নজরুল স্মরণে শ্রদ্ধার্ঘ্য
naz

নজরুল প্রথমত একজন কবি কিন্তু তিনি শুধুই একজন কবি নন। তিনি সংগ্রামী, বিদ্রোহী। কবিতাকে তিনি সংগ্রামের, দ্রোহের ভাষা হিসেবে দেখতেন। তাঁর বিদ্রোহ পরাধীনতার বিপক্ষে, শোষণ, শাসন, অন্যায়ের বিপক্ষে। সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ আর জাতপাতের বিরুদ্ধে। শ্রেণি শোষণের বিরুদ্ধে তো বটেই। নারী পুরুষ অসাম্যও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। এগুলির বিরুদ্ধে দ্রোহকে নজরুল তাঁর কবি জীবনের একেবারে প্রথম পর্ব থেকেই নিজস্ব অভিজ্ঞান করে তুলেছিলেন। সেকারণেই তিনি পরিচিত হয়ে যান বিদ্রোহী কবি হিসেবে। যে কবিতার সূত্রে তাঁর এ পরিচয় প্রাপ্তি, সেই বিখ্যাত লাইনগুলিকে আর একবার স্মরণ করা যাক –

মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উত্‍পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না –
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।

দ্বিধাহীনভাবে নজরুল তাঁর কবি জীবনের শুরুতেই এখানে স্পষ্ট করে দিচ্ছেন তাঁর লেখালেখির উদ্দেশ্য।

kazi

 

নজরুলের কবিতা গান স্বাধীনতা সংগ্রামে খুব কাজে লেগেছিল, মানুষকে প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত করত তাঁর লেখা আর সুর – এ আমরা জানি। শুধু তাঁর বই নিষিদ্ধ করেই শাসক নিশ্চিন্ত হতে পারেনি৷ অগ্নিবীণার কবিকে স্থিমিত করতে চেয়ে তাঁকেও জেলে পাঠিয়েছিল। তবুও থামানো যায়নি তাঁর বিদ্রোহী সত্তাকে। অনেকে সেই সময়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন – নজরুলের কবিতা যুগের প্রয়োজন মিটিয়ে কতখানি চিরকালীন হতে পারবে। এই প্রসঙ্গে শাশ্বত রাবীন্দ্রিক উচ্চারণের প্রসঙ্গও টানা হয়েছিল। নজরুল এই সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তাঁর আমার কৈফিয়ৎ কবিতায়। সমকালীন জীবনযন্ত্রণাকে ভাষা দিতেই তাঁর কবিতা লেখা। এই বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়াই তাঁর উদ্দেশ্য। সেই প্রাথমিক উদ্দেশ্য পালন করেই তিনি খুশি। তাঁর কবিতা মহাকালের দরবারে নান্দনিকতার কোন স্তরে অবস্থান করল, তা নিয়ে তিনি আদৌ ভাবিত নন –

বন্ধুগো আর বলিতে পারিনা, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে,
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসেনাক মাথায়, বন্ধু, বড় দুঃখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও বন্ধু যাহারা আছ সুখে!
পরোয়া করিনা, বাঁচি বা না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথার উপর জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে!
প্রার্থনা ক’রো – যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!

আমরা আজ তাঁর লেখা ফিরে পড়তে গিয়ে বুঝতে পারি, তাঁকে যুগের কবি হিসেবে চিহ্নিত করে যারা নান্দনিকতার বিচারসভা বসিয়েছিলেন, তাদের দৃষ্টিকোণ কতখানি খণ্ডিত ছিল। শিল্প সাহিত্য নান্দনিকতার বাঁধা গত মেনে চলে না। নজরুলের কাব্যে যে হৈ চৈ আর উচ্চকিত উচ্চারণ আছে, সেটা শুধু সমকালীন বাস্তবতাকে ধারণ করতেই কাজে লাগেনি। কবিতার ধারা যে নতুনত্বের প্রয়াসী, রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কবিতায় সেই নতুনত্ব সঞ্চারের ক্ষেত্রে তাঁর কবিতার এই বিশেষ রীতি অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ নামক প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন যে রবি প্রতিভার বলয়ের মধ্যেই যখন কালিদাস রায়, কুমুদ রঞ্জন মল্লিক, যতীন্দ্রমোহন বাগচীরা হারিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন এই বিদ্রোহের ভিন্নতর উচ্চারণই নজরুলকে স্বতন্ত্র পথ খননে, নিজস্ব কবিতার ভাষা খুঁজে পেতে সাহায্য করল। নজরুল শুধু শাসকের চাপিয়ে দেওয়া আইন কানুন, দৃষ্টিকোণটিকেই ভাঙেননি, কবিতার প্রচলিত ধরন ও ব্যাকরণকে ভেঙেই নতুন নান্দনিকতা তৈরি করেছেন বাংলা কবিতার ইতিহাসে।

নজরুল সাম্যের কথা বলেছিলেন সরাসরি। তাঁর “গাহি সাম্যের গান” কবিতাটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ম্যানিফেস্টো ধরনের।

tan

 

গাহি সাম্যের গান–
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি? – পারসি? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কনফুসিয়াস? চার্বাক-চেলা? বলে যাও, বলো আরও!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক –
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব পড়ে যাও, য্ত শখ –
কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? – পথে ফুটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
কেন খুঁজে ফের’ দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি -কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!

naz

 

নানা লেখায় অর্থনৈতিক সাম্য, ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত উদার মানবতাবাদ, জাতপাতহীন, লিঙ্গ বৈষম্যহীন, শ্রেণি শোষণহীন সমাজ তৈরির স্বপ্ন তিনি প্রকাশ করেছেন। এই স্বপ্ন নিয়েই বন্ধু মুজফফর আহমেদের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। এই পথকেই মনে করেছিলেন মুক্তির দিশা।

পুরনো আধিপত্যবাদ ও গোঁড়ামি ভেঙে তুরষ্কে কামাল পাশা যখন ইসলামিক দুনিয়াকে আধুনিক প্রগতির সঙ্গে সমন্বিত করছেন, তখন এই দেশ থেকে যাঁরা তাঁকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানান, নজরুল ছিলেন তাঁদের প্রথম সারিতে। তাঁর কামাল পাশা কবিতাটি গোঁড়ামিমুক্ত আধুনিক নজরুলের আরেকটি দিককে আমাদের সামনে উপস্থিত করে।

ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই !
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর সে সামাল সামাল তাই !
    কামাল ! তু নে কামাল কিয়া ভাই !
        হো হো কামাল ! তু নে কামাল কিয়া ভাই !

নজরুল সংগ্রামী, বিদ্রোহী। আবার নজরুল মরমীও। এই মরমী নজরুলের ছবি রয়েছে তাঁর গানে। যে নজরুল ইসলামিক ঐতিহ্য থেকে অজস্র প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন, আরবী ফারসী তুর্কি শব্দে সাজিয়ে তোলেন তাঁর রচনাকে, সেই নজরুলই অক্লেশে কালি আর কৃষ্ণকে নিয়ে লিখতে পারেন মরমীয়া গান। এই উদারতার নামই নজরুল যাকে আমাদের সাম্প্রদায়িক হিংসা বিধ্বস্ত ভারতে আজ বড় প্রয়োজন।

-- সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-27