হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে মৃত ১২ বছরের জামালো মাকদাম প্রশ্ন করছে – উত্তর দেওয়ার দায় আমাদের
hante

দেশব্যাপী লকডাউনের দ্বিতীয় কিস্তি শুরু হয়েছে এক সপ্তাহ আগে (১৫ এপ্রিল, ২০২০)। সকলেই চিন্তিত। দুশ্চিন্তায় সাধারণ মানুষের অনেকেরই ঘুম ছুটেছে, বহু মানুষের ঘরে বসে অতিরিক্ত বিশ্রামের ফলেও। অপরদিকে অনেক মধ্যবিত্তও আছেন যারা কাজ হারানোর ভয় পাচ্ছেন। সারা ভারত জুড়ে যে কুড়ি কোটি কৃষি বহির্ভুত অসংগঠিত ক্ষেত্রে যে শ্রমিকরা রয়েছেন তাদের মধ্যে যারা ঘরে ফিরতে পেরেছেন তাঁরা  চিন্তায় আছেন, লকডাউন উঠে গেলে আবার কাজ পাবেন কিনা, আর যারা বাইরে আটকে আছেন, এক ঘরে ৬-৮ জন বন্দী দশায়, তাঁরা ভাবছেন, কবে মুক্তি পেয়ে ঘরে ফিরবেন। কর্পোরেট কর্তারাও চিন্তিত, আপাতভাবে দেশের জন্য, আসলে মুনাফার জন্য। এখনকার কর্পোরেট জগতে কোম্পানির প্রত্যেকটি বিভাগই মুনাফা কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়, আর কর্পোরেট কর্তারা নিজ নিজ বিভাগের মুনাফার পরিমাণ দ্বারা মূল্যায়িত হন। তাই মুনাফাই সব, দেশপ্রেমে মুনাফা হলে তাই সই অথবা মুনাফা দ্বেষপ্রেমে হলেও কোনো ক্ষতি নেই। ফলে সকলেই চাইছেন কাজ শুরু করতে, মুখে বলছেন দেশের অর্থনীতির কথা, মনের কথা দেবা ন জানন্তি।   আমাদের দন্ডমুন্ডের কর্তা সরকারও দুশ্চিন্তামগ্ন, ভান করছে কিনা বলতে পারব না। তবে দেশের সব প্রতিবাদ প্রতিরোধকে ঘরে ঢোকানোর সুযোগ পেলে দুশ্চিন্তার থেকে সুচিন্তার আধিক্যই স্বাভাবিক।

লকডাউনের বিস্তার, প্রসার ও সংকোচন একাদিক্রমে ঘোষণা হয়েছে। অর্থাৎ, ২১ দিনের লকডাউনকে আরো ১৯ দিন বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে ২০ এপ্রিল মানে ৫ দিন পর থেকে সেক্ষত্রে কিছু এলাকায় বেশ কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে এবং অনেকগুলি কোভিড প্রবণ এলাকাকে স্পর্শকাতর হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করে সেখানে লকডাউনকে অধিক কঠোর করা হয়েছে। দ্য ওয়্যারের তরফ থেকে করণ থাপারকে দেওয়া ভারতের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক শঙ্কর আচারিয়ার একটি ভিডিও সাক্ষাতকার থেকে জানা যাচ্ছে যে, যে সমস্ত স্থানগুলি হটস্পটের অন্তর্ভুক্ত সেইসব স্থানেই অর্থনৈতিক কাজকর্মের ৬০% কেন্দ্রীভূত আছে ও  সেখানকার সংস্থাগুলি ব্যাঙ্ক ঋণের ৮০% এর খাতক। অর্থাৎ মূল অর্থনৈতিক কাজকর্মের স্থানগুলিই হটস্পটের অন্তর্ভুক্ত। উপরন্তু দেশের প্রায় ৫০ কোটি মানুষও ওই হটস্পটেই বাস করে। অপরদিকে, লকডাউনের যে শিথিলতা তা এতটাই জটিল ও বিমূর্ত যে সেব মেনে কাজ করা প্রায় অসম্ভব। ফলত, ২১ দিনের লকডাউনে অনুমিত কাজকর্মের মাত্রা ৪০-৫০ শতাংশ ছিল, সঙ্কুচিত লকডাউনে সেই কাজের স্তর বেড়ে ৪৫ থেকে ৫৫ শতাংশ হতে পারে। ফলে যে অর্থনৈতিক জটিলতার মধ্যে দেশের অর্থনীতি তলিয়ে যাচ্ছিল সেই জটিলতা কাটিয়ে ওঠার কোন রাস্তা নতুন লকডাউনের নিয়ম দেখাতে পারছে বলে মনে হয় না।

