করোনা বেআব্রু করল নয়া উদারবাদের দেউলিয়াপনা
kor

কবে, কোথায় আর আরও কতটা বিপর্যয় ঘটিয়ে যে এই অতিমারী টানবে তার শেষ যতি চিহ্ন, তা এখনও কেউ বলতে পারছেন না। নতুন নতুন সীমানা টপকে একের পর এক দেশকে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে এই করোনা। দেখা যাচ্ছে এবার রাশিয়া মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। রাজধানী মস্কোয় বিদ্যুতগতিতে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর হার।

এই বিশ্ব আগেও দেখেছে অনেক মহামারী। গভীর অর্থনৈতিক মন্দা। ১৯২৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ার বাজার হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে যে বিশ্বব্যাপী মহামন্দার জন্ম দিল, তার প্রভাব চলেছিল প্রায় ১০ বছর। তারপর, ২০০৮ সাল গোটা দুনিয়া প্রত্যক্ষ করে ফিনান্সিয়াল মেল্টডাউন বা বিত্তীয় পুঁজির সংকট। কিন্তু এবারের সংকট আক্ষরিক অর্থেই নজিরবিহীন। যার তুলনা মেলা ভার। এর আগে একই সঙ্গে চাহিদা জোগানের শৃঙ্খল এমনভাবে আগে কখনও ছিন্নভিন্ন হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, ইন্টারনেট যুগে এই প্রথম অতিমারি ঘটল বিশ্বায়িত পুঁজির নিবিড় আঁটোসাটো বাঁধনের পৃষ্ঠভূমিতে, ৩০-এর দশকে মহা মন্দার সময়েও যে অর্থনীতি তার জাতীয় সীমানা ছাপিয়ে গুণগত ভাবে আজকের মতো এতটা একমাত্রিক গ্রন্থিতে নিজেকে বাঁধেনি। গ্লোবাল ভ্যালু চেন, যা আজ বিশ্বায়িত পুঁজির চরিত্রলক্ষণ, করোনার প্রবল ধাক্কায় ছিন্নভিন্ন। উৎপাদন শিল্পের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র চীনে সাব-সাহারা আফ্রিকা মহাদেশ নানান কাঁচামাল সরবরাহ করে জায়গা করে নিয়েছে এই বিশ্বব্যাপী ভ্যালু চেন র মধ্যে। দেখা গেল, চিনের উহান, যা দুনিয়ার বুকে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অটোমোবাইল উৎপাদনের কেন্দ্র, যেখানে সিংহভাগ অপ্টিকাল ফাইবার তৈরি হয়, যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিরাট গ্লোবালভ্যালু চেন, সেখানে প্রথম করোনা ভাইরাস হানা দেওয়ার পরই প্রবল ঝাঁকুনি অনুভূত হল গোটা অর্থনৈতিক গ্রন্থী জুড়ে। করোনা নির্মমভাবে সামনে আনলো এই বিশ্বায়িত আর্থিক মডেলের অন্তর্নিহিত চরম ভঁঙ্গুরতাকে, সংকটের সময় তার কার্যকারীতা সম্পর্কে তুলে দিল হাজারো প্রশ্ন।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বর্তমান প্রচলিত মডেলের চূড়ান্ত দেউলিয়াপনা বে আব্রু করলো এই অতিমারী। কয়েকটা উদাহরণ উল্লেখ করা যাক। ইতালির অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী অঞ্চল হল লোম্বারডি। একসময় এই অঞ্চলে গণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ছিল নজর কাড়া। কিন্তু, ১৯৯৭-এর পর থেকে সেখানে দ্রুত গতিতে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চলে যায় কর্পোরেটদের কব্জায়। করোনার নির্মম পরিহাস দেখালো, গোটা ইউরোপের মধ্যে লোম্বারডি সবচেয়ে বিধ্বস্ত। সমগ্র ইতালির সাপেক্ষে এই অঞ্চলের জনসংখ্যা মাত্র ১৬ শতাংশ। কিন্তু গোটা ইতালিতে মৃত্যুহারে এই অঞ্চল সর্বাধিক – ৬৬ শতাংশ! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেল শ্বেতাঙ্গ মার্কিনীদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ ও হিসপানিক্সদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি। মার্কিন সমাজে এই দরিদ্র জনসংখ্যাটি ব্যয়বহুল স্বাস্থ্য বিমার আওতার বাইরে। নিউইয়র্ক মহানগরে হিসপানিক্সদের জনসংখ্যা মাত্র ২৯ শতাংশ, কিন্তু মৃত্যুর হার হল ৩৪ শতাংশ। আবার, বৃহত্তর নিউইয়র্কে কৃষ্ণাঙ্গদের জনসংখ্যা মাত্র ৯ শতাংশ। কিন্তু মৃত্যু হার ১৮ শতাংশ। আমাদের দেশেও স্বাস্থ্যকে কর্পোরেটদের কব্জায় তুলে দেওয়ার হিড়িকে ধ্বংস করা হয়েছে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা। বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে ভারতের আর্থিক বরাদ্দ সবচেয়ে কম – জিডিপির মাত্র এক শতাংশ।

