বন্ধ ঘরের হিংস্র পৌরুষ
h20

২০১৬ সালে ‘লকার রুম বান্টার’ বা ‘বন্ধ ঘরের খিল্লি’ শব্দবন্ধ বহুলভাবে রাজনৈতিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। সে সময় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ধনী ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি ভিডিও প্রকাশ্যে আসে যেখানে তাঁকে কুৎসিত নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করতে দেখা যায়। নির্বাচনী বাধ্যবাধকতার চাপে ট্রাম্পকে তাঁর মন্তব্যের জন্য তখন ক্ষমা চাইতে হয়। কিন্তু তিনি নিজের মন্তব্যের সমর্থনে “লকার রুম বান্টার” অর্থাৎ বন্ধ ঘরের খিল্লির কথা তোলেন। বলেন, তাঁর মন্তব্য ছেলেদের ব্যাক্তিগত পরিসরে বন্ধুদের নিভৃত আলাপচারিতায় নিতান্তই স্বাভাবিক। এরপর বিশ্ব রাজনীতিতে বহু জল গড়িয়ে গেছে।ধনপতি ট্রাম্প নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আমেরিকার সর্বাধিকার-বলে বিশ্ব পুঁজিবাদের দ্রষ্টা পদে আসীন। তাঁর সুহৃৎ আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, গত ফেব্রুয়ারী মাসের শুরুতে এই পুঁজিপতি পুরুষতান্ত্রিক ব্যাক্তির আতিথেয়তায় খরচ করেছেন সরকারী তহবিলের ১০০ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারী মাসের গোড়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO কোভি-১৯ মহামারী সম্পর্কে সতর্কবার্তা জারি করলেও আমাদের দেশের সরকারের তরফ থেকে উদ্যোগ ছিল শূন্য। ফেব্রুয়ারী মাসে ট্রাম্পকে নিয়ে মাতামাতিতে ব্যস্ত যখন মোদী-শাহ তখন অনতিদূরে দেশের রাজধানীতে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রর উসকানিতে শুরু হলো সংখ্যালঘু-সম্প্রদায়-নিধন যজ্ঞ। সিএএ-এনারসি-বিরোধী জমায়েতকে উদ্দ্যেশ্য করে উচ্চবর্ণ কপিল মিশ্র হুঙ্কার দিল, “হয় তোমরা জমায়েত খালি কর, নয় আমরা খালি করার ব্যাবস্থা করে নিচ্ছি”। এবং তা কার্যকর করতে পাশের রাজ্য থেকে ঘাতকবাহিনী মোবিলাইজ করল তারা। মারা গেলেন শয়ে শয়ে গরিব মানুষ। তাদের বাড়ি পুড়লো ঘটি-বাটি সমেত, মুসলিম মহিলারা যৌন-হেনস্থার শিকার হলেন, বলাৎকারের শিকার হলেন। গণহত্যার সত্য ধামাচাপা দেওয়ায় বিশেষজ্ঞ শাহ-মোদী। করোনার অজুহাতে বন্ধ করতে চাইলেন সমস্ত নাগরিক প্রতিবাদ। মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে দেশ জুড়ে দায়ের হলো অপরিকল্পিত লকডাউন। আজ দুমাস সেই অপরিকল্পিত লকডাউন চলছে। মোদিজী জনগণের কাঁধে একের পর এক ‘টাস্ক’ চাপিয়ে দায় সারছেন। অন্যদিকে দেশের নিপীড়িত জনতা কাজের আস্তানা ছেড়ে হেঁটে পাড়ি দিচ্ছেন শত শত মাইল পথ, ঘরের পথে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। রেশনে চাল নেই, ওষুধ কেনার টাকা নেই, হাতে কাজ নেই। দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতির মৃত্যুতে শিলমোহড় পড়ার অপেক্ষা নিয়ে লকডাউন চলছে। আর এই লকডাউনের মাঝে ফিরে এলো আমেরিকার প্রেসিডেন্টের একদা আলোচিত লকার রুমের মস্করার প্রসঙ্গ। গত ২ মে থেকে ৪ মে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ‘বয়েজ লকার রুম’ বিস্ফোরণ ঘটাল মধ্যবিত্ত ভারতবাসীর চেতনে। দিল্লির অন্যতম অভিজাত স্কুলগুলির ১০-১১ ক্লাসের ছাত্রদের বানানো একটি ইন্সটাগ্রাম গ্রুপের কথোপকথন প্রকাশ করলেন কয়েকজন নারী। সেই তথাকথিত ব্যক্তিগত কথোপকথনে লিপিবদ্ধ ছিল সেইসব ধনী পরিবারে বড়ো হওয়া ছেলেদের নিজেদের সহপাঠী মেয়েদের প্রতি হিংসার উল্লাসভাস্য। ঘনিষ্ঠ পরিসরে এই ছেলেরা শেয়ার করেছেন তাদের চেনা অচেনা বিভিন্ন নারীর ব্যাক্তিগত ছবি। আর এই নারীদের নিয়ে চলেছে ধর্ষণের পরিকল্পনা। এক বন্ধু অপর বন্ধুকে উৎসাহ দিচ্ছে ধর্ষণের, আবার কখনো বা একত্রে ছক বানাচ্ছে গণধর্ষণ সংগঠিত করার। ভারতীয় যুবদের এহেন হিংস্র চেহারা দেখে মানুষ ঠিকঠাক সামলে ওঠার আগেই একের পর এক ভাস্যে প্রকাশ্যে আসতে থাকে এমন অনেকগুলি লকার রুমের কথোপকথনের ইতিবৃত্ত। কলকাতার প্রগতিশীল আখ্যায়িত যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্রের বানানো ‘মডেল ইউনাইটেড নেশনস’ ওরফে মান-এর গুগল ড্রাইভে শেয়ার হয়েছে একাধিক মহিলার ব্যাক্তিগত ছবি। প্রগতিশীলতার চূড়ায় বসে থাকা ছাত্রেরা মহিলাদের ব্যাক্তিগত ছবি ‘উপভোগ’ করে থেমে থাকেননি। এই ছবি ব্যবহার করেই হুমকি চলেছে, ছবি ব্যাক্তিগত রাখার পরিবর্তে এরা যৌন সম্পর্ক দাবি করেছেন এই মেয়েদের কাছ থেকে। আরএক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘এসআরএম ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’-র ছাত্রদের বানানো অনুরূপ একটি চ্যাট গ্রুপ ‘এসআরএম বিউটিস’-এর অনুরূপ কথোপকথন শেয়ার হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়।

