পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়নের নয়া খসড়া প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে সিপিআই(এমএল)
eco

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক ২০২০ সালের মার্চ মাসে পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়ন সম্পর্কে একটি খসড়া বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এই বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে সিপিআই(এমএল)-এর পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবাদ নীচে দেওয়া হল:

১) এই নতুন খসড়া পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়ন প্রক্রিয়াকে(এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) লঘু করে তুলতে চায়; মহামারী এবং লকডাউন আমাদের অর্থনীতিতে যে ক্ষতিসাধন করেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিতে উদ্দীপনা সঞ্চারের অছিলায় শিল্প প্রকল্পগুলি এবং তাদের “ব্যাবসার পথকে সহজ করে তোলা”-র পক্ষে দাঁড়াতে এই নয়া খসড়া। প্রস্তাবিত প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার আগে পরিবেশের ওপর তা কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে তা মূল্যায়ন করতে স্থানীয় জনগণের মতামত নেওয়ার একটা ব্যবস্থা মূল্যায়ন নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় এখনও পর্যন্ত রয়েছে এবং আমাদের ভুললে চলবে না যে, কোভিড-১৯ অনেকাংশেই বিশ্বজুড়ে চলা পরিবেশ ধ্বংসেরই পরিণাম। পরিবেশের সুরক্ষাকে লঘু করে না তুলে তাকে আরও শক্তিশালী করাই এই ধরনের মহামারীর মোকাবিলায় আমাদের পথ হবে।

২)  মহামারী এবং লকডাউনের সময় এই খসড়া বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ফল হয়েছে এই যে, ওই খসড়া সেই সমস্ত মানুষদের কাছে পৌঁছায়নি যারা প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলোর জন্য সরাসরি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্ৰস্ত হবেন। ওরা এই পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে কিছুই জানেন না, আর তাই নিজেদের মানুষজনের সঙ্গে আলোচনা করে নিজেদের মতামত এবং আপত্তি জানানোর কথাতো ওঠেই না। অতএব, শুধু এই কারণেই এই খসড়াকে তুলে নেওয়া দরকার, মহামারী যতদিন চলবে অন্তত সেই সময়কালের জন্য একে মুলতুবি রাখা দরকার। যতদিন এবং যদি না প্রান্তিক মানুষজন, কৃষক সম্প্রদায় এবং উপকূল অঞ্চলে ও বনে বসবাসকারী জনগণ সমবেত আলোচনায় এবং সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে সক্ষম হয়, সেই সময় পর্যন্ত পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়নের বর্তমান রীতিতে কোনো পরিবর্তন আনা চলবে না।

cca

 

৩) খসড়া অনেক প্রকল্পের ক্ষেত্রেই জনশুনানি/ আলোচনাকে বর্জন করার প্রস্তাব রেখেছে। ছোট বাঁধ নির্মাণ, শিল্প-কমপ্লেক্স, খনি-প্রকল্প, প্রধান সড়কগুলোর সম্প্রসারণ এবং ট্যানিং, হ্যালোজেন, পেট্রোলিয়ামের মতো স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক কিছু শিল্পের ক্ষেত্রেও আর জনগণের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন হবে না। এর অর্থ হল, স্থানীয় যে সমস্ত সম্প্রদায়ের জনগণ জমি, বন বা জীবিকা হারাবেন, অথবা প্রকল্পের জন্য দূষণের শিকার হবেন, তাদের কাছে নিজেদের উদ্বেগ ও আপত্তি জানানো এবং তার সমাধানের কোনো উপায় আর থাকবে না। এই পরিবর্তন চূড়ান্ত রূপে গণতন্ত্র-বিরোধী, কেননা, তা প্রকল্প সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ প্রক্রিয়ায় মতামত দান থেকে স্থানীয় জনগণকে দূরে রাখবে। স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কোন ধরনের আলোচনা না করেই দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পসমূহ এবং কর্পোরেশনগুলো ও তার সাথে অন্যান্য প্রকল্পগুলো ছাড়পত্র পেয়ে যাবে।

৪) যে সমস্ত ক্ষেত্রে এখনও জনশুনানির প্রয়োজন হবে, সেগুলোর ক্ষেত্রে জনগণের সঙ্গে আলোচনার জন্য সময়সীমাকে কমিয়ে মাত্র ২০ দিনে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই সময়কাল অত্যন্ত কম, বিশেষভাবে গ্ৰামাঞ্চল এবং দূরবর্তী এলাকাগুলোর ক্ষেত্রে যেখানে যাতায়াত করতে, সংযোগ, তথ্য আদানপ্রদান এবং আলোচনার জন্য সময় অনেক বেশি লাগে।

