ভারতের শ্রমিকদের ক্রীতদাসে পরিণত করা এবং বিশ্ব পুঁজির কাছে ভারতকে ইজারা দিয়ে দেওয়াটা আত্মনির্ভরতার পথ হতে পারে না
ind

মাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণার ঠিক সাত সপ্তাহ পর মোদী দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে আরও একবার ভাষণ দিলেন ১২ মে’র রাত আটটায়। যেদিন ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন সেদিন তিনি জনপ্রিয় হিন্দি প্রবাদ “জান হ্যায় তো জাহান হ্যায়”-এর উল্লেখ করেছিলেন। আর এর মধ্যে দিয়ে তিনি এটাই বুঝিয়েছিলেন যে, জনগণের জীবন রক্ষার জন্য তাঁর সরকার চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখবে না। ২৫ মার্চ এবং ১২ মে’র মধ্যে গড়িয়ে যাওয়া সাতটা সপ্তাহে দেখা গেল, কোভিড-১৯-এর কারণে এবং মোদী সরকারের চাপানো অরাজক ও স্বৈর চরিত্রের লকডাউনের ফলে ভারতে শয়ে-শয়ে, হাজারে-হাজারে মানুষ মারা যাচ্ছেন।

১২ মে’র ৩৩ মিনিটের ভাষণে এই মৃত্যুগুলোর জন্য দু্ঃখ প্রকাশ করতে তিনি ৩৩ সেকেণ্ড সময়ও ব্যয় করলেন না, যদিও লকডাউন জনিত অধিকাংশ প্রাণহানির জন্য তাঁর সরকারই সরাসরি দায়ী। পরিযায়ী শ্রমিকদের বেড়ে চলা পাহাড়প্রমাণ দুর্দশা নিয়ে তাঁর ভাষণে তিনি যে একটা কথাও বললেন না, তা অত্যন্ত প্রকট ভাবে ফুটে উঠছে। তিনি বস্তুত ভারতে কোভিড-১৯-এর পরিস্থিতি বা নিপীড়নমূলক লকডাউন সৃষ্ট সুবিশাল মানবতাবাদী সংকট নিয়ে কোনো কথাই বললেন না। এই নীরবতা ছিল সুগভীর এবং ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজের উল্লেখটাও (যা নিয়ে অর্থমন্ত্রী পরে বিশদে বলবেন বলে তিনি জানালেন) ওই নীরবতা জনিত ক্ষোভের প্রশমন ঘটাতে পারল না।

প্রধানমন্ত্রীর পুরো ভাষণটাই চালিত ছিল তাঁর কল্পনার আত্মনির্ভরশীল ভারতের স্বপ্নকে ধরে এক নয়া বাচনিকতা নির্মাণের দিকে। তাঁর মতে কোভিড-১৯ অতিমারী একটা সংকট না হয়ে তা হল একটা সুযোগ যাকে আঁকড়ে ধরতে হবে এবং সেই লক্ষ্যে তাঁর সরকার  কিভাবে এগোতে চায় তার রূপরেখাও তিনি হাজির করলেন। তিনি ভারতের পাঁচটা স্তম্ভর কথা বললেন – অর্থনীতি, পরিকাঠামো, প্রযুক্তি, জনসংখ্যায় তরুণদের প্রাধান্য ও চাহিদা। তিনি যেটাকে বলেছেন ভারতের জনসংখ্যার প্রাণবন্ত বিন্যাস তাতে প্রসঙ্গক্রমে পরোক্ষ উল্লেখ ছাড়া ভারতে সম্পদের প্রকৃত স্রষ্টা শ্রমিক ও কৃষকদের ঠাঁই তাঁর স্তম্ভগুলোতে  হয়নি।

migrajt

 

