আমার বন্ধু, ‘হ্যারি’
h23

‘হ্যারি’-র পুরো নাম যে হরিশঙ্কর তা জানতে পারলাম চিরকালের জন্য ও আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পরে, সংবাদপত্রে প্রকাশিত ওর মৃত্যুসংবাদ জ্ঞাপনের দৌলতে। ওর নাম যে হরি (উচ্চারণ অনেকটা ইংরেজি hurry-র কাছাকাছি) তা নামের বানান Hari থেকেই স্পষ্ট। কিন্তু আমি এবং আমাদের বন্ধু-মহলের অনেকেই ওকে ডাকতাম ‘হ্যারি’ (Harry) বলে। ওর চলনবলন, দুরন্ত ইংরেজি উচ্চারণের সঙ্গে হয়ত হরি নামটা ঠিক খাপ খেত না। ইংরেজিয়ানাটা ছিল এতটাই ওর মজ্জাগত, একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার।

হরি বাসুদেবনের (Hari Vasudevan) সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সেই আশির দশকের গোড়ার দিকে (১৯৮২)। তখন আমি সদ্য দেশের রাজধানীর পাট চুকিয়ে কলকাতায় ফিরেছি। আর, হরি এ শহরে পা রেখেছে বছর চারেক আগেই (১৯৭৮), কেম্ব্রিজে পড়াশুনার (বিএ থেকে পিএচডি) পালা শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে। যোগাযোগটা হয়েছিল মনে হয় ওর ছোট ভাই রবির (Ravi) মধ্যস্থতায়, যদিও রবি তখন ছিল (এখনো থাকে) দিল্লিতে। দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ফিল্ম থিয়োরিস্ট (আমার মতে), রবি বাসুদেবনের সাথে আমার দোস্তি যৌবনের শুরু থেকেই। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থায় আমরা দু’জনেই হয়ে পড়েছিলাম সিনেমা-উন্মাদ। দিনের পর দিন পাগলের মতো ছবি দেখা, সারারাত ধরে সেই ছবির মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ, আলোচনা-তর্ক, এর সাথে ‘সেলুলয়েড’ ফিল্ম সোসাইটির দায়িত্ব সামলানো, ‘ফিল্ম-আইকন’ পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদনা এবং প্রকাশনার কাজ ইত্যাদি দু’জনে একসাথে করার সুবাদে রবি আর আমার বন্ধুত্বের বন্ধন জমাট, শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছিল।

হয়ত, সেই কারণেই হরির কথা লিখতে বসে মনে পড়ছে রবির কথা। রবিকে বাদ দিয়ে আমি হরিকে ভাবতে পারি না। দুই ভাইয়ের মধ্যে ছিল অদ্ভুত সাদৃশ্যও, যেন একজন আরেকজনের প্রতিচ্ছবি। শুধু চেহারার মিল নয়, সেই একইরকম কথা বলার ভঙ্গী, একইরকম প্রাঞ্জল ভাষায় বক্তব্য রাখা, একইরকম বাকপটুতা। দু’জনেরই চোখেমুখে অগাধ পড়াশুনা ও বুদ্ধির ছাপ, দু’জনের মধ্যেই স্বাভাবিক রসবোধ ও উন্নত, সংস্কৃতিমান রুচির অভিব্যক্তি।

প্রথম সাক্ষাৎটা হয়েছিল আমার বাড়িতে। হরি আসার আগে, মনে পড়ছে, আমি কিছুটা সন্দিহানই ছিলাম। একে বন্ধুর অগ্রজ, তায় উঠতি অধ্যাপক, তার ওপর বিলেত-ফেরত। কে জানে কেমন হবে মানুষটি! হরি পৌঁছাবার কিছুক্ষনের মধ্যেই কিন্তু আমার আশঙ্কা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। ফ্রেঞ্চকাট, মোটা ফ্রেমের চশমা, সুদর্শন; তার সাথে প্রাণখোলা হাসি, সূক্ষ্ম রসিকতা – সব মিলিয়ে হরির মধ্যে একজন মনোহরণকারী যুবকেরই সন্ধান পেয়েছিলাম। নিমেষেই আমরা বন্ধুত্বে জড়িত হতে পেরেছিলাম।

কোনও সিরিয়াস কথা হয়নি সেদিন। এটা-ওটা, কলকাতার স্ট্রীট ফুড, লোডশেডিং, আবহাওয়া, ক্রিকেট এসবই ছিল ঘণ্টা তিনেকের কথোপকথনের বিষয়বস্তু। এর পর নানান জায়গায়, নানান পরিস্থিতিতে হরির সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন গড়িয়াহাট মোড়ে আমাকে দেখতে পেয়ে ভিড় মিনিবাস থেকে সীট ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়ল। হরি এরকমই।

ওর জীবনসঙ্গিনী ছিলেন তপতী গুহ ঠাকুরতা -- আর্ট হিস্টোরিয়ান এবং ইদানিংকালে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্স-এর অধিকর্তা। তপতী আবার আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতার বোন। সুতরাং, হরির সাথে, কখনো সপরিবারে, দেখা হতই। ছোটখাটো আড্ডাও হয়ে যেত অনেক সময়ে। কিন্তু জ্ঞানগম্ভীর ও তাত্ত্বিক বিষয় কিংবা রাজনীতি নিয়ে আলোচনা কখনো হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না।