এই প্রতিবেদনটি লেখার সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে আসছে একের পর এক মনখারাপ করা অভিজ্ঞতা। নারীর বয়ানে উঠে আসা এইসব অগণিত ভাষ্যে তাঁদের নিছক যৌনতার বস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার, ধর্ষিত হওয়ার, অবদমিত হওয়ার বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার বিষয় হল, এই অপরাধীরা সকলেই তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রেমিক অথবা জ্যেষ্ঠ স্থানীয় কোনো ব্যাক্তি। ক্ষমতার পরিভাষায় বাঁধা সম্পর্কের কৌশলে অপরাধীরা আড়াল করতে চেয়েছে তাদের হিংসা। এই সম্মিলিত হিংসা উদাহরণযোগ্য বটে কিন্তু আকস্মিক নয়। এরূপ নিভৃত পরিসরের পরিহাসগুলি আমাদের অজানা নয়। পরিচিত বন্ধু, প্রতিবেশি, সহপাঠী, সহযাত্রীদের বিভিন্ন আলোচনার টুকরো পৌঁছয় আমাদের মেয়েদের কানে। নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে না পারার ব্যর্থতাকে সাথে নিয়ে এই আলোচনা চলে ভিন্ন লকার-রুমের আলাপচারিতায়। নারীর পোশাক, নারীর সঙ্গী, পেশা, বা সামান্য মতামত সমাজের পিতৃতান্ত্রিক লছমনরেখা পেরলেই নেমে আসে মুহুর্মুহু প্রশ্ন, তিরস্কার বা ঘেন্না। নিয়মভাঙ্গা, গণ্ডি পেরনো মেয়েরা হয় একঘরে। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পৌঁছেও মানব সভ্যতায় নারীকে বেঁচে থাকার নিঃশর্ত স্বাধীনতা পেতে লড়ে যেতে হয় সমাজের শৃঙ্খল মুক্তির লক্ষ্যে। এই নিরন্তর লড়াইয়ের শত্রু পুঁজির নৃশংস দালাল ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র।