loc

 

এই অতিমারী নয়া উদারবাদী অর্থনীতির গোড়া ধরে টান মেরেছে। উদ্ঘাটিত করেছে তার বিরোধাভাস, চরম ভঙ্গুরতা, নিকৃষ্টতম অন্তঃসারশূন্যতাকে। যে সংগঠিত উৎপাদন ব্যবস্থাকে তছনছ করে নয়া উদারবাদ বিপুল আয়তনের এক ইনফর্মাল অর্থনীতি, ইনফর্মাল শ্রমশক্তির জন্ম দিল, আজ সেটাই ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ২৯ এপ্রিল এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা জানিয়েছে যে, গোটা বিশ্বে ৩০০ কোটি ৩০ লক্ষ শ্রমশক্তির মধ্যে অর্ধেকের ও বেশি অর্থাৎ, ১০০ কোটি ৬০ লক্ষ ইনফর্মাল শ্রমিকের রুটিরুজি কেড়ে নেবে এই অতিমারী। করোনা হামলার প্রথম মাসেই ২০০ কোটি ইনফর্মাল শ্রমিকদের মজুরি বিশ্ব হারের ৬০ শতাংশ হ্রাস প্রাপ্ত হয়। যে ইনফর্মাল শ্রমিকদের রক্ত-ঘামের বিনিময়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঝাঁ-চকচকে চোখ ধাঁধানো নগর সভ্যতা, মুষ্ঠিমেয় বিত্তবানদের বিপুল উৎকট ও কুৎসিত বৈভব যাদের উপর ভর করে এসেছে, সেই অযুত – নিযুত মানুষগুলোর না আছে নিশ্চিত, ভদ্রস্থ আয়ের গ্যারান্টি, না আছে সুলভে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ সুবিধা। না আছে ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষার রক্ষাকবচ। তাদের না আছে ভবিষ্যতের জন্য কোনো আর্থিক সঞ্চয়, বার্ধক্যকালীন পেনশন। তাদের নেই কোন ভবিষ্যৎ, আছে শুধু রুক্ষ প্রাণহীন বর্তমান। যা ঝুলে রয়েছে হাজারো অনিশ্চয়তার সূক্ষ সুতোর উপরে। করোনায় সব হারানো এই মানুষদের পাশে গোটা দুনিয়া যদি সামাজিক সংহতিবোধ থেকে পাশে না দাঁড়াতে পারে, আইএল ও সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছে, তবে তারা স্রেফ আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তেনিয়ো গুতেরেস গোটা বিশ্বের কাছে এক আবেদন জানিয়ে বলেছেন, “বর্তমানে আমরা এক অত্যন্ত নজীরবিহীন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছি, যেখানে সাধারণ সময়ের নিয়মগুলো খাটে না।”

