লকডাউনে কিছু অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি
loc

গ্রামীণ এলাকায় নিশ্চিন্তপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের আটটি বুথেই আমাদের সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির সক্রিয়তা রয়েছে। এখানে আমাদের সদস্যরা কেউ নির্মাণ শ্রমিক, কেউ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কর্মী। এরা ঋণ নিয়ে মাছ চাষ, সবজি চাষ, সেলাই ইত্যাদি করেন। অসংগঠিত শ্রমিকও আছেন। এরা মাছ, সবজি বিক্রি করেন। রাখী বাঁধেন, ঝুড়ি বাঁধেন, জরির কাজ করেন। স্বামীরা কেউ ভ্যান বা চালান। রাজমিস্ত্রি, রং মিস্ত্রির বা ছোটখাটো কাজ করেন। শহরাঞ্চলে বজবজ ও পূজালি পৌরসভা অঞ্চলে মহিলা সমিতি কাজ করছে। এখানে মিড ডে মিল কর্মীরা আমাদের সদস্য। তারা স্থানীয় প্রোগ্রামে অংশ নিলেও তৃণমূলী সন্ত্রাসে বাইরের বড় কর্মসূচীতে ইদানিং থাকতে পারেন না।

কেন্দ্রীয় সরকারের বিনা নোটিশের লক ডাউনে ব‍্যাপক শ্রমজীবী মহিলা চূড়ান্ত অসহায় অবস্থায় পড়েছেন। একশো দিনের কাজ বন্ধ। হাতে পয়সা নেই। খালে বিলে মাছ ধরে, পুকুরের শাক তুলে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করে কোনো রকমে চলছে। স্বাস্থ্য সচেতনতা এদের কাছে আশা করা যায় না। বজবজ এলাকায় জনা কুড়ি শ্রমিক ভিন রাজ্য থেকে গ্রামে ফিরেছে। বৈষ্ণবপাড়া ও জামালপুর অঞ্চলে প্রথম যখন শ্রমিকরা বাড়িতে ফিরল, পঞ্চায়েত থেকে রুটিন মাফিক একবার শুধু স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলে গিয়েছিল। কিন্তু কতটা বাস্তবে মানা হচ্ছে, তা নিয়ে নজরদারি ছিল না। আমাদের মহিলা সমিতির নেত্রী দেবযানী বিষয়টি নিয়ে গ্রামবাসী, আশাকর্মী, পঞ্চায়েত সদস্য সবার সঙ্গে বারবার কথা বলে গুরুত্বটা বোঝাতে পারেন। এমনকি থানাতেও গিয়েছিলেন। তবে আলাদা কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা যায়নি। হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে। পরে শ্রমিক স্পেশালে যারা ফিরেছেন তাদেরও একই কথা বলা হয়েছে। একটা মাত্র ঘর, তাও আবার আমফানে চালের টিন উড়ে গেছে।

night

 

বজবজ গ্রামাঞ্চলে, নিশ্চিন্তপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে আমফানের ঝড়ে খুব ক্ষতি হয়েছে। আমাদের কাজের এলাকায় ২২টি পরিবারের ঘর ভেঙে গেছে। দেওয়াল পড়ে গেছে, চাল উড়ে গেছে। সবজি ও বোরো ধানের চাষে খুব ক্ষতি হয়েছে। পঞ্চায়েত সদস্য রুটিন বলে দিয়েছে। কিন্তু করণীয় কিছুই নেই। বিডিও বা পঞ্চায়েত থেকে এখনও ক্ষয় ক্ষতি দেখতে কেউ আসেনি। দেবযানীর নেতৃত্বে মহিলারা পাড়ায় গিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে একটা লিস্ট বানিয়েছে – কার কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফর্ম ফিল আপ করছে। এতে এলাকায় আমাদের সমিতি ও পার্টি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ভালো প্রভাব পড়েছে। দেবযানী ও অঞ্জনার নেতৃত্বের এটা কেন্দ্র করে প্রচার চলছে। বাখরাহাটে পূর্ণিমার নেতৃত্বে প্রচার চলছে। ওখানে সম্প্রতি মহিলা সমিতি মহীয়সী নারী ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের দু’শো বছরের জন্মজয়ন্তী পালন করে পার্টির সহযোগিতায়। প্রায় ১৫ জন সমিতি সদস্য, স্বাস্থ্যকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও অন্যান্যদের উপস্থিতিতে তাঁর সেবাপরায়ণতার আদর্শ নিয়ে বক্তব্যও রাখে মহিলারা।

১০০ দিনের কাজ কিছু মহিলা পেয়েছে। সব জায়গায় শুরু হয়নি। লকডাউনে সরকার শুধু চাল দিয়েছে। আর কিছু না দেওয়ার ফলে আমরা গত ১৮ মে বিডিও-তে গেছিলাম। সবাই সরব হয়েছে – শুধু চাল কি চিবিয়ে খাব। আয়ারলা-র সঙ্গে মহিলা সমিতির প্রায় ৫০ জন বিক্ষোভে ছিল। আমাদের দাবি ছিল-পরিবার পিছু মাসে ৫০ কেজি খাদ্যশস্য, ভোজ্য তেল, ২০০ ইউনিট ফ্রি বিদ্যুৎ, ২০০ দিনের কাজ, দিন ৫০০ টাকা মজুরি।

মহিলা সমিতি ও পার্টির উদ্যোগে তিনবারে ৮টি বুথের ২০৫টি পরিবারকে সাহায্য দেওয়া হয়েছে। ঝড়ের এই ক্ষতির উপর মদের দোকানে ভিড়। এর ফলে গার্হস্থ্য হিংসা বাড়তে শুরু করছে। লকডাউনে আমার উপলব্ধি-সংগঠনকে বাঁচিয়ে রাখতে ও কর্মীদের উদ্যোগ বাড়াতে কর্মীদের সঙ্গে রোজকার যোগাযোগ রাখাটা খুব দরকার। আমি কাজের এলাকায় যেতে না পারলেও ফোনে অনবরত খোঁজখবর নিয়েছি, কথা বলেছি। দেখেছি বিভিন্ন ব্যাপারে ওরা আগের থেকেও বেশি উদ্যোগ নিয়েছে সাহসের সঙ্গে। যেমন কোয়ারেন্টাইন নিয়ে। যেমন ডেপুটেশন বিক্ষোভে প্রথম শ্লোগান দিয়েছে। অ্যাপোয়ার কর্মসূচী নিজেরাই সংগঠিত করেছে। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে থেকে প্রশাসনকে চাপ দেওয়া, লকডাউনে কাজ হারানো মানুষকে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া – এসব ব্যাপারে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা আমাকে উৎসাহিত করেছে। এখন আমাকে ভাবতে হবে কীভাবে ওদের আরও রাজনীতি সচেতন করা যায়।

-- কাজল দত্ত 
সম্পাদিকা 
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি 
দক্ষিণ ২৪ পরগণা 

খণ্ড-27