সব ইয়াদ রাখ্খা যায়েগা
sso

বর্তমানে প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করেছে ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলি। সমান্তরাল ভাবে ফ্যাসিবাদ ও পুঁজিবাদে নিষ্পেষিত মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতার নিদর্শন থেকেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শাসক শ্রেণীর মানুষের বিরুদ্ধে সংগঠিত লড়াইয়ে। আমেরিকার শাসকপুষ্ট সাদা পুলিশের হাঁটুর চাপে দমবন্ধ হতে হতে শেষ নিশ্বাসের আগে অব্দি পৃথিবীর অবদমিত মানুষের প্রতিনিধি জর্জ ফ্লয়েড বলেছেন, “আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না”। বিশ্বজোড়া পুঁজিবাদের প্রকোপ, মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রোজগারের বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে আমেরিকার মানুষকে এক করে দিয়েছে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু। খোদ আমেরিকার বুকে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও রাষ্টযন্ত্রের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান #blacklivesmatter উচ্চারিত হচ্ছে সমস্বরে। সেই মুহুর্তে আমাদের দেশ ভারতবর্ষে, সাধারণ মানুষের উপর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও তার পুলিশি যন্ত্রের আগ্রাসন পৌছেছে চরম সীমায়। করোনা মহামারীর সময়, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন-বিরোধী আন্দোলনে রযারা আগে অংশ নিয়েছিল তাদের, দেশ-দ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত করে একের পর এক গ্রেপ্তার ও নির্যাতন শুরু করেছে। দেশের মুসলমান মানুষদের ঘরছাড়া করার নীল-নকশা, অর্থাৎ বিজেপি সরকার প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল লোকসভায় আইন আকারে পাশ হওয়ার পর থেকে দেশজুড়ে শুরু হয় নারী ও ছাত্র-যুবর নেতৃত্বে গণ-আন্দোলন। শাহ-মোদীর কেন্দ্রীয় সরকার, ধর্ম নিয়ে বিদ্বেষের আবহ বলবত করার আড়ালে ভারতবর্ষের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে মুছে ফেলতে চাইছে।

todo

 

ফ্যাসিবাদ ও পুঁজি নিয়ন্ত্রিত নয়া ভারত গড়ার এজেণ্ডা নিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এসেছে শাহ-মোদী জুটি। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বলপুর্বক বিলোপ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবাধ বেসরকারীকরণ করেছে। বেকারত্বের চরমতম সূচকে থাকা ভারতবাসীর উপর নামিয়ে এনেছে একের পর এক জনবিরোধী আইনের প্রকোপ। শ্রম-আইন, গৃহ-হিংসা বিরোধী আইন শিথিল করার সাথে সাথে ট্রান্স-জেন্ডার অ্যাক্ট, ২০১৬ আইনে নতুন বৈষম্য লাগু করা বা জল-জঙ্গল-জমিনের অধিকার সংক্রান্ত আইনের ওপর আঘাত হেনে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের বৈষম্য-জনিত আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাকে গভীরতর নিত্যনতুন সংকটের মুখে ফেলেছে। বৈষম্যতাড়িত ভারত, ক্ষমতার অসামঞ্জস্যের বিরুদ্ধে ফুঁসতে থাকা ভারতের মেহনতি জনতা, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন লাগু হওয়ায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। এই আইন পাশ হওয়ার অব্যবহিত পরেই দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছাত্র-যুব সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে শুরু করে সিএএ-বিরোধী আন্দোলন। দিল্লীর জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তর-প্রদেশের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত ছাত্রীদের দমন করতে নির্বিচারে পড়ুয়াদের উপর আক্রমন হানে শাহ-যোগী পরিচালিত পুলিশ। পুলিশি পাহারায় জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট বন্ধ রেখে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপর হামলা চালায় ফ্যাসিস্ট গুন্ডাবাহিনী। ভারতের নব্য ঔপনিবেশিক ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে দিল্লীর শাহিনবাগে মুসলিম মহিলারা অবস্থানে বসেন। দেশের নারী ও ছাত্র-যুবর নেতৃত্বে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। কলকাতা থেকে মুম্বাই, বিহার থেকে কর্ণাটক গড়ে ওঠে সিএএ-বিরোধী অবস্থান মঞ্চ। দেশের ভিতরে ও বাইরে বসবাসকারী নাগরিকরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংবিধান রক্ষার শপথে সংগঠিত হতে থাকে। সাথে চলে আন্দলোন দমনের বিভিন্ন প্রচেষ্টা।

del

 

