ঐতিহাসিক ভারত ছাড়ো দিবসে আওয়াজ উঠলো - কর্পোরেটরা কৃষি থেকে দূর হঠো, কর্পোরেটের দালাল মোদি সরকার হঠাও - দেশ বাঁচাও!
ee

পরাধীন ভারতে ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ঐতিহ্য আজকের দিনেও যেন প্রবল ভাবে মূর্ত হয়ে উঠলো! তৎকালীন “আগস্ট বিপ্লব”-এর সময়কালে স্লোগান উঠেছিল – ব্রিটিশ রাজ ভারত ছাড়ো। আর আজ স্লোগান উঠেছে দেশী বিদেশী কর্পোরেটরা কৃষি থেকে দূর হঠো। এই দাবিতে ঐতিহাসিক ৯ আগস্ট সারা দেশের মতো গ্রাম বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে কৃষক, গ্রামীণ গরিব, আদিবাসী মানুষেরা পথে নেমেছিলেন। বর্তমানে লকডাউনের সময়কালে মানুষকে গৃহবন্দী করে রাখার সুযোগকে ব্যবহার করে মোদি সরকার কৃষিকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে তিনটি অর্ডিন্যান্স জারি করেছে। লকডাউনের সংকটে আক্রান্ত কৃষকদের সহায়তা দেওয়ার নাম করে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি ১ লক্ষ কোটি টাকার যে ঋণ সহায়তা প্রকল্প ঘোষিত হয়েছে সেটা ৯০ ভাগ কৃষকের কাছেই অধরা থেকে যাবে। ‘পিএম কিষাণ’-এর যৎসামান্য অর্থ কৃষকদের বিপুল লোকসানের তুলনায় কণামাত্র! শস্যবীমার সুযোগও ৮০ ভাগ কৃষকরা পায় না। উল্টে বীমা কোম্পানিগুলি কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে নিচ্ছে। চলছে কাটমানির খেলা আর ফসল বীমার নামে লুঠের কারবার। তাই আজকের দিনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা কৃষি ও কৃষকদের এই সমস্ত বাঁচার দাবিগুলিকে সামনে রেখে ৯ আগস্ট সংগঠিত হলো দেশব্যাপী কৃষক মু্ক্তি দিবস। সরকার বলছে কৃষকরা নাকি তথাকথিত “মুক্ত বাজারে” তাঁদের ফসল বিক্রি করার “স্বাধীনতা” পাবে, ফলে তারা ফসলের দাম বেশি পাবে! কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এই নতুন ব্যবস্থার ফলে সরকারী ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণের আর কোনো অর্থই থাকবে না। কৃষকদের উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দাম গ্যারান্টি করার দায় থেকেও সরকার সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যাবে। বাস্তবে বর্তমানে সরকারী ফসল ক্রয় ব্যবস্থা প্রায় তুলেই দেওয়া হয়েছে, দেড়গুণ দাম নির্ধারণেও সরকার কৃষকদের ঠকাচ্ছে। তবুও এতোদিন সরকারের কাছে দাবি করবার একটা সুযোগ ছিল! এখন সেটাকেও লোপাট করে দেওয়া হবে। কৃষকদের ছেড়ে দেওয়া হবে কর্পোরেটদের হাতে, যারা চুক্তিচাষের মাধ্যমে চাষিদের গোলামে পরিণত করবে। সরকারী ক্রয় ব্যবস্থা তুলে দিয়ে আসলে ধাপে ধাপে সরকারী বণ্টনব্যবস্থাও তুলে দেওয়া হবে। অর্থাৎ রেশন ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়া, মিড-ডে-মিল’কে এনজিওদের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে সরকার। নতুন করে চাপিয়ে দেওয়া এই কোম্পানিরাজের বিরুদ্ধে ৯ আগস্ট সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদ দিবসের ডাক দিয়েছিল দেশের ২৫০টি কৃষক, কৃষিমজুর সংগঠনের সংগ্রামী মঞ্চ এআইকেএসসিসি। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এআইকেএম, আয়ারলা, আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ সহ অন্যান্য সংগঠনের উদ্যোগে কোথাও যুক্ত ভাবে কোথাও বা এককভাবে এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলার ব্লকে ব্লকে নানাবিধ কর্মসূচী সংগঠিত হয়েছে।

