কৃষিপণ্য বাণিজ্য অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার এবং আমফান ঘূর্ণিঝড়কে জাতীয় বিপর্যয় হিসাবে ঘোষণার দাবিতে ২৫ জুন সারা রাজ্যের ব্লকে ব্লকে কৃষক বিক্ষোভ কর্মসূচী
kap

ভয়াবহ আমফান ঘুর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত দঃ ২৪ পরগণা, উঃ ২৪ পরগণা, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ মেদিনীপুর, কলকাতা সহ রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ বিপর্যস্ত। একদিকে প্রায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি, প্রচুর গবাদিপশুর জীবনহানি, ধান, পাট, সব্জি, তিল সহ নানাবিধ ফল ও ফুল চাষ, পোল্ট্রি ফার্মের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষের ঘরবাড়ি ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। অপর দিকে বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলিতে মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগসুবিধা না থাকা – সব মিলিয়ে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এই বিশাল বিপর্যয়কে জাতীয় বিপর্যয় হিসাবে ঘোষণা করতে হবে – বাংলার মানুষের এই ন্যায্য দাবিকে কেন্দ্র সরকার গুরুত্ব দিতে চাইছে না। এ সব নিয়ে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের জন্য আমরা বিগত মে মাসের ৪ তারিখে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কোনো উত্তর আমরা পাইনি। দেখা যাচ্ছে এ রাজ্যের কৃষক ও কৃষিজীবী মানুষেরা ক্ষতিপুরণ হিসাবে কোনো কিছুই পেলো না। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের টাকা নিয়ে চলছে বিপুল দুর্নীতি ও দলবাজি।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার কৃষিপণ্য বাণিজ্য অর্ডিন্যান্স জারি করেছে যাতে স্বাধীনতার পর কৃষি ও কৃষকদের এক নজিরবিহীন সংকটের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সারা দেশের কৃষকদের দাবিকে মেনে নিয়ে ফসলের উৎপাদন খরচের দেড়গুন দাম সুনিশ্চিত করা হলো না। ঋণমুক্তির জন্য নেওয়া হলো না কোনো পদক্ষেপ। লকডাউন ক্ষতিপূরণের কোনো ঘোষণাই নেই। শস্যবীমা বা নানারকম কৃষক কল্যাণ প্রকল্পগুলিকে কাগজে কলমেই রাখা হলো। এখন লকডাউন সংকটের সময়কালে স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় অর্ডিন্যান্স চাপিয়ে দিয়ে কৃষি ক্ষেত্রে কর্পোরেট পুঁজিপতিদের দখলদারী কায়েম করা হলো। ওদের হাতে কৃষি পণ্যের ব্যবসা বানিজ্যের সমগ্র ব্যবস্থাকে তুলে দেওয়া হলো। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ সহ কৃষকের স্বার্থরক্ষায় যতটুকু সরকারী বিধি ব্যবস্থাগুলি ছিলো সেগুলিকে উঠিয়ে দেওয়া হবে, ফলে কৃষকদের কর্পোরেট পুঁজিপতিদের গোলামে পরিণত করা হবে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনের মাধ্যমে কৃষিপণ্যের মজুত ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়ার কারনে বড় ব্যবসায়ীরা যত খুশি পণ্য মজুত করতে পারবে। কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে তারা নিজেদের সুবিধা মতো কৃষি পণ্যের দাম বাড়াবে, অথচ চাষিরা তাঁদের রক্ত ঘামে উৎপাদিত ফসলের লাভজনক দাম পাবে না। দেশী বিদেশী পুঁজিপতি-ব্যবসায়ী-আমলা-অসাধু রাজনৈতিক নেতাদের চক্র কৃষিপণ্যের ব্যবসা থেকে মুনাফার পাহাড় তৈরি করবে। কৃষিপণ্য বাজার কমিটি আইন (APMC) তুলে দেওয়ার ফলে কৃষিপণ্যের ফাটকাবাজি মজুতদারী বাড়বে। এ ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলির যে অধিকার রয়েছে অর্ডিন্যান্সে তাকে খর্ব করা হয়েছে। কৃষি পণ্যের বাজার বা কিষাণ মান্ডিগুলি সীমিত ভাবে হলেও চাষিদের দরকষাকষি ও ফসলের সরকারী ক্রয়ের জন্য নির্ধারিত। সেই ব্যবস্থাটা তুলে দিয়ে চাষিদের চরম লোকসান ও ঋণফাঁদের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। ব্যবসায়ী ও পু্ঁজিপতিদের চুক্তিচাষের অবাধ অধিকার দেওয়া হয়েছে। এতে ঘুরপথে কৃষিজমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ করে চালু করা হবে কর্পোরেটদের জমি গ্রাস অভিযান।  বাস্তবে ওরাই কৃষি উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রন করবে। ফলে আমাদের দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হয়ে পড়বে মারাত্মক ভাবে বিপন্ন। বিগত বছরগুলিতে আমাদের দেশে কৃষিপণ্যের আমদানী ক্রমশ রপ্তানির থেকে বেড়ে চলেছে। আগামীদিনে সেটা আরও বেড়ে যাবে। উন্নত দেশের অত্যধিক পরিমাণে কৃষি ভর্তুকিযুক্ত পণ্য আমাদের দেশের কৃষি পণ্যের বাজারকে নষ্ট করে দেবে। ফলে নতুন নিয়ম বিধির মধ্য দিয়ে চাষিদের ফসলের ভালো দাম পাওয়ার যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।