হরি ছিল ইউরোপীয় ইতিহাস, বিশেষ করে রুশীয় ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ। শুনেছি, এ বিষয়ে এদেশে ও-ই ছিল শেষ কথা। ১৯০৫-র বিপ্লব ও ১৯১৭-র দু’দুটি বিপ্লব, বিপ্লব-পরবর্তী রাশিয়ার পরিস্থিতি, লেনিনের মৃত্যুর পর ক্ষমতার লড়াই, স্তালিন-ট্রটস্কি দ্বন্দ্ব, যৌথ খামার ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’-তে বর্ণিত সোভিয়েত সমাজ ও নারীর ক্ষমতায়ন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার গৌরবোজ্জল ভূমিকা, সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ অভিযান, স্তালিনের জীবনাবসান ও ক্রুসচভের উত্থান, চীন-রাশিয়া বৈরিতা, রাশিয়ায় পুঁজিবাদের প্রত্যাবর্তন এবং অবশেষে নব্বইয়ের দশকের দোরগোড়ায় সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের করুণ পরিণতি – ইচ্ছে ছিল এসব নিয়ে হরির বক্তব্য শুনব একদিন। সেটা আর হয়ে উঠল না। সংবাদপত্রে অথবা ওয়েবসাইটে কদাচিৎ ওর যেক’টা লেখা পড়ার সুযোগ হয়েছিল, তাতে এ বিষয়গুলির উল্লেখ পর্যন্ত ছিল না। লেখাগুলি ছিল বিপ্লবের অনেক আগে, উনিশ শতকের রাশিয়া সংক্রান্ত অথবা একেবারে হাল আমলের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে। তবে, ইয়েলৎসিনের প্রতিবিপ্লবী ক্যু (১৯৯০) সম্পর্কে সংবাদপত্রে একটি চমৎকার লেখা, মনে আছে, বেশ সাড়া ফেলেছিল।

আসলে, হরি ছিল আদ্যপান্ত নিরপেক্ষ একাডেমিক। কোনও মতাদর্শগত অবস্থান ওর না-পসন্দ। যে কোনও বিতর্ক থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় মনে করত। ওর সুযোগ্য ছাত্র এবং ইতিহাসের শিক্ষক বেঞ্জামিন জাকারিয়া ঠিকই বলেছেন যে হরি ছিলেন অ-কমিউনিস্ট (non-communist), কিন্তু কমিউনিস্ট-বিরোধী (anti-communist) নন। বেঞ্জামিন আরও বলেছেন, হরি ছিলেন একজন ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবি, উত্তর-ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চার ধারার সঙ্গে পা মিলিয়ে চলা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

হরি ফ্রানজ ফ্যানো হয়ে ওঠেনি। প্রতিরোধের তত্ত্ব নির্মান এবং সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মের প্রতি অনীহা ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াতে ওর মধ্যে কোনও দ্বিধা ছিল না, বিদ্বেষ-বিভাজন কিংবা ঘৃণা-হিংসার রাজনীতি ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পথে নামতেও দেখা গেছে ওকে। এইতো, হরি-তপতীর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল গত ডিসেম্বর মাসে মধুসূদন মঞ্চের সামনে অনুষ্ঠিত সিএএ-এনআরসি-এনপিআর বিরোধী একটি প্রতিবাদী জমায়েতে।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থাকায় হরির কাছে সময়ও ছিল অল্প। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইন্সটিটিউট ফর এসিয়ান স্টাডিজ-এর ডিরেক্টর, ইন্সটিটিউট ফর ডেভেলাপমেন্ট স্টাডিজ-এর প্রেসিডেন্ট, এনসিআরটি-র টেক্সটবুক ডেভেলাপমেন্ট কমিটি-র চেয়ারম্যান, অবসার্ভার রিসার্চ গ্রুপ-এর ডিস্টিডিস্টিংগুইশড ফেলো ইত্যাদি নানান প্রতিষ্ঠানের নানান গুরুত্বপূর্ণ পদের দায় ওকে সামলাতে হয়েছে। পূর্বতন ইউপিএ সরকারের বিদেশ নীতি ও রুশ-ভারত সম্পর্ক নির্ধারণেও হরির পরামর্শ ছিল অবধারিত। শুনেছি, ভারত ও রাশিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাদের নিয়ে গবেষনাও শুরু করেছিল, কাজও নাকি এগিয়েছিল অনেকটাই। এছাড়া, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের রাশিয়া কানেকশন সম্পর্কিত নানা ডক্যুমেন্টস উদ্ধারের কাজেও হরি হাত লাগিয়েছিল।

হরির আসল নেশা ছিল ওর পেশাই। ছাত্র পড়ানোতেই ওর আনন্দ। ওর অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছাত্ররা জানিয়েছে, স্যার ছাত্রদের তার সমকক্ষ মনে করতেন, ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে কোনও ফাঁটল উনি মেনে নিতে পারতেন না। তাই ওর চলে যাওয়াটা ওর ছাত্ররা মেনে নিতে পারছে না। ছাত্র-শিক্ষকের মাঝের ফাঁটল এখন কে বোজাবে? এভাবে অসময়ে হরির চলে যাওয়ায় অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল শিক্ষা জগতের।

আর, আমি হারালাম আমার এক বন্ধুকে। করোনার কাছে হেরে গিয়ে আমাদের ‘হ্যারি’ চলে যাবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।

– সুমিত

খণ্ড-27