article

 

ভারতে যে এত বিপুল সংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক আছে, যাদের ছাড়া দেশটাই অচল হয়ে যাবে, এবং যারা এক মনুষ্যেতর জীবন যাপন করে সে ব্যাপারে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে কোন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা যে বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল ছিল না তা মার্চের শেষ সপ্তাহ জুড়েই বোঝা গিয়েছিল। ওই বিপুল সংখ্যক শ্রমিকরা যে দেশের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক তা আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল প্রধানমন্ত্রী ও মহারাষ্ট্র এবং গুজরাট সরকার যখন ১৪ তারিখ পর্যন্ত ঘরে ফেরার জন্য অধীর প্রতিক্ষারত শ্রমিকদের কথা না ভেবেই মোদিজি লকডাউনের সময় বাড়িয়ে দিলেন, আর  মুম্বাইএর বান্দ্রায় ঘরে ফিরতে চাওয়া শ্রমিকদের উপর লাঠি চালাল মুম্বাই পুলিশ। একই সময়ে অর্ধভুক্ত অভুক্ত শ্রমিকদের জোর করে আটকে রাখা হল সুরাটে। যখন এই নিবন্ধ লেখা হচ্ছে সেই সময়ে দেশে কোভিড ১৯ এ মৃত মানুষের সংখ্যা ৬৫০ ছাড়িয়েছে। তবে করোনাভাইরাস জনিত লকডাউনের কারণে মৃত শ্রমিকদের কোনো পরিসংখ্যান সরকার দেয় না। এ বিষয়ে ৩ জন গবেষক জি এন তেজেশ, কণিকা ও আমন একটি পরিসংখ্যান তৈরি করেছেন। পূর্নাঙ্গ প্রতিবেদন সম্ভব নয়, কিন্তু লকডাউনের ফলে অন্তত ২০০ জনের মৃত্যুর তালিকা গবেষকরা তৈরি করেছে। মোদির নয়া ভারতবর্ষে কেবল ঘরে ফেরার আকাঙ্খায় শ্রমিক মরছে। ভারতীয় জনতা পার্টির রামরাজত্বে, ছত্তিশগড়ের বিজাপুরের ক্ষুধার্ত আদিবাসী পরিবারের ১২ বছরের একমাত্র কন্যা জামালো মাকদাম তেলেঙ্গানায় কাজ করতে যায়, আর লকডাউনের মধ্যে পড়ে ১৫০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে ঘরে পৌঁছানোর ১২ কিলোমিটার আগে ক্ষুধা তৃষ্ণায় শরীরে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যের অভাবে মারা যায়। জামালো একই সাথে থাপ্পড় মারে সারা দেশের গালে, এক বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় মারে প্রধানমন্ত্রীর সযত্ন লালিত শ্রশ্রুশোভিত গালে, থাপ্পড় মারে আমার আপনার মতো সমস্ত ক্লীব বামপন্থীদের কপোলে। জামালো মাকদাম মরে দেখিয়ে দেয় এদেশের সব ভুয়ো; সর্বশিক্ষা অভিযান ভুয়ো, খাদ্য নিরাপত্তা আইন ভুয়ো, শিক্ষার অধিকার আইন ভুয়ো, শিশুশ্রম নিবারণ আইন ভুয়ো।