সমগ্র কৃষি ক্ষেত্রে ৫০-৬০ শতাংশ ছোট ভাগচাষি-চুক্তি চাষিরা রয়েছে। চুক্তি চাষের প্রভাবে এদের জীবন জীবিকা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হবে। কৃষিমজুরদের জীবিকাও হয়ে উঠবে বিপন্ন। তীব্রতর হয়ে উঠবে গ্রামীণ বেকারী।

সব মিলিয়ে এই কৃষি সংস্কারে লাভবান হবে বড় বড় কোম্পানিরা। তৈরি হবে কোম্পানি রাজ।

এ রাজ্যে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকরা অমানবিক দূর্দশার মধ্যে রয়েছে। তাঁদের ঘরে ফেরানো, স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা, সুরক্ষা দেওয়া, কাজ ও খাদ্য সরবরাহ করা প্রভৃতি প্রশ্নে চলছে চুড়ান্ত সরকারী অব্যবস্থা।

পিএম কিষাণ নিধির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের বছরে তিন দফায় ৬ হাজার টাকার যে সহায়তা প্রকল্প চালু করেছে এ রাজ্যে সেটাকেও কার্যকরী করা হচ্ছে না।

বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকে সম্পূর্ণ বেসরকারীকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে, যা কৃষকদের মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

আমাদের দাবি –

  • ১) কৃষি বানিজ্য অর্ডিন্যান্স বাতিল করতে হবে।
  • ২) অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধন করে কালোবাজারি, মজুতদারীকে বৈধ করে তোলা চলবে না।
  • ৩) কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম গ্যারান্টি করতে সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। উৎপাদন খরচের দেড়গুন দামে গ্রামে ক্যাম্প করে  প্রকৃত চাষিদের থেকে ফসল কেনা সুনিশ্চিত করতে হবে।
  • ৪) চুক্তিচাষের নামে কৃষিকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া চলবে না।
  • ৫) সমস্ত  কৃষকদের সব ধরনের কৃষিঋণ মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
  • ৬) ফসলের সরকারী সংগ্রহ ও গণবন্টনকে উঠিয়ে দিয়ে কর্পোরেটদের হাতে কৃষিবানিজ্যকে তুলে দেওয়া চলবে না।
  • ৭) সুপার সাইক্লোন আমফানকে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করতে হবে। দ্রুত ও যথাযথ ত্রাণ ও পূনর্বাসন প্যাকেজের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • ৮) আমপান ঝড়ে ও লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কৃষকদের এ্যাকাউন্টে ২৫ হাজার টাকা লকডাউন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ভাগ ও চুক্তি চাষিরা যাতে সমস্ত রকম সরকারী সুবিধা পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
  • ৯) বনাধিকার আইন কার্যকরী করে আদিবাসী ও বনবাসীদের জল জঙ্গল জমির অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।
  • ১০) এ রাজ্যে পিএম কিষাণ প্রকল্পের ৬ হাজার টাকা ও কৃষক বন্ধু প্রকল্পে ৫ হাজার টাকা প্রতিটি কৃষককে দিতে হবে।
  • ১১) কৃষিমজুর ও গ্রামীণ গরিবদের জব কার্ডে ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে
  • ১২) কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের কাজ চালু করতে হবে। কৃষিকাজকে এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ২০০ দিনের কাজ ও ৬০০ টাকা মজুরি দিতে হবে।
  • ১৩) বিদুৎ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বেসরকারীকরণ করে কৃষিক্ষেত্রে মাশুলবৃদ্ধি ও রাজ্যের অধিকার খর্ব করা চলবে না।

ধন্যবাদান্তে, 
এআইকেএসসিসি পঃ বঙ্গ শাখার পক্ষে অমল হালদার, আহ্বায়ক 
কার্তিক পাল, সাংগঠনিক সম্পাদক 

খণ্ড-27