তিনি সতর্ক করে বলেছেন, “বছরের শেষে গোটা দুনিয়ায় শ্রমিকদের আয় ৩.৪ লক্ষ কোটি ডলার হ্রাস প্রাপ্ত হবে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন স্বল্প আয় সম্পন্ন শ্রমিক ও মহিলারা। এই সংকটের বোঝাকে সবচেয়ে আক্রান্ত দুঃস্থ মানুষদের উপর চালান করে দিলে আমরা জন্ম দেব হত দরিদ্র গরিব মানুষদের বিশাল এক বাহিনীকে।”

১৮ মার্চ আই এল ও প্রকাশ করেছে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট – কোভিড ১৯ অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ার্ক ইম্প্যাক্ট অ্যান্ড পলিসি রেসপন্সেস। অতিমারীর প্রবল আঘাতে দুনিয়া জুড়ে বিপর্যস্ত সাপ্লাই চেন সমস্ত ধরনের ব্যবসা- বানিজ্যকে, ছোট মাঝারি অসংখ্য সংস্থাকে যে ধ্বংস করে দিয়েছে আর তার ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কয়েকটা জরুরী পদক্ষেপের উল্লেখ করেছে। এই গভীর সংকটে আর্থিক বৃদ্ধি ও বিকাশের লক্ষ্যে “মানবিক মনোভাব সম্পন্ন (হিউম্যান সেন্ট্রিক) নীতি অনুসরণ করার উপর জোর দিয়েছে। তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় সর্বপ্রথম রয়েছে শ্রমিক কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের কোভিড ১৯-এর ঝুঁকির হাত থেকে সুরক্ষিত করা, তাঁদের কর্মস্থল গুলোকে ঝুঁকিহীন-সুরক্ষিত করে তোলা, এবং তার জন্য বিপুল পরিমাণে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও সহায়তা প্রদান। দ্বিতীয়ত, রুটি রুজি হারানো মানুষদের কর্মসংস্থান, বিরাট মাত্রায় আর্থিক সহায়তা প্রদান, (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রঘুরাম রাজন এই সমস্ত গরিব মানুষদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য ৬৫ হাজার কোটি টাকা ধার্য করার প্রস্তাব দিয়েছেন)। সর্বস্তরের শ্রমিকদের সবেতন ছুটির সুযোগ দেওয়া (যা ইনফর্মাল শ্রমিকদের ক্ষেত্রে জোটে না)। তৃতীয়ত, সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত করতে অগ্রাধিকার দেওয়া, সমস্ত শ্রমিক কর্মচারীদের নিরাপদ – স্বাস্থ্য সম্মত কর্মস্থল সুনিশ্চিত করা (এ প্রশ্ন ভারত সবচেয়ে পিছিয়ে)।

আইএলও আরেকটা বিষয়ের উপর বিশেষ জোর দিয়েছে। তা হল, ত্রিপাক্ষিক স্তরে আলাপ আলোচনা। সরকার – শ্রমিক ইউনিয়ন – নিয়োগ কর্তার মধ্যে পারস্পরিক মতবিনিময়, ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থাগুলোকে উন্নত ও মজবুত করে। এই অতিমারি বিরাজমান প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনসাধারণের চুড়ান্ত অনাস্থা তৈরি করে। আইএলও তাই বিভিন্ন দেশের শাসকবর্গের কাছে সতর্কবার্তা দিয়ে আশংকা করছে যে ভেঙে পড়া এই আস্থা আগামীদিনে বিরাট সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দেবে, যা এখন থেকে সামাল দিতে না পারলে পরে তা নাগালের বাইরে চলে যাবে।