দেশের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা থেকে আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্ক যখন ব্যস্ত জিডিপি বা তার বৃদ্ধি কতটা কমবে তা নিয়ে ব্যস্ত তখন সিএমআইই জানাচ্ছে যে, একদিকে শ্রমশক্তিতে অংশ গ্রহণের হার কমেছে ৬%, অন্যদিকে তা সত্বেও বেকারির হার বেড়ে ২৬%-এ পৌঁছেছে। ফলে সব মিলিয়ে বেকার বেড়েছে ১০ কোটির থেকেও বেশি। ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্সের সমীক্ষায় ৭২% সংস্থা তাদের কাজকর্ম ও উৎপাদনে ভয়ানক ঘাটতির কথা বলেছেন, ৭৫% সংস্থা কর্মী সংকোচনের রাস্তায় হাঁটতে হবে বলে মনে করে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, পেট্রোল-ডিজেলের ব্যবহার এগুলিও বিপুল উৎপাদন-মন্দার দিকে দিক নির্দেশ করছে। যে পরিমাণ উৎপাদন হীনতার কথা বলা হচ্ছে তার ফলে ভারতীয় অর্থনীতি ঋণাত্মক অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে চলে যেতে পারে।

amit

 

যদিও সেকথা স্বীকার করতে নারাজ দেশের নেতারা। তারা বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্যাকেজের মধ্য দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির কথা ভাবছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দুদফায় ঋণের ক্ষেত্রে সুবিধে প্রদান করেছে। এক দফায় রেপো রেট বা ব্যাঙ্ক রেটকে এক ধাক্কায় ০.৭৫% কমিয়ে দেওযা হয়, অন্যদিকে রিভার্স রেপো রেটকে দু দফায ০.২৫% করে মোট ৫% কমানো হয় (রেপো হার বলতে যে হারে ব্যাঙ্কগুলি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ঋণ পেতে পারে, ও রিভার্স রেপো হার বলতে ব্যাঙ্কগুলি রিজার্ভ ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে যে হারে সুদ পেতে পারে।)। এছাড়াও শিল্প ক্ষেত্রের জন্য ঋণ পাওয়ার শর্তকে শিথিল করে বা শিল্পে ঋন দেওযার জন্য ব্যাঙ্কগুলির কাছে অর্থের যোগান বাড়িয়ে শিল্পকে চাঙা করার চেষ্টা করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। অপরদিকে অর্থমন্ত্রী রাজকোষ সংক্রান্ত কিছু বন্দোবস্ত করেছেন। প্রথমে তিনি কর প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু সময় সংক্রান্ত ছাড় দেন। পরবর্তিতে তিনি ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা ঘোষণা করেন। নামে ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার হলেও তা সাকুল্যে ১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি নয়। সেই টাকায় গরিবরা কেমন সুফল পেয়েছেন তা ওই দ্বিশতাধিক পরিযায়ী শ্রমিক ও উপরে বর্ণিত জামালো মাকদামের মৃত্যু থেকেই বোঝা যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর একজন ভারতীয়কেও না খেয়ে মরতে দেব না-র গালভরা ঘোষণা যে কতটাই ফাঁপা ও মেকি তা একদম পরিস্কার। এর পরেও সম্ভবত শিল্পের জন্য কর রাজস্ব ছাড়ের প্যাকেজ আসবে, হযতো আরেক দফা ৫০০-১০০০ টাকার মাসিক খয়রাতি বা অতিরিক্ত কয়েক মাসের চাল-গম দিয়ে ওই গরিব ঘরে না ফিরতে পারা পরিযায়ী শ্রমিক বা ঘরে ফেরা অভুক্তদের ক্ষতে প্রলেপ দেওযার চেষ্টা হবে। কর্পোরেট মালিকদের তাোয়াজ করতে শিল্প ক্ষেত্রকে ছাড় দেওযা হবে তার কয়েক গুণ।

