শক্তি আর ‘ভক্তি’ ফলাচ্ছে বিজেপি
sam

অতিমারী আর লকডাউনের সুযোগকে পুরো কায়েমী স্বার্থে কাজে লাগাতে কেন্দ্রের মোদী সরকার নিজের কদাকার চেহারা যখন প্রতিনিয়ত উন্মোচিত করে চলছে, তখন বাংলায় বিজেপি কী করছে? ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ হল বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ।

অযোধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মোদীর নেতৃত্বে রাম মন্দির নির্মাণের শিলপুজোর দিন বিজেপির উৎসবমুখর হওয়ার নামে হিন্দুত্বের উন্মাদনা সৃষ্টির কর্মসূচী ছিল দেশব্যাপী, এখানেও সমানতালে রাজ্য বিজেপি উদযাপনের উন্মত্ততা চালালো। পশ্চিমবাংলায় নেওয়া রামপূজন কর্মসূচীর পরিণামে কোথাও কোথাও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আগুন লাগার শঙ্কা ঘনীভূত হয়েছিল, যেমনটা এরাজ্যে বিগত বছরগুলোতে বিশেষ করে গঙ্গাপাড়ের জেলাগুলোতে কখনো রামনবমী কখনো বা অন্য কোনো উপলক্ষে বিজেপি লাগিয়ে দিতে পেরেছিল, এই করোনাসৃষ্ট জীবন-মরণ সংকটের পরিস্থিতির মধ্যেও হুগলির তেলেনিপাড়া অঞ্চলে সাম্প্রদায়িকতার আক্রমণ সংগঠিত করেছিল বিজেপি, সেখানে সশরীরে উপস্থিত প্রকাশ্যে প্ররোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হুগলি লোকসভা কেন্দ্রে নবনির্বাচিত বিজেপি সাংসদ, ঠিক যেমন আমফান ত্রাণ বিলির ছুতোয় সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর ছক কষে এলাকা চষে ফেলার চেষ্টায় ছিলেন দলের বারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের নয়া সাংসদ। এবারে অযোধ্যা শিলান্যাস পূজন উপলক্ষে অবশ্য তেমনটা হতে পারেনি। তবে বহুক্ষেত্রে প্রকাশ্যে আবারও হঙ্কার দেওয়া হয়েছে, মন্দির রাজনীতির কোনোরকম সমালোচনা বা বিরোধিতা বরদাস্ত করা হবে না। আর তার তাৎক্ষণিক প্রভাবে পরপর দুজন ছাত্র-ছাত্রীর ওপর বিজেপি ‘মব লিঞ্চিং’ করতে বাড়ি পর্যন্ত ধেয়ে যায়। ঘটনাস্থল কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ারে। একজন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, বামমনস্ক; অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরতা, আধুনিক যুক্তিবাদী। এদের ‘অপরাধ’, অতিমারীর মোকাবিলায় জরুরি সব ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্নে চরম অব্যবস্থা চলতে থাকাকে কেন্দ্র করে মোদী সরকারের অবহেলা-গাফিলতি-অপদার্থতা-ব্যর্থতা নিয়ে যখন হাজারো প্রশ্ন উঠছে, তখন সেইসমস্ত প্রশ্ন সহ সরকারী আয়োজনে মন্দির নির্মাণের অবৈধতা আর গেরুয়া রাজনীতির রব তোলার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে পাল্টা সোচ্চার হন সামাজিক প্রচার মাধ্যমে। তাই উপরোক্ত দুই ছাত্র-ছাত্রীর ওপর চালানো হয় শারীরিক-মানসিক আক্রমণ। মদত যোগাতে বিজেপির খোদ রাজ্য সভাপতি বললেন, ‘হাসপাতাল কালচারটা বন্ধ করে মন্দির কালচারটা আসা উচিত।’ এটাও ঘটনা যে, করোনা মোকাবিলার প্রশ্নে ‘মোদী সরকার বাংলার জন্য অনেক কিছু করছে’ - রাজ্য বিজেপির এই অন্তঃসারশূন্য প্রচার যত ভোঁতা হচ্ছে ততই তারা ঐ জ্বলন্ত ইস্যু থেকে সরে যাচ্ছে, এপ্রশ্নে তাদের কোনো সহায়ক স্বেচ্ছাসেবী ভূমিকা নিতে ঝাঁপাতে দেখা যায়নি, যাচ্ছে না।

রাজ্য বিজেপি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এবার আত্মসাৎ করতে ঝাঁপাতে শুরু করল। কবির প্রয়াণ দিবসে পশ্চিমবঙ্গের জন্য ভারপ্রাপ্ত জাতীয় স্তরের নেতামশাইকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী মতাদর্শ ও বাংলার উত্থানে তাঁর অবদান বিষয়ে এক ভার্চুয়াল বার্তা শোনানো হয়েছে দলের নেতা ও কর্মীদের উদ্দেশ্যে। এতেও দলের রাজ্য সভাপতি ঝাঁঝ তুলতে ফোড়ন দিয়েছেন, বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর ভাবনার মধ্যে তাঁরা মেলবন্ধনের সূত্র পেয়েছেন! কবির প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে তিনি ঘোষণা রাখলেন এরাজ্যে বিজেপির সদস্য সংগ্রহ অভিযানকে তীব্র করা হবে। ক’মাস আগেই ছিল কবির জন্মদিবস, তখনও রাজ্য বিজেপির নেতা-মাথাদের মনে হয়নি ধরতে হবে কবির ভাবমূর্তিকে, সদ্য দিল্লীতে দলের জাতীয় ও রাজ্য নেতাদের বৈঠকের পরেই শোনা যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তির মুখে রবীন্দ্র কথা, যে মানুষটি হিন্দুত্ববাদীদের আদি ভক্তির আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদের নিদর্শন নাৎসীবাদের বিরোধিতায় ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপনের অধিকারী। তাছাড়া দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে শ্যামাপ্রসাদ সম্প্রদায় অবস্থান নিয়েছিলেন মূলত নিষ্ক্রিয় থাকার, তাদের যা সক্রিয়তা ছিল তা কেবল সাম্প্রদায়িক বিভেদের প্রচারে, আর ক্ষেত্রবিশেষে ব্রিটিশ রাজশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে, তাদের পক্ষে ওকালতি করতে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে, আন্দোলনকে অন্তর্ঘাত করতে। বিপ্রতীপে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ প্রতাপের বিরোধিতায় দ্বিধাবোধ করেননি এমনকি মনিহার পরিত্যাগ করতে। রবীন্দ্রনাথের সাথে কোথায় মেলাবে বিজেপি তাদের হিন্দুত্ববাদী নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে, মেলানোর দুঃসাহস দেখাতে গেলে হাস্যকর প্রতিপন্ন হবে, কারণ ইতিহাসগতভাবে দুজনার ভাবধারার মধ্যে রয়েছে পুরোদস্তুর বৈপরীত্যের সংঘাত। ক’বছর আগেও বিজেপি এই বাংলায় হিন্দুত্বের সংস্কৃতির জায়গা তৈরি করতে অহরহ বিদ্বেