আবেদন
মে দিবস ২০২০: বিশ্বজোড়া মহামারীর প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস
may day

মে দিবস আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দৈনিক কাজের সময়কে বেঁধে আট ঘণ্টা করার বড় লড়াই থেকে আসে দিনটার অনুপ্রেরণা। সে দাবি আজও প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে আমাদের ভারতবর্ষে যখন করোনা ভাইরাস লকডাউনের মধ্যে সরকার দৈনিক কাজের সময়কে আবার বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করার তোড়জোড় করছে। আট ঘণ্টা কাজের সাথেই যুক্ত নিয়মিত কাজ ও সবেতন ছুটির প্রশ্ন। অথচ আমাদের দেশে কোটি কোটি শ্রমজীবি মানুষ আজও শ্রমিক হিসেবেই স্বীকৃত নন।

এ বছরের মে দিবস নিশ্চিতভাবেই সেইসব অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রের কর্মচারিদের কথা বলছে যাঁদের এই মহামারীজনিত লকডাউনের মধ্যেও ফুরসত নেই। বরং বলা ভাল যে এই সংকটের জন্যই তাঁদের কাজের বিরতি নেই। ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক্যাল কর্মী, জনস্বাস্থ্য কর্মী, সাফাই কর্মী, পরিবহণ শ্রমিক, পুরুষ ও মহিলা পুলিশকর্মী- এঁদের সকলের জন্য এই সময়টা মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপ ও ঝুঁকি নিয়ে হাজির হয়েছে। প্রায়শই তাঁদেরকে ন্যূনতম সুরক্ষার সরঞ্জাম ছাড়াই এই সংক্রমণ বিপদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যদি এখনও তাঁদের কাজের প্রাথমিক সমস্যাগুলোর দিকে নজর দিয়ে সেগুলোর সমাধান না করা হয় তাহলে কেবল তালি বাজালে তাঁদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়াই হবে।

মে দিবস শ্রমিকদের শ্রমের মর্যাদা ও কর্মস্থলে নিরাপত্তার কথা বলে। প্রতিদিন নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে মারা পড়ছেন যে সাফাই কর্মী তাঁর আজও সম্মান ও নিরাপত্তা কোনোটাই নেই! শ্রমশক্তির একটা বড় অংশ প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা ও জাতপাতের নিপীড়ন সহ বিবিধ হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েই চলেছেন। মে দিবস তাই আমাদের কাজের স্বীকৃতি, নিরাপদ কর্মস্থল, কাজের গণতান্ত্রিক ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশের দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শপথের দিন।

এবারের মে দিবস এলো এমন একটা সময়ে যখন দুনিয়া জুড়ে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বা ‘বাড়ি থেকে কাজ’ নামক একটা নতুন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অনেকর জন্য সেটাই নতুন বাস্তব। আমাদের তখন সবার আগে সেই ভাইবোনদের কথা মনে রাখা দরকার যাঁদের না আছে বাড়ি না আছে কাজ। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক রাস্তায় দিন কাটাচ্ছেন, তাঁদের কাজ নেই, মজুরি নেই, ছায়াসঙ্গী হয়ে আছে কেবল নিরাপত্তাহীনতা, অপমান, ক্ষুধা আর দুর্ভোগ। নির্মাণ শ্রমিকদের বানানো বাড়িতে মানুষকে নিরাপদ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে সরকার, অথচ সেই নির্মাণ শ্রমিকদের নিজেদেরই অনেকের মাথার উপর কোনো ছাদ নেই।

w

 

সেইসব মহিলা ও শিশুদের কথাও ভাবতে হবে আমাদের যাঁদের সারাদিনের কাজের জায়গাটাই হল বাড়িতে, কিন্তু সেইসব কাজ চোখের আড়ালেই থেকে গেছে, কাজের স্বীকৃতি পায়নি। তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের কাছে বাড়ি আর কর্মস্থলের মধ্যে ফারাকটাই আজ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, শুধু বেড়ে চলেছে কাজের বোঝা ও মানসিক চাপ। চিরকাল যাঁরা ঘরের চার দেওয়ালে মধ্যে আবদ্ধ তাঁদের থেকে শুরু করে যাঁদের আজ ঘরে ঠেলে দিয়ে বাড়ি থেকে কাজ করার ‘সুবিধা’ টের পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের সকলের জন্যই ভাবনার নতুন খোরাক আর সংগ্রামের নতুন বার্তা নিয়ে এসেছে এবারের মে দিবস।