বাঁকুড়া জেলা - সম্প্রতি বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন ব্লকে আদিবাসীদের বনাঞ্চলের জমি থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। ক্যাম্পা আইনকে কাজে লাগিয়ে সরকার প্রশাসনের মাধ্যমে উচ্চবর্ণের গ্রামীণ কায়েমী স্বার্থান্বেষী শক্তি গরিব তপশীলী ও আদিবাসীদের চাষের জমির ফসল ধ্বংস করে দিয়েছে। বাস্তজমি থেকে উচ্ছেদের চক্রান্ত করছে। এর প্রতিবাদে এবং অন্যান্য দাবিতে হীড়বাঁধ ব্লকের মলিয়ানে বামপন্থী কৃষক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে যৌথ মিছিল ও সভা সংগঠিত হয়। ছাতনাতেও অনুরূপ কর্মসূচী সংগঠিত হয়। এছাড়া ওন্দা ব্লকের নিকুঞ্জপুরে মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।

nadia

 

নদীয়া - ধুবুলিয়ার নেতাজী পার্কে অনুষ্ঠিত প্রচার সভা ব্যাপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চল থেকে আসা বেশ কয়েকজন কর্মী এই প্রচার সভায় অংশ নেয়। নাকাশীপাড়া ব্লকের গাছা বাজারে প্রচার সভাও এলাকার ব্যাপক মানুষের মধ্যে ভালো সাড়া ফেলে। এই সভাগুলি আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে একক ভাবেই সংগঠিত হয়।

হাওড়া - সারা ভারত কৃষক সংর্ঘষ সমন্বয় সমিতির ডাকে “কৃষিক্ষেত্র থেকে কর্পোরেট হঠাও ও কৃষক বিরোধী সমস্ত অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল কর, কৃষি ও কৃষকদের বাঁচাও” দাবিকে সামনে রেখে বাগনান ২নং ব্লকের ঘোড়াঘাটা অঞ্চলে সারা ভারত কৃষক সভা ও সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি যৌথ উদ্যোগে “কিষান মুক্তি দিবস” পালন করা হয়।

উত্তর ২৪ পরগণা - গাইঘাটা ব্লকে চাঁদপাড়া বাজারে বিভিন্ন বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন ও কৃষক সংগঠন যৌথভাবে কর্মসূচী সংগঠিত করে। সারা ভারত কিষান মহাসভা, সারা ভারত কৃষকসভা, আইএনটিইউসি, সিআইটিইউ ইত্যাদি সংগঠনের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখা হয়।

জলপাইগুড়ি - ময়নাগুড়ি ব্লকের সাপ্টিবাড়ীতে প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও কিষাণ মহাসভার উদ্যোগে প্রতিবাদ কর্মসূচী সংগঠিত হয়।

dar

 

দার্জিলিং - দেশ বিক্রির দালাল মোদি সরকার ভারত ছাড়ো স্লোগান সহ বিক্ষোভ কর্মসূচী সংগঠিত হয় খড়িবাড়ি ব্লকের বিত্তান জোতে। এআইকেএম-এর পক্ষ থেকে কর্পোরেট ভারত ছাড়ো স্লোগানে গোটা গঞ্জ এলাকায় প্রচার করে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করা হয় রাঙ্গাপানিতে।