এই কোরোনা অতিমারীর মধ্যেই তো ফেসবুকের জুকেরবার্গ আম্বানির জিওতে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করল। এই মহা দুর্যোগের সময়ই তো আম্বানির সম্পদ চিনের জ্যাক মার সম্পদকে ছাড়িয়ে গিয়ে তাকে এশিয়ার সর্বোচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তিতে পরিণত করল, যার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াল ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। দেশের ধনীদের উপরে সম্পদ কর বসিয়েই তো কয়েক লক্ষ কোটি টাকা তোলা সম্ভব। উত্তরাধিকার কর বা এস্টেট ডিউটি বসিয়ে তো রাজস্ব আদায় সম্ভব। ভারতে অতি ধনীদের আয়ের উপরে করের হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় যথেষ্টই কম। আমেরিকায সেই হার ৫০.৩%, চিনে ৪৫%, কানাডায় ৫৪%, ফ্রান্সে ৬৬%। ভারতে তা সর্বোচ্চ ৪২.৭%। বার্ষিক ৫০ লক্ষ টাকা আয় করা ব্যক্তির আয়ের উপরে সর্বোচ্চ কর হার ৩৪.৩%। অতি ধনীদের আয়ের উপরে কর বসিয়েই তো রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু সেই রাস্তায় না হেঁটে দুর্যোগের সুযোগে সরকার বেতনভোগী কর্মচারিদের বেতন কাটতে চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা বন্ধ করে দেওযা হয়েছে আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। বহু রাজ্য সরকার তাদের কর্মীদের বেতন কাটছেন। এই বেতন ছাঁটাই একদিকে সরকারগুলির খরচ কমালেও বাজারে চাহিদাও কমাবে। যা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। একই সঙ্গে সরকারের এই কাজ বেসরকারী ক্ষেত্রে বেতন হ্রাস করাকে ন্যায্যতা প্রদান করবে। আগেই বলেছি বেসরকারী সংস্থাগুলি কর্মী সংকোচনের কথা বলছে। কর্নাটক সরকার আইটি সংস্থাগুলিকে কর্মী লেঅফ-এর পরিবর্তে বেতন কাটতে বলেছে। কোভিড-১৯ এর সুযোগ নিয়ে গুজরাটে কারখানাগুলি ১২ ঘণ্টা কাজের দিন চালু করছে, ৮ ঘণ্টার অতিরিক্ত সময় কাজের জন্য দ্বিগুণ মজুরিতে ওভারটাইমের পরিবর্তে নিয়মিত মজুরিতে কাজের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে সংস্থাগুলি কোভিড-১৯ পরবর্তী পর্যায়ে নিজেদের মুনাফা বাড়াতে পারবে, কমবে শ্রমিকদের আয়। সেটিকে নিরাপদ ও প্রতিবাদহীন করার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন কাজকর্মকে রদ করার দাবি তোলা হয়েছে মালিকদের পক্ষ থেকে। সুতরাং, কোভিড-১৯ এর সব দায় দাযিত্ব শ্রমিকদের ঘাড়ে, সে পরিযায়ী, সংগঠিত বা অসংগঠিত যাই হোক না কেন।

migrant

 