এবারের মে দিবস আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দার আভাস ছড়িয়ে দিচ্ছে মানুষের চোখে মুখে। এই বিধ্বংসী ধাক্কা ও ভাঙ্গাচোরা হাল সামলে অর্থনীতি কিভাবে আবার উঠে দাঁড়াবে? কে এই পাহাড়প্রমাণ ক্ষতির ব্যয়ভার বহন করবে? ইতিমধ্যেই কয়েক লাখ মানুষ জীবিকা ও অন্নসংস্থান হারিয়েছেন। মজুরি কাটা হচ্ছে, মহার্ঘ ভাতা ঠাণ্ডাঘরে, অধিকাংশ শিল্পক্ষেত্রে প্রচুর কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা শোনা যাচ্ছে আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্যদ্রব্যের দামও আকাশ ছুঁতে শুরু করেছে। এই মহামারী এবং মন্দার মিলিত বোঝা কখনোই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রমজীবী জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। এই মে দিবস তাই অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এবং জনগণকে ত্রাণ সরবরাহ করতে প্রয়োজনীয় তহবিল গড়ার জন্য ধনীদের উপর অবিলম্বে কোভিড সম্পত্তি কর বসানোর দাবি তোলার সময়।

উৎপাদন ব্যবস্থার কেন্দ্রে থাকা শ্রমিকরাই মানবিক শ্রমের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের রূপান্তর ঘটিয়ে আমাদের ক্রমবর্ধমান বস্তুগত চাহিদার যোগান দিয়ে চলেছেন। তাঁদের উৎপাদিত সামগ্রী মুষ্টিমেয় মানুষের মুঠোয় জমা হয়ে সম্পত্তির পাহাড় তৈরি করেছে। সেই সম্পত্তিই শ্রমজীবী উৎপাদক জনতার উপর আজ যুদ্ধের হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। এবারের মে দিবস তাই গোটা উৎপাদন ব্যবস্থা, সম্পত্তির মালিকানা ও বণ্টনের ধরন সম্পর্কে আবারো ভেবে দেখার সময়। জনগণের জন্য ক্রমাগত ব্যয় সংকোচন আর মুষ্টিমেয় লোকের প্রাচুর্য্য, মুনাফার বেসরকারীকরণ আর লোকসানের রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, সামাজিক উৎপাদনের উপর সংকীর্ণ কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ অনেক দেখেছি। আর নয়! কর্পোরেটদের লোভ আর লুঠের হাত থেকে প্রকৃতি ও জনগণকে রক্ষা করার, একটা নতুন ও ন্যায়পূর্ণ পৃথিবী গড়ার সাইরেন বাজিয়ে দিয়েছে কোভিড-১৯।

আম্বেদকরের একটা বিখ্যাত কথা স্মরণ করা যেতে পারে – জাতব্যবস্থা শ্রমের বিভাজন নয়, শ্রমিকের বিভাজন।  মে দিবস হল সেই বিভক্ত শ্রমিকের ঐক্যের দিন। বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী ও শোষিত মানুষের ঐক্য। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ধারাবাহিক ধ্বংসসাধন ও মহামারী মোকাবিলায় বেশিরভাগ দেশের সরকারেরই অপদার্থতা আর নিষ্ঠুর উদাসীনতার  ফলে সারা বিশ্বে শ্রমজীবী মানুষকেই কোভিড-১৯ মহামারীর সবথেকে বেশি ধকল সইতে হচ্ছে। অথচ সরকারগুলো এখনও নিজেদের সব দায়িত্ব এড়িয়ে শ্রমিকদেরকেই দোষারোপ ও বিভাজন করতে ব্যস্ত! এই বিভাজনের ছককে রুখে দেওয়াটা আজ ভীষণ জরুরি। আজ যখন বিশ্ব পুঁজিবাদ আর মানুষের বেঁচে থাকার মধ্যে সংঘাত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে তখন অন্যরকম বিশ্ব গড়ে তোলাটা আমাদের কাছে আশু তাগিদ। আজ সত্যিই ডাক পড়েছে গোটা পৃথিবীকে জয় করার, নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার। জোট বাঁধো তেরি হও। এ লড়াই সবার লড়াই। এ লড়াই জিততে হবে।

খণ্ড-27