক ডাউনের অবস্থা একইভাবে চাপানো থাকে, আর ন্যূনতম আর্থিক উপশমের জ্বলন্ত দাবি সহ জনজীবনের সর্বস্তরে অচলাবস্থার অবসান যদি সমানে উপেক্ষিত হতে থাকে, তবে পরিস্থিতি বিস্ফোরণ ঘটার দিকে চলে যেতে পারে। এইসব চিন্তাই এখন শাসকশ্রেণী করছে এবং ব্যবস্থা-অবস্থার সংকট থেকে নিষ্কৃতি পেতে উপায় খুঁজছে।

loc

 

দেড় মাসেরও বেশি সময় যাবত তিন দফা লকডাউন পর্বেও চলেছে রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু দেখানো আর নানারূপে নিপীড়ন। কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই সময়কালে ছিলেন বোধহয় গ্রীষ্মাবকাশে আর তলে তলে ফন্দি আঁটার তালে। তারপর হঠাৎই দিলেন দর্শন। একদিকে শুরু করলেন বাংলাকে তাক করে অভিযোগের পত্রবোমা মারা, অন্যদিকে গুজরাট কেন করোনা আক্রান্ত হওয়ার ক্রমতালিকায় দু-নম্বরে থেকে যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে পাঠালেন কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল। শাহজীর গোয়েবেলসীয় চাতুরির গুণপনা কে না জানে।

প্রধানমন্ত্রীজী চতুর্থ দফা লক ডাউন ঘোষণার প্রাক বাণীতে শোনালেন ২০ লক্ষ কোটি টাকার অর্থব্যবস্থার কথা। তার পরিপ্রেক্ষিতগত গৌরচন্দ্রিকায় দাবি করলেন, ভারত হয়ে উঠছে ‘আত্মনির্ভর’, এবং এই তথাকথিত আত্মনির্ভরতার লাইন আঁকড়ে থাকতে প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন পাঁচটি স্তম্ভ নির্মাণের যথা -- অর্থনীতি, পরিকাঠামো, ব্যবস্থা, জনবিন্যাস ও চাহিদার। এভাবে মিথ্যাকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যা বলে চালানোর নয়া অপচেষ্টা শুরু করা হচ্ছে। অর্থনীতির স্তম্ভ নির্মীত হওয়ার দাবি স্রেফ ভূয়ো। খাল কেটে নয়া উদারবাদ ডেকে নিয়ে আসার তিন দশকের ধারায়, বিশেষত মোদী জমানায় তার অবাধ ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ চর্চায় জাতীয় অর্থনীতির সার্বভৌমত্ব ও বনিয়াদ কর্পোরেট ও বহুজাতিক পুঁজিমুখীতায় পরিণত হয়েছে পুরোপুরি ভঙ্গুর ও টলমল অবস্থায়। পরিকাঠামো নির্মাণের পরিণতিও তথৈবচ। আর্থ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে বৈষম্য, দীর্ঘসূত্রিতা ও দুর্নীতির অব্যবস্থা। বিপর্যস্ত করা হচ্ছে সামাজিক ব্যবস্থাকে জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিদ্বেষ-বিভাজনের বিষ ছড়িয়ে, এমনকি কোবিড ছড়ানোর জন্য মুসলিমদের সম্প্রদায় হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে, তাদেরকে উৎপাদন ও পরিষেবা এবং সব ধরণের ব্যবসা বাণিজ্য থেকে কোণঠাসা, বিচ্ছিন্ন, উৎখাত করার উদ্দেশ্যে; আর রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হচ্ছে সর্বোপরি ফ্যাসিস্ত গেরুয়া শক্তির হাতে ক্রমবর্দ্ধমান গণতন্ত্র নিধনের প্রক্রিয়ায়। দেশের বহুবিচিত্র জনবিন্যাসগত সহাবস্থানের অস্ত্বিত্বও আক্রান্ত হচ্ছে ধর্মাশ্রয়ী নাগরিকত্ব সংশোধনীর সাঁড়াসি আক্রমণে। আর ‘চাহিদা’ তৈরির প্রশ্ন! ‘বৃদ্ধি’ যেমন কল্পনাতীত মাত্রায় ঠেকেছে একেবারে তলানিতে, তেমনি চার দশকের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়া বেকারি, কর্মসংস্থানের আকাল ও ব্যাপক জনতার অর্থনৈতিক দুর্দশায় চাহিদার বাজার মহামন্দাগ্রস্ত।

এই পটভূমিতে জিডিপির ১০ শতাংশ দাবি করা ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করলেন মোদী। চাপ ছিল লকডাউনের গোড়া থেকেই। তথাপি প্যাকেজ ঘোষণায় লাগিয়ে দেওয়া হল লক ডাউনের তিনটি পর্ব। এখন এর মধ্যে সার কত গাদ কত, পরিণতি কি দাঁড়াবে, সবই বোঝা যাবে সময় বেড়ে চলার নিয়মে।

খণ্ড-27