একবারের জন্যও তাঁর মনে হল না যে, পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যার সমাধানে তাঁর সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা তাঁর সমস্ত স্তম্ভগুলোকে চূড়ান্ত প্রহসনে পরিণত করেছে। ভারতের জনসংখ্যায় যুবক শ্রেণীর প্রাধান্যকে ‘জনসংখ্যাগত সুবিধা’ বলে বর্ণনা করাটা একটা গতানুগতিক বুলি হয়ে উঠেছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের যে অন্তহীন মিছিল আমরা দেখলাম তা স্মরণকালের মধ্যে শান্তির সময়ে সবচেয়ে ব্যাপক নিষ্ক্রমণ। এদের বেশির ভাগটাই আবার জনসংখ্যার সুবিধাজনক বর্গের মধ্যে পড়বে। তারা শুধু এটুকুই চেয়েছিল যে, ভারতের প্রযুক্তিগত ও পরিকাঠামোগত নৈপুণ্যকে কাজে লাগিয়ে তাদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হোক, মোদী সরকার কিন্তু পঞ্চাশ দিনে এই সামান্য দাবিটুকুও পূরণ করতে পারল না। আর প্রধানমন্ত্রী পাঁচটা স্তম্ভ নিয়ে আমাদের বড়-বড় কথা শোনাচ্ছিলেন।

মোদী চারটে ক্ষেত্রে সাহসী সংস্কার আনার কথা বললেন – জমি, শ্রম, নগদ অর্থ এবং আইন। তাঁর কাছে ভূমি সংস্কারের অর্থ হল যে কোনো এবং সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে কর্পোরেটদের দ্বারা জমি অধিগ্রহণকে সুগম করে তোলা। তাঁর সরকার এর আগে জমি অধিগ্রহণ আইন এবং বন অধিকার আইনে সংশোধন এনে এটা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সর্বব্যাপী প্রতিবাদের মুখে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। কোভিড-১৯-কে ‘মওকা’ মনে করে তিনি কি ওই বকেয়া এজেণ্ডাটাকে হাসিল করতে চাইছেন? শ্রম সংস্কার বলতে তাঁর সরকার কী বোঝে সেটা এখন আমরা খুব ভালো করে জেনে গেছি। শ্রম আইনগুলোকে সংকুচিত করে মনুস্মৃতির ঢঙে চারটে বিধিতে নতুন আদল দেওয়া হচ্ছে এবং বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারগুলো আগামী তিন বছরের জন্য সমস্ত শ্রম আইন মুলতুবি রাখার কথা ঘোষণা করতে শুরু করেছে।

নগদ অর্থের আরও বেশি জোগানের অর্থ হল আরও বেশি ঋণের লভ্যতাকে সম্ভব করে তোলা আর আমরা এটাও জানি যে প্রদত্ত সমস্ত ঋণ কারা পকেটস্থ করছে। ঋণগ্রস্ত কৃষকদের আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, এখন আমরা আবার স্বনিযুক্তি প্রকল্পে ঋণ নিয়ে তা শোধ করতে না পেরে মহিলাদের আত্মহত্যার খবরও ক্রমেই বেশি-বেশি শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু বড়-বড় ঋণ খেলাপিদের ঋণ মাঝে-মধ্যেই ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দেওয়া হচ্ছে, এবং ২০১৪ সালে মোদী কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুছে দেওয়া ঋণের মোট পরিমাণ হল ৬,৬০,০০০ কোটি টাকা, যা হল মোদী প্রতিশ্রুত কোভিড-১৯ স্টিমুলাস প্যাকেজের তিন ভাগের এক ভাগ। নগদ অর্থের আরও বেশি যোগান বলতে কি সমস্ত কৃষি ঋণ এবং স্বনিযুক্তি প্রকল্পে নেওয়া ঋণের বাতিল হওয়াকে বোঝাবে, নাকি তার অর্থ হবে ভারতের কর্পোরেটদের জন্য আরও ঋণের ব্যবস্থা? এর উত্তর অনুমান করে নেওয়াটা একেবারেই কঠিন নয়।

india

 