দঃ ২৪ পরগণা - বিবিরহাট মোড়ে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনগুলির যৌথ নেতৃত্বে। “ভারত বাঁচাও, সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও, শ্রমিক বাঁচাও, রোজগার বাঁচাও” ও “কর্পোরেটরা কৃষি থেকে দূর হটো” কর্মসূচীর অঙ্গ হিসাবে। বিপ্লবী যুব এ্যাসোসিয়েশনও যোগ দেয়। বিষ্ণুপুর ব্লকে বিরাট সংখ্যায় বাগিচা তথা উদ্যান পালনের সাথে যুক্ত কৃষিজীবী মানুষেরা লকডাউন ও আমফান এই দুই বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। এদের প্রতি সরকারের কোনো নজর নেই। এদের ক্ষতিপূরণের দাবি বক্তারা তুলে ধরেন।

উঃ দিনাজপুর - এই জেলার কালিয়াগঞ্জে বিভিন্ন বামপন্থী কৃষক সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রচারসভা সংগঠিত হয়।

মুর্শিদাবাদ - জেলার সদর বহরমপুরে এআইকেএম ও আয়ারলার পক্ষে একটি প্রচার সভা সংগঠিত হয়। 

hoog

 

হুগলী জেলা - কৃষিকে বাঁচানোর তাগিদে, কর্পোরেট লুটের বিরুদ্ধে ৯ আগস্ট এআইকেএসসিসি আহূত দেশজোড়া প্রতিবাদ দিবস হুগলী জেলার গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে পালন করা হয়। সারা ভারত কিষাণ মহাসভার উদ্যোগে (এআইকেএম) সবথেকে সংগঠিতভাবে, বেশ কয়েকদিনের লাগাতার প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে বড় এক বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় পান্ডুয়া ব্লকের বৈঁচিতে। ৯ আগস্টের সমাবেশ সফল করার জন্য বেশ কয়েকজন কর্মী-সংগঠক খেতমজুর ও গরিব কৃষক অধ্যুষিত পল্লীগুলিতে প্রতিবাদ সভার বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা চালান। এআইকেএম মঞ্চ, মাইক, সভার ব্যবস্থাপনা -- সবকিছুরই দায়িত্ব গ্রহণ করে। সভার নির্ধারিত সময়ের (বিকেল ৫ টা) বহু আগে থেকেই বিভিন্ন গ্রাম থেকে কৃষক ও কৃষিশ্রমিক আদিবাসী ও তপশীলি সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষরা সমাবেশ স্থলে আসতে শুরু করেন। এলাকার কৃষকদের এক বড় অংশ মুসলিম সমাজভুক্ত। পরিবারের মহিলা সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে তাঁরাও দল বেঁধে সমাবেশে সামিল হন। ঘোষিতভাবে যা ছিল এক পথসভা তা প্রায় এক জনসভায় পরিণত হয়।

এলাকায় বামপন্থী অন্য কৃষক সংগঠন বলতে কেবল সিপিআইএম প্রভাবিত এআইকেএস-এরই সংগঠিত শক্তি রয়েছে। সমাবেশের দুদিন আগে তাঁদের নেতৃত্বের সাথে সমাবেশের বিষয় নিয়ে মতামত গ্রহণ করা হয়। তাঁদেরও ভালোসংখ্যক কৃষক, অসংগঠিত শ্রমিক ও ছাত্র-যুবরা প্রতিবাদ সভায় সামিল হন। দীর্ঘদিন পরে ভীড়ে ঠাসা, রক্তপতাকার লালে লাল সমাবেশ এলাকার ব্যাপক জনগণের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। সভার শুরুতে দীপনিকা সাহার টানটান গলার আবৃত্তি সমাবেশের সুর বেঁধে দেয়। এরপর বক্তব্য রাখেন সুকুমার সাধুখাঁ (সিটু), সুনীল ক্ষেত্রপাল (এআইকেএস), আব্দুল কাশেম (আয়ারলা), উজ্বল ঘোষ (ডিওয়াইএফ) এবং মুকুল কুমার (এআইকেএম)। সঙ্গীত শিল্পী ঝর্ণা কিসকুর গান সভায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করে দেয়।

hoogs

 

