বিহার নির্বাচনকে হাতিয়ে নেওয়ার বিজেপি-জেডিইউ-র চক্রান্তকে ব্যর্থ করুন
ddar

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ – ভারতে চলা লকডাউনের সুদীর্ঘ পর্বে যাঁর দেখা তেমন মেলেনি – গত ৭ জুন বিহারের উদ্দেশ্যে এক ডিজিটাল সভায় ভাষণ দিলেন। শাহর কথায় এটা শুধু ‘জন সংবাদ’ বা ‘জনগণের সঙ্গে সংযোগ’ হলেও এটা কিন্তু এ বছরের শেষে হতে চলা বিজেপির নির্বাচনী প্রচারকেই কার্যত শুরু করে দিল। এই সমাবেশ আবার মোদীর প্রধানমন্ত্রীত্বের ষষ্ঠ বছরের মহাসমারোহে উদযাপনের অংশও ছিল, যে উদযাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল কোভিড-১৯ অতিমারির মোকাবিলায় মোদীর তথাকথিত সাফল্যের ঢাক পিটিয়ে নিজেদের পিঠ চাপড়ানো। অমিত শাহ যেমন তাঁর ভার্চুয়াল সমাবেশ ঘটালেন, একইভাবে নীতীশ কুমারও সেদিনই জেডিইউ নেতৃবৃন্দ ও ক্যাডারদের সঙ্গে ডিজিটাল মাধ্যমে আলোচনা চালিয়ে তাঁর প্রচার শুরু করলেন। অন্যভাবে বললে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী দুজনেই সরকারি পদাধিকারী হিসাবে নয়, নিজ-নিজ দলের নেতা হিসাবেই জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখলেন।

বিহারের পরিস্থিতি বিবেচনা করা যাক। ভারতের অন্য সব রাজ্যের মতো বিহারও মহামারী ও লকডাউনের জোড়া ধাক্কায় টলমল করছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংকট-জর্জরিত হওয়ায় বিহারে কোভিড-১৯-এর চ্যালেঞ্জ রীতিমতো দুরূহ হয়ে উঠেছে, তবে লকডাউনই বিহারকে সাংঘাতিক ধাক্কাটা দিয়েছে। ভারতে সব রাজ্যের মধ্যে বিহারের পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যাই সম্ভবত সর্বাধিক। এবং কী কেন্দ্র, কী রাজ্য, কোনো সরকারই পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থায় কোনো আন্তরিকতা না দেখানোয় বিহারের পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করে নেওয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। তাঁরা হয় পায়ে হেঁটে কিংবা সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরেছেন, অথবা চেপেছেন কালিমালিপ্ত শ্রমিক স্পেশ্যালে। আর ফিরে এসে কোয়ারান্টিন কেন্দ্র নামধারী নির্যাতন কক্ষগুলোতে বন্দী হয়েছেন।

poli

 

গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো লকডাউন চলাকালীন বিহারে বিপক্ষ দলের কর্মীবৃন্দ, দলিত, মুসলিম, অন্যান্য নিপীড়িত সামাজিক গোষ্ঠী এবং নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে। এবং অপরাধের এই সমস্ত ঘটনায় দায়ের হওয়া অভিযোগ থেকে জানা যাচ্ছে, সামন্ততান্ত্রিক-সাম্প্রদায়িক-দুর্বৃত্ত গাঁটছড়ার পিছনে শাসক বিজেপি-জেডিইউ জোটের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। গোপালগঞ্জের তিন হত্যায় প্রধান অভিযুক্ত স্বয়ং জেডিইউ বিধায়ক অমরেন্দ্র পাণ্ডে। তাকে গ্ৰেপ্তার  এবং বিধানসভা থেকে বরখাস্ত না করে নীতীশ সরকার সিপিআই(এমএল)-এর সেই সমস্ত নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতেই ব্যস্ত থাকছে যাঁরা হত্যাস্থল পরিদর্শন করে স্থানীয় জনগণের সাথে কথা বলেছিলেন। এরপর মধুবনিতে দলিত হত্যার যে ঘটনা ঘটে তাতে মূল অভিযুক্ত বিজেপি নেতা অরুণ কুমার ঝা।