ati

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, কেইন্সের অর্থনৈতিক দর্শন সংকটগ্রস্থ পুঁজিবাদী দুনিয়াকে নতুন ভাবে উঠে দাঁড়াতে বিরাট ভূমিকা রাখে। পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে কল্যাণকামী রাষ্ট্র ও সরকারী বিনিয়োগে গণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আত্মপ্রকাশ করে। কোভিড-১৯-এর দুনিয়া জোড়া সুনামির পর কী আবার নতুন করে জনস্বাস্থ্য, সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কবচ, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ – যাকে নব্য উদার অর্থনীতি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অপচয় মনে করে বেসরকারিকরণকেই একমাত্র মোক্ষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে, – আবার আসবে কেন্দ্রবিন্দুতে? তা অনাগত আগামী বলবে। ২০০৮ সালের ফিনান্সিয়াল মেল্টডাউনের পর বিভিন্ন দেশের সরকার, আন্তর্জাতিক মহল ডুবন্ত অর্থনীতিকে বাঁচাতে তখন বিপুল আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে কর্পোরেটদের স্বার্থে। অভিজ্ঞতা প্রমাণ করলো, সেই বিরাট বহরের আর্থিক সাহায্য পাওয়ার পর ও বৃহৎ পুঁজি – কর্পোরেট ঘরানাগুলো বিন্দুমাত্র সামাজিক দায় দায়িত্ব পালন করেনি। ব্যাপক ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস ঘটিয়ে দুনিয়া জুড়েই শ্রমজীবী মানুষের উপর নামানো হয়েছিল বিরাট হামলা। আইএলও-র হিসাব বলছে, ঐ সংকটের ফলে বিশ্ব ব্যাপি বেকারত্ব দু’কোটি দু লক্ষ্য বৃদ্ধি পায়। সেখান থেকে কি এবার শিক্ষা নেবে আন্তর্জাতিক মহল? বিভিন্ন অর্থশাস্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন, এবার ও আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করার আগে বেশ কিছু কঠিন শর্ত আরোপ করা হোক।

আমাদের দেশের শাসকেরা আজ পর্যন্ত কোনো শিক্ষা নিল না। সমস্ত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, অর্থশাস্ত্রী সমস্ত গরিব মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে তাদের বেঁচে বর্তে থাকার মতো আর্থিক অনুদান, বুবুক্ষা ভারতবর্ষের অগণন ক্ষুধার্ত মানুষকে দু-বেলা বিনামূল্যে পর্যাপ্ত রেশন, সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা অবিলম্বে গড়ে তোলা প্রভৃতি প্রস্তাব রাখলেও কোন সরকারই তা কর্ণপাত করল না। এমনকি ২৯ মার্চ, ভারত সরকার জাতীয় বিপর্যয় আইনের ১০ (২)(১) ধারার ভিত্তিতে সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলে, লকডাউনের সময় কাউকে ছাঁটাই বা মজুরী কাটা চলবে না। কিন্তু, বহু সংস্থা আজ পর্যন্ত তার মান্যতা না দিয়ে কর্মী ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস করলেও না রাজ্য না কেন্দ্র, কেউই এর বিরুদ্ধে কোন বিধিব্যবস্থা নিল না। আইএলও-র রিপোর্ট উল্লেখ করেছে ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে গরিব, ইনফর্মাল শ্রমজীবী মানুষের স্বাস্থ্য – আর্থিক নিরাপত্তা – কর্মস্থলে নিরাপত্তা প্রভৃতি নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। সেখানে মোদীর ভারতের কোন স্থান নেই।

এযাবৎ অনুসৃত নয়া উদারবাদী অর্থনীতির গতিমুখকে আমূল বদলে নতুন জনমুখী আর্থিক প্যারাডাইমের অভিমুখে সরকারকে বাধ্য করার উপরই আবর্তিত হবে আগামীর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ভাষ্য। যেখানে মুনাফা নয়, মানুষের উন্নয়ন, স্বার্থ ই থাকবে কেন্দ্রবিন্দুতে।

খণ্ড-27