গত ২২ ফেব্রুয়ারী দিল্লীর জাফরাবাদ অঞ্চলে নারী আধিকার কর্মীরা চাকা-বন্ধের কর্মসূচীর ডাক দেয়। বিজেপির অভিজাত পরিবারের উচ্চবর্ণীয় নেতা কপিল মিশ্র তার অনুগামীদের নিয়ে অবস্থানের অদুরবর্তী এলাকায় এসে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রাখে। দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়া এই বক্তব্য থেকে নৃশংস বিদ্বেষবিষ ছড়ায় দিল্লীর উত্তর-পুর্বের শ্রমিক মহল্লাগুলিতে। গুজরাট মডেলের আতঙ্কজনক স্মৃতি উসকে দিয়ে সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞ চালায় দিল্লী পুলিশের সহযোগিতিয় ফ্যাসিস্ট বাহিনী। মারা যান ৬০ জন গরিব খেটে খাওয়া মানুষ। সরকারী তথ্যে আহত, ধর্ষিত, বেঘর মানুষদের হদিশ মেলে না। এই আন্দোলনেও থামেনি শাহিনবাগের অঙ্গীকার। এই মহল্লাগুলিতে পুনরায় অবস্থানে বসেন মানুষ। শাসকের চোখে চোখ রেখে মানুষ বলেন, “সব ইয়াদ রাখ্খা যায়েগা। তুম যমিন পে জুল্ম লিখদো, আসমান পে ইনকিলাব লিখ্খা যায়েগা।”

sob

 

দেশের নাগরিকদের উপর দেশের সরকারে ক্ষমতাসীন দলের মদতে চলা এই হত্যালীলায় ভারত সরকারের ভূমিকার চরম নিন্দা হয় দেশবিদেশের গণতান্ত্রিক মহলে। শাহ-মোদির দামি পোষাকে লেগে থাকা রক্তের দাগ লুকাতে ঢাল হিসাবে ব্যবহৃত হয় করোনা পরিস্থিতি। জানুয়ারী মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে জারি হওয়া করোনা নিয়ে সতর্ক বার্তা উড়িয়ে দিয়ে চলেছে বিশ্বের পুজিবাদ, পিতৃতন্ত্র, বর্ণবাদের পরাকাষ্ঠায় বসে থাকা শাসক আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বা ব্রাজিলের প্রধানমন্ত্রী বলসোনারোকে নিয়ে ভারত সরকারের মোচ্ছোব। এসবের পর ২২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে জারি করলেন দেশজোড়া পরিকল্পনাহীন লকডাউন। পরবর্তীতে গরিব বিরোধী, শ্রমিক বিরোধী বিজেপি সরকারের মন্ত্রকগুলির চরম ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে শয়ে শয়ে শ্রমিক মানুষের অনাহার, দারিদ্রের কোপ ও পথ দুর্ঘটনার মৃত্যুতে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ছাত্রছাত্রী, যুব, মহিলা, দলিত প্রতিনিধিরা অভিযুক্ত হচ্ছেন দেশ-দ্রোহিতার কালা-কানুন ইউএপিএ-র কোপে। হিংসার বিরুদ্ধে, দেশের সংবিধান বাঁচাতে যারা শান্তিপুর্ণ আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিলেন তাদের ঠাঅঁই হচ্ছে কারাগারের অন্ধকারে।

sab

 