লকডাউনের গোটা পর্বেই বিহারের জনগণ এই সমস্ত ইস্যুতে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বস্তুত, অমিত শাহ এবং নীতীশ কুমারের ডিজিটাল সমাবেশগুলোও সারা রাজ্যেই ধিক্কারের মুখে পড়ে। অনাহারগ্ৰস্তদের জন্য রেশন ও ত্রাণের ব্যবস্থা, কোয়ারান্টিন কেন্দ্রগুলোর সুযোগসুবিধা, আটকে পড়া শ্রমিক ও ছাত্রদের নিরাপদে ঘরে ফেরা, প্রকল্প কর্মী ও করোনা যোদ্ধাদের পিপিই এবং মহামারী বেতন প্রদান, লকডাউনে ক্ষতিগ্ৰস্ত শ্রমিক ও কৃষকদের জন্য রোজগার সহায়তা, এবং স্বনিযুক্তি প্রকল্পের গোষ্ঠীগুলোতে, মাইক্রোফিনান্স প্রকল্পগুলোতে এবং লাইভলিহুড মিশনে যুক্ত মহিলাদের ঋণ মুকুব – এই সমস্ত ইস্যুতে লকডাউনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও ধারাবাহিক প্রতিবাদ হয়েছে। বিহার যথার্থ অর্থেই ‘ঘরে থাকুন’-এর বিধানকে রূপান্তরিত করে ‘ঘর থেকে প্রতিবাদ’-এর স্পিরিটের জোরালো আত্মঘোষণা ঘটিয়েছে।

vote

 

যেমন ভাবা গিয়েছিল সেরকম ভাবেই অমিত শাহ ও নীতীশ কুমার বিহারকে জর্জরিত করা এই সমস্ত জ্বলন্ত ইস্যুগুলো সম্পর্কে মুখে কুলুপ আঁটেন। এই সংকটের মধ্যে একটা সুযোগের সন্ধান পেয়ে তাঁদের মুখে বরং উল্লাসের ছটা দেখা গেছে। বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং উপ-মুখ্যমন্ত্রী সুশীল মোদী গত দু-সপ্তাহ ধরে এই ইঙ্গিত দিয়ে আসছেন যে, এবার বিহারে ডিজিটাল নির্বাচন হবে এবং ভোটারদের আর বুথে গিয়ে ভোট দিতে হবে না। অমিত শাহ বলছেন ডিবিটি (সুবিধার সরাসরি হস্তান্তর) দুর্নীতির অবসান ঘটিয়েছে, আর সুশীল মোদী বলছেন যে, ভোট গ্ৰহণ করার জন্য কোন বুথ যেহেতু থাকবে না, ডিজিটাল মাধ্যমে ভোট দান ব্যবস্থা তাই বুথ দখল প্রথার লোপ ঘটাবে! এই সমস্ত দাবি ও প্রস্তাব শুধু যে চূড়ান্ত রূপে অসত্য তাই নয়, এগুলো সম্পূর্ণরূপে দুরভিসন্ধিমূলক ও শঙ্কাজনক।