এরপরে যে বেকার মানুষের সারি চলবে, কাজ হারানো যুবকদের, চিকিৎসা না পাওযা বৃদ্ধদের মিছিল, তাদের কী হবে? কোরোনা যখন এসেই পড়েছে, ঘরে যখন বন্দীই করে ফেলা হয়েছে শত কোটি মানুষকে শ্রমিককে তখন কেন বুনিয়াদি প্রশ্ন গুলি করব না? সত্যিই নতুন ভারতের পরিকল্পনার কথা ভাবব না? কেন প্রত্যেক মানুষের জন্য সু-চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করা হবে না? না চিকিৎসা মানে চিকিৎসা বীমা নয়, চিকি়ৎসা মানে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা। কেবল বীমার টাকা দিয়ে বেসরকারি পরিষেবায় গেলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা গোল্লায় যেতে পারে তার উদাহরণ এই কোভিড-১৯-এর অতিমারী দেখিয়ে দিয়েছে ইতালিতে। সেখানে বেসরকারী হাসপাতালের চিকিৎসার পুরো অর্থ সরকার দিত চিকিৎসা বীমার সূত্রে। কিন্তু বেসরকারী হাসাপতাল মুনাফার জন্য যতটা প্রয়োজন ততটাই পরিকাঠামো তৈরি রেখেছে। ফলে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছে বিপুল সংখ্যক রোগী। জার্মানি সরকারী চিকিৎসাকে গুরুত্ব দেওয়ায় অনেকটাই ভালো অবস্থা বজায় রাখতে পেরেছে। ভারতে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপিরমাত্র ১.২-১.৩% খরচ করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি মিলে। অন্যদিকে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করা হয় ৩.১%, অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাতের আড়াই গুণ। কেন্দ্রীয় সরকার স্বাস্থ্য খাতে যা খরচ করে সম পরিমাণ খরচ করে আধাসামরিক বাহিনির জন্য। বোঝাই যায়, সরকারের পেশী শক্তি অনেক বেশি প্রয়োজন দেশের সাধারণ মানুষের সুস্থ সবল জীবনের থেকে। কোরোনা উত্তর বা কোরোনা-সংযুক্ত ভারতে সরকারগুলিকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারি ভারতের কথা ভাবতে বাধ্য করতে হবে।

কোভিড-১৯ আক্রমণে যে ক্ষতির কথা আমরা আলোচনা করছি বা সরকার ও শিল্পপতিরা বিবেচনা করছেন তা অনেকটাই কর্পোরেট জগৎকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। দেশে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাপটাও ওই কর্পোরেটের ক্ষতির নিরিখেই মাপা হবে, হয়ও। কারণ অসংগঠিত ক্ষেত্রে উৎপাদনের পরিমাপ করা হয় কর্পোরেট জগতের উৎপাদনের উপর নির্ভর করে। ফলে বিপুল অসংগঠিত ক্ষেত্রের ক্ষতির কোনো বাস্তব পরিমাণ জানাও যাবে না। বোঝাই যাচ্ছে, এই সরকার শিল্পোৎপাদনকে চাঙা করতে আরো কিছু বরাদ্দ রাজকোষ থেকে করবে, ছিটেফোটা অসংগঠিত ক্ষেত্রের ভাগেও জুটবে। ভারতে ২০১৮-১৯ সালে টাকার অঙ্কে মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল মাসিক ১০,৫৩৪ টাকা। সেই পরিমাণ ২০১৯-২০ সালে বেড়ে ১১ হাজার টাকা অন্তত হবে বলে আসা করা যায়। প্রত্যেক দেশবাসীকে কেন নিশ্চিত ন্যুনতম আয়ের বন্দোবস্ত করবে না সরকার? কেন সরকার প্রত্যেক ভারতবাসীর জন্য সেই মাথাপিছু আয়ের অন্তত তিনভাগের একভাগ নিশ্চিত করতে পারবে না? যে রাষ্ট্র ডিজিটাল ভারতের কথা বলে, আধার, আরোগ্য সেতু, ভীম, ডিজিটাল রেশন কার্ড এত আধুনিকিকরণের মাধ্যমে দেশ চালায়, সেই রাষ্ট্র কেন অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য, খেত মজুরদের জন্য যথোপযুক্ত আয়তনের আশ্রয়ের সুবন্দোবস্ত করতে পারবে না? এরকম সমস্ত বুনিয়াদি নাগরিক সুবিধের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি নিয়ে দাবি তোলার সুযোগ এনে দিয়েছে এই দেশ জোড়া দুর্যোগ।

বোধ হয়, সমস্ত কালো মেঘের সঙ্গে থাকা বিদ্যুতরেখা কথাটি এখানে বিশেষ প্রযোজ্য।  প্রশ্নগুলি সহজ আর উত্তরটাও জানা থাকলেও, সেই উত্তরটাকে পাল্টাতেই হবে। সেই প্রশ্ন তোলা ও উত্তর পাল্টানোর দায় এড়ানো যাবে না, এড়াতে দেবে না জামালো মাকদাম।

খণ্ড-27