বিগত দুই মাস ধরে দিল্লী পুলিশ জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া সাফুরা জারগার, মিরান হায়দার, আসিফ ইকবাল তান্হা, জেএনইউ এ শিক্ষারত নাতাশা নারওয়াল, দেবাঙ্গনা কাটিলা, রাজনৈতিক কর্মী ইশরাত জাহান, খালিদ সাইফি, গুলফিশা ফতিমা, সারজিল ইমাম সহ শ-খানেক মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত যুবকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার হওয়া সাথীদের মধ্যে অনেককে কালা-আইন ইউএপিএ দ্বারা অভিযুক্ত করার মাধ্যমে গত ডিসেম্বর থেকে দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া সিএএ-এনআরসি-বিরোধী গণ-আন্দোলনের জোয়ারকে দমন করার চেষ্টা চালাচ্ছে ফ্যাসিবাদী কেন্দ্রীয় সরকার। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, এএমইউ-এর ছাত্র ফারহান যুবেরি এবং রাভিশ আলি খানকে সিএএ বিরোধী প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার জন্য গ্রেপ্তার করেছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। নিঃসন্দেহে আগামীতে দমনের মাত্রা তীব্রতর হবে এবং রাজনৈতিক বন্দীদের তালিকায় নিত্যনতুন নাম যোগ হতে থাকবে। অথচ, প্রকাশ্যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের উপর সংগঠিত হিংসায় ইন্ধন দেওয়া কপিল মিশ্র, পারভেশ বর্মা, অনুরাগ ঠাকুররা বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে খোলা হাওয়ায়।

sob

 

একথা স্পষ্ট যে শাসক দল, সামাজিক আন্দোলনগুলির দাবি চিহ্নিত করার বদলে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও দমন মূলক আইনের ব্যবহারে দমিয়ে দিতে চায় আন্দোলনের প্রতিবাদী স্বর। ভীমা-কোরেগাও প্রতিবাদের পটভূমিকায় কেন্দ্রীয় সরকার একইভাবে বিভিন্ন গণ-আন্দোলনের কর্মীদের মিথ্যা অভিযোগে বন্দী করেছে। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে রাষ্ট্রের কারাগারে বন্দী বিট্টু সোনোয়াল, মানস কোনওয়ার, ধৈর্য কোনওয়ার সহ অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মীরা। অখিল গোগোই এর নামে লাগু হয়েছে রাষ্ট্র-দ্রোহিতার মামলা। করোনা মহামারীতে দেশের বেহাল স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা, নিম্নগামী অর্থনীতির বিপর্যয়ের ধাক্কায় হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, লক্ষ কোটি মানুষের জীবন-যাত্রা বিপন্ন। এই মহামারীর মোকাবিলায় সরকারী ক্ষমতা ও সম্পদের পূর্ণ-ব্যবহার করার পরিবর্তে ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার, আদপেই শাসকের অত্যাচারী চেহারার নির্লজ্জ, নির্লিপ্ত প্রদর্শন।

daa

 

দেশের মুসলিম, দলিত, আদিবাসী, শ্রমিক, ট্রান্সজেন্ডার, মহিলা সহ সমস্ত প্রান্তিক মানুষের অধিকারের দাবিতে গণ-আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন যারা, তাদের উপর এই আক্রমণ মেনে নিচ্ছে না তরুণ প্রজন্ম। গণতান্ত্রিক স্বর দমনের বিরুদ্ধে গত ৩ মার্চ সিএএ-বিরোধী গণতান্ত্রিক ঐক্যবদ্ধ মঞ্চগুলির পক্ষ থেকে দেশ জুড়ে ‘সব ইয়াদ রাখ্খা জায়েগা’ নামে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। অন্যান্য শহরের মতো কোলকাতায় যাদবপুর, গড়িয়াহাট, দমদম, বাঘা-যতীন অঞ্চলে সামাজিক সংহতির বার্তা নিয়ে, শারীরিক দুরত্ব বজায় রেখে জমায়েত হন মানুষ। সাম্প্রতিক সময় চলা, #ব্ল্যাকলাইভসম্যাটার আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে, ভারতের ফ্যাসিস্টদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই তীব্র করার শপথ নেওয়া হয়। দিল্লী গণহত্যার আসল অপরাধী কপিল মিশ্র ও অনুভব ঠাকুরদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়। সিএএ-বিরোধী ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মীদের অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানিয়ে এই কর্মসূচী চলে। এই কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছিলেন, কলকাতার বিভিন্ন মহিলা সংগঠন যেমন ফেমিনিস্টস ইন রেজিস্ট্যান্স, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, ‘তুমি ধর্ষক’ প্রভৃতি নারীবাদী সংগঠন ও আইসা সহ বিভিন্ন ছাত্র যুব ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির কর্মীরা।

– সম্প্রীতি মুখার্জী

খণ্ড-27