বস্তুত, ডিবিটি বা সুবিধার সরাসরি হস্তান্তরের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় শুধু বাজেট বক্তৃতায় ও নির্বাচনী জনসভায়। বাস্তব জীবনে ভারত এখন সমস্ত সাধারণ পরিবারগুলোর জন্যই ডিবিটির দাবি জানাচ্ছে। বর্তমান সংকটের মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ যে প্রস্তাবটা উঠে এসেছে তা হল, রোজগারে মদত দিয়ে জনগণের ভোগব্যয় ও চাহিদাকে বাড়িয়ে তুলতে আয়কর দেয় এমন পরিবারগুলোকে বাদ দিয়ে অন্য সমস্ত পরিবারের কাছে ছ-মাস ধরে প্রতি মাসে নগদ ৭৫০০ টাকা হস্তান্তর করতে হবে। এর বিপরীতে সরকার কিন্তু শুধুই কিছু উদ্যোগের জন্য ঋণের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। আর, কোনো দুর্নীতিও বন্ধ হয়নি, উল্টে তাদের বহর বেড়েছে। সৃজন দুর্নীতির আকার পশুখাদ্য দুর্নীতির তুলনায় অনেক বড় বলে দেখা গেছে, তবে তাদের মধ্যে ফারাকটা থেকেছে শুধু সুকৌশলে দুর্নীতিকে ধামাচাপা দিতে পারার সামর্থ্যের মধ্যে! এখন আর তদন্ত হয় না, এবং অস্বস্তিকর সত্যের উন্মোচন যখন ঘটতে থাকে, তখন যারা দুর্নীতি ফাঁস করছে তাদের  এবং আরটিআই কর্মীদের নিয়মিতভাবেই দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়, মামলাগুলো ও বিচারপতিদের নিমেষে বদল করা হয় এবং মিডিয়াকে নিজেদের দিকে টেনে শিরোনামগুলোকে পছন্দসই করে হাজির করা হয়। ইভিএম এবং ভিভিপিএটি ব্যবস্থা বুথ দখল এবং অন্যান্য নির্বাচনী দুর্নীতির অবসান ঘটিয়েছে বলে বিজেপি দাবি করলেও এগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা এবং স্বচ্ছতা সম্পর্কে বড় ধরনের সংশয় কিন্তু রয়ে গেছে। এখন আবার নির্বাচনকে একটা ডিজিটাল কর্মকাণ্ডে পরিণত করে বিজেপি নির্বাচনকে আরও ঘোলাটে করে তুলতে চাইছে। কেননা, এই ধারায় নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পাবে এবং তা আরও কম অংশগ্ৰহণমূলক হবে এবং ফলে অনেক বেশি সন্দেহজনক ও অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠবে।

সংকেতগুলো যথেষ্ট জোরালো ও সুস্পষ্ট হয়েই দেখা দিচ্ছে। যে শক্তিগুলো কয়েক দশক আগেও বুথ দখল করে দরিদ্রদের ভোট দিতে দিত না, গত বিধানসভা নির্বাচনের পর যারা রায়কে ছিনিয়ে নিয়েছিল, তারাই আজ নির্বাচনকে হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। বিহারের বিজেপি-জেডিইউ সরকার খুব ভালো করেই জানে যে, লাগাতার অকর্মণ্যতা এবং ধারাবাহিক বিশ্বাসঘাতকতা ও ব্যর্থতার জন্য তারা জনগণের বিপুল ক্রোধের মুখে দাঁড়িয়ে। মুজফ্ফরপুরের আশ্রয় শিবিরে ধর্ষণ ও সৃজন কেলেঙ্কারি থেকে সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং পরের পর দলিত ও অন্যান্য সমাজ কর্মীদের হত্যা, বিহারের বিভিন্ন অংশের শ্রমিক ও নারীদের গণআন্দোলনের পাশবিক দমন, জনগণের ওপর চলতে থাকা ‘করোনা যুদ্ধ’ – এ সবই নীতীশ-মোদী সরকারকে বিহারের সম্ভবত সবচেয়ে নির্মম ও দরিদ্র-বিরোধী সরকার রূপে উন্মোচিত করে দিয়েছে।

এই সরকার যদি মনে করে থাকে যে জনগণকে অপ্রস্তুত এবং অধিকার বর্জিত করে তুলে তারা নির্বাচনকে হাতিয়ে নিতে পারবে, তবে সরকারকে ভুল প্রমাণিত করে তোলার দায়টা বিহারের অদম্য গণতান্ত্রিক স্পিরিট এবং জনগণের আন্দোলনের গৌরবময় ঐতিহ্যের ওপরই বর্তাচ্ছে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় ৯ জুন ২০২০) 

খণ্ড-27