বক্তাদের কথায় লকডাউন পর্বে খারিফ মরশুমের ঝণ মকুব সহ সম্পূর্ণ ঋণমুক্তি, বিদ্যুৎ বিল ২০২০ প্রত্যাহার, ডিজেলের দাম ৫০% কমানো, ৫ জুন জারি হওয়া তিনটি কালা অর্ডিনান্স প্রত্যাহার, গ্রামের গরিবদের নগদ অর্থ প্রদান ইত্যাদি বিষয়গুলি উঠে আসে। সভা পরিচালনা করেন বিনোদ আহির (এআইকেএম) ও সুকুমার সাদুখাঁ (সিটু)। পান্ডুয়ায় অপর কর্মসূচীটি আনুষ্ঠিত হয় সাঁচিতারা গ্রামে। এখানে মসজিদতলায় পথসভাটিতে বক্তব্য রাখেন শুভাশিস চ্যাটার্জী (এআইকেএম), গোপাল রায় (আয়ারলা) ও পার্টির রাজ্যনেতা সজল অধিকারী। আয়ারলা জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন বাগ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করেন। হুগলীর বলাগড় ব্লকের মহিপালপুর হাটতলায় ৯ তারিখ বিকেলে খেতমজুর কর্মীরা ‘২০০ দিন কাজ ও দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরি’, আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত লিজ ও চুক্তি চাষিদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ইত্যাদি দাবিতে পোস্টার প্রদর্শন করেন। ছোট এই কর্মসূচীটি পরিচালনা করেন আয়ারলা জেলা নেতা সেখ আনারুল। এছাড়া এই দিনই ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ উপলক্ষ্যে আদিবাসী কৃষক জনগণের এক সমাবেশ সংগঠিত হয় পোলবা ব্লকের বরুনানপাড়ায়। সারা বাংলা আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ ছিল এই কর্মসূচীর উদ্যোক্তা।

kal

 

পূর্ব বর্ধমান : ৯ আগস্ট ঐতিহাসিক ‘ইংরেজ ভারত ছাড়’ আন্দোলন দিবসে পুর্ব বর্ধমান জেলার বিভিন্ন ব্লকে যৌথ কর্মসূচী পালন করা হল। শ্লোগান ও দাবি ছিল – সংবিধান বাঁচাও, স্বাধীনতা বাঁচাও, গনতন্ত্র বাঁচাও, শ্রমিক বাঁচাও, কৃষক বাঁচাও  ও নাগরিকের অধিকার বাঁচাও। কর্পোরেট হঠাও, কৃষি ও কৃষক বাঁচাও। কৃষক-বিরোধী অর্ডিন্যান্স বাতিল কর। ২০২০ বিদ্যুৎ বিল বাতিল কর। লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের ঋণ মুকুব কর। পরিযায়ী শ্রমিকদের মাসে ১০,০০০ টাকার ভাতা দাও। মনরেগা প্রকল্পে ২০০ দিন কাজ ও সরকারী ন্যুনতম মজুরি দাও, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি কেন মোদি সরকার জবাব দাও। করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থ মোদি-শাহ দূর হঠো।
পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের পাটুলি গঞ্জে, পুর্বস্থলী১নং ব্লকের নাদনঘাট নওপাড়া মোড় বাস স্ট্যান্ড, মন্তেশ্বর ব্লকের কুসুমগ্রাম বাজারে, কালনা ২নং ব্লকের বৈদ্যিপুর বাস স্ট্যান্ড, মেমারী ১নং ব্লকের মেমারী ও বর্ধমান শহরে মিছিল বিক্ষোভ এবং কোথাও অবরোধও সংগঠিত করা হল। সমস্ত কর্মসূচীতে সিপিআই(এমএল), এআইসিসিটিইউ, এআইকেএম, আয়ারলা, আরওয়াইএ এবং সিপিআই(এম)-এর বিভিন্ন গণসংগঠন অংশগ্রহণ করে।

খণ্ড-27
সংখ্যা-28