৫) প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো বিভিন্ন প্রকল্পের এমন সমস্ত কাজকে বৈধ করে তুলবে যেগুলো বর্তমানে নিষিদ্ধর তালিকাতেই রয়েছে (যথা, বৈধ ছাড়পত্র ছাড়াই নির্মাণের কাজ শুরু করা)। এই খসড়া এখন অবৈধর সংজ্ঞা পাল্টে তাকে বৈধতে পরিণত করছে, যার উদ্দেশ্য হল পরিবেশের স্বার্থর বদলে কর্পোরেটদের এবং বাণিজ্যিক স্বার্থকে রক্ষা করা।

৬) অনলাইন/ডিজিটাল মাধ্যমে অনুমোদন দেওয়ার সংস্থানটা অত্যন্ত বিপজ্জনক, কেননা, যে এলাকার ক্ষতিগ্ৰস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেই এলাকা পরিদর্শন না করে এবং কাছ থেকে ক্ষেত্রটি এবং তার ওপর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সমীক্ষা না চালিয়ে কারুরই পরিবেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ নয়।

ect

 

৭) খসড়াটা “ইকো সেনসিটিভ জোন”-এর (পরিবেশগত দিক থেকে সংবেদনশীল অঞ্চল) সংজ্ঞাকে দুর্বল করে তুলতে চায় যাতে করে পরিবেশের অনিষ্টকারী প্রকল্পগুলো ছাড়পত্র পেতে পারে।

8) খসড়া অনেক প্রকল্পেরই “পোস্ট-ফ্যাক্টো ছাড়পত্র” পাওয়ার পথ প্রশস্ত করেছে, অর্থাৎ, ইতিমধ্যেই পরিবেশের ধ্বংসসাধন করেছে এমন সমস্ত প্রকল্পের জন্য ছাড়পত্র প্রদান। এটা পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়নের উদ্দেশ্যটাকেই ব্যর্থ করে দেয়। এই মূল্যায়নের এটাই সুনিশ্চিত করার কথা যে, উন্নয়নের নকশা এবং শিল্প প্রকল্পগুলো এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে পরিবেশ এবং স্থানীয় জনগণের ন্যূনতম ক্ষতি না হয়। পরিবেশের ক্ষতি হলে তার আর পূরণ হয় না।

৯) খসড়াটি শিল্পগুলোকে অনুমতি দিয়েছে, পরিবেশ বিধির লঙ্ঘন হলে সে কথা তারা “নিজের থেকেই জানাবে”। এটা মূলত পরিবেশ সুরক্ষাকারী বিধিকে লঙ্ঘনের লাইসেন্স। এছাড়াও, এখন থেকে প্রকল্প মালিকদের পরিবেশ বিধি মানা সম্পর্কিত রিপোর্ট ছ-মাস অন্তরের বদলে বছরে একবারই দিতে হবে। কাজেই, এই সময়ে ঘটা গ্যাস লিক, আগুন লাগা, দুর্ঘটনা এবং অন্যান্য বিপর্যয় বা লঙ্ঘনের ঘটনা কম করে দেখানো বা একেবারেই না দেখানো হতে পারে।

১০) খসড়ায় বর্ণিত পন্থা অনুসারে, পরিবেশ বিধি মেনে চলা সম্পর্কিত ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে প্রকল্প-মালিক/প্রোমোটারদের পেশ করা নথির ভিত্তিতে পরিবেশের ওপর প্রকল্পের প্রভাবের মূল্যায়ন করা হবে। এর অর্থ হল, প্রোমোটাররা নিজেদের সুবিধা মতো এমন সমস্ত নথি ও তথ্যকে গোপন করতে পারবে যেগুলো পরিবেশের ক্ষতিসাধনের সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে।

১১) খসড়াতে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞদের ভূমিকাকে কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে এবং যে সমস্ত জনগণ/সংগঠনকে কমিটিগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় তাদের তালিকাকেও হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়নের প্রস্তাবিত খসড়ার লক্ষ্য হল বিনিয়োগকারী এবং কর্পোরেটদের স্বার্থকে রক্ষা করা, পরিবেশ বা স্থানীয় জনগণের স্বার্থ রক্ষা তার আদৌ অভিপ্রায় নয়। এই খসড়া পরিবেশের এবং ভারতের জনগণের ওপর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলবে। আর তাই সিপিআই(এমএল) পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়নের এই নয়া খসড়া অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।

খণ্ড-27