পরিবার, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র -- মানুষের জীবনে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি ধর্ষণ সংস্কৃতিতে পুষ্ট। লিঙ্গ নির্ধারিত সামাজিক ভূমিকা মানুষ শিখতে শুরু করে এই প্রতিষ্ঠানগুলির আঙিনায়। পরবর্তীতে ঐতিহ্য বজায় রাখার দায়বদ্ধতায় বা সমাজে গৃহীত হওয়ার তাড়নায় এই স্রোতে ভাসেন মানুষ। ধর্ষণ সংস্কৃতি অর্থাৎ ধর্ষণকে টিকিয়ে রাখার সংস্কৃতি বহমান বর্তমান সমাজের বুকে‌ যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নিরন্তর ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিসরে। সামনে দিয়ে চলে যাওয়া মহিলাকে লক্ষ্য করে প্রকট অথবা চাপা উক্তি, বাসে কনুইয়ের ঠেলা, অন্তর্বাস বেরিয়ে পড়লে চাপা হাসি, মহিলার একাধিক পুরুষ বন্ধু থাকা নিয়ে ঠাট্টা, যৌন স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মহিলাদের নিকৃষ্ট ঠাওরানো, পুরুষ বন্ধুর মেয়েলি হওয়ার জন্য হাসির পাত্র হয়ে ওঠা, পুরুষ তার নারী সঙ্গীকে মর্যাদা দিলে টিপ্পনি -- এসব তো বন্ধ ঘরে নয় প্রকাশ্য দৈনন্দিন জীবনেই অহরহ পাই আমরা। এগুলিরই স্বাভাবিক বিবর্তন ‘বয়েজ লকার রুমে’ চলা হিংস্রতার উন্মত্ত উল্লাস। ধর্ষণ-সংস্কৃতি তো মঙ্গল গ্রহ থেকে আসে না। এই সহিংসতার নির্মাণ সামাজিক ও রাজনৈতিক। একা একা একে ভাঙাও যায় না। ব্যাক্তির জীবনধারা তার চেতনকে তৈরি করে। ব্যক্তি পরিসরে চলা আলোচোনা, মতামত, সমাজকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি গুণমান প্রতিফলন ঘটে ব্যাক্তির মধ্যে। সমষ্টির প্রগতির সাথে ব্যাক্তির প্রগতি ঘটে একইসঙ্গে ব্যাক্তির প্রগতির সাথে সমষ্টির প্রগতি হয়। তাই শুধুমাত্র ব্যাক্তিকে অপরাধী ঠাউরে ধর্ষণ-সঙ্কৃতিকে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। পুঁজিবাদী সমাজের অন্যতম চালিকা শক্তি এই হিংসার সংস্কৃতি যার মাধ্যমে নারীর গর্ভ ও শ্রমকে পুরুষের নিয়ন্ত্রণে রেখে শোষণ-ব্যবস্থাকে নিরন্তর পুনরুৎপাদন করা হয়। ভারতে জাত ব্যবস্থাও টিঁকে থাকে ও পুনরুৎপাদিত হয় এই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। বন্ধ চ্যাটরুমে মস্করাচ্ছলে স্কুলছাত্রদের হিংস্র কথোপকথন দেখিয়ে দেয় আমাদের সমাজের কত গভীরে এই নারীবিদ্বেষী হিংস্রতা লালন করি আমরা।

-- সম্প্রীতি মুখার্জী

খণ্ড-27