আইনের সংস্কার কোন অভিমুখে হচ্ছে সেটাও আমরা জানতে পারছি। আইন ক্ষেত্রে সংস্কার বলতে সরকার ঔনিবেশিক যুগের মহামারি ব্যাধি আইন বাতিলের কথা বোঝাচ্ছে না, যে আইনের বলেই এখন লকডাউন চলছে, কিংবা বোঝাচ্ছে না দেশদ্রোহ আইনের বাতিলকেও; এই সংস্কার বলতে বোঝানো হচ্ছে ভারতের নাগরিকত্ব আইন অথবা ভূমি ও শ্রম আইনকে নতুন করে রচনা করা যার উদ্দেশ্য হল ভারতে গণতন্ত্রের সাংবিধানিক ভিত্তি এবং আইনি কাঠামোকে দুর্বল করে তোলা।

এই সমস্ত সংস্কারের উদ্দেশ্য হল প্রণালীবদ্ধভাবে ভারতীয় জনগণকে ক্ষমতাহীন করে তোলা এবং তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা, এবং ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর বড় অংশকে ক্রীতদাসে পরিণত করা। এটা আত্মনির্ভরশীলতা হতে পারে না, এটা শুধু বিশ্ব পুঁজির কাছে আকর্ষণীয় করে তুলে ভারতের মানব ও প্রাকৃতিক সম্পদকে তাদের কাছে ইজারা দেওয়া, এটা ভারতীয় গণতন্ত্রের অবমূল্যায়ন ঘটানো, এটা ভারতকে নিলামে তোলা।

এই প্যাকেজের মধ্যে প্রকৃতই কী আছে তা সামনের দিনগুলোতে সম্পূর্ণরূপে উদঘাটিত হবে। তবে কয়েকটা বিষয় কিন্তু স্পষ্ট হয়ে গেছে। টাকার এই পরিমাণটা বিরাটভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা হয়েছে, বর্তমানে চালু একগুচ্ছ প্রকল্পের অর্থ এবং আরবিআই-এর জোগানো  অর্থের পরিমাণকেও এর মধ্যে ঢোকানো হয়েছে। অতি ধনীদের ওপর কর বসিয়ে এই অর্থের জোগান তো হবেই না, বিপরীত দিকে আবার সাধারণ জনগণের বেতন এবং ভাতা ও পেনশনের পরিমাণ হ্রাস করা হচ্ছে। এবং তৃতীয়ত, লকডাউন সময়কালের মজুরি হিসাবে, গ্ৰাসাচ্ছাদন ভাতা, বিনামূল্যে রেশন এবং ক্ষয়ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ রূপে এই প্যাকেজের অর্থ সেই সমস্ত মানুষদের কাছে পৌঁছবে না যাদের এই অর্থের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

baby

 

ভারত ইতিমধ্যেই যে পঞ্চাশ দিনের লকডাউন ভোগ করেছে, সেই অভিজ্ঞতার কোনো বিশ্লেষণাত্মক পর্যালোচনা না করেই মোদী চতুর্থ দফার লকডাউনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার গতিকে যাতে মন্থর করা যায় এবং সরকার যাতে বিভিন্ন ফ্রন্টের চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলায় তার প্রস্তুতিকে জোরদার করতে সক্ষম হয়, এই উদ্দেশ্যেই লকডাউন চালু করা হয়েছিল। এই দুটো উদ্দেশ্যের কোনোটাই বলতে গেলে সফল হয়নি। মোদী বলেছেন চতুর্থ দফার লকডাউন আগেরগুলোর থেকে ভিন্ন ধরনের হবে। কিন্তু কোনো শিক্ষাই যখন গ্ৰহণ করা হয়নি, সেক্ষেত্রে এই পর্ব কি আগেরগুলোর তুলনায় বেশি কার্যকরী হতে পারবে? লকডাউন যখন ক্রমশ শিথিল হয়ে আসবে, তখন প্রাপ্ত ইঙ্গিতগুলো থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, জনগণকে উপেক্ষা করার এবং তাদের জীবনকে আরও বিপর্যস্ত করার অভিপ্রায় সরকারের রয়েছে। যে রাষ্ট্র নিজের দায়বদ্ধতাকে পরিত্যাগ করে জনগণের ঘাড়েই দায়ভার চাপায়, সেই রাষ্ট্র কখনই আত্মনির্ভরশীলতার আদর্শ দৃষ্টান্ত হতে পারে না।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১২ মে ২০২০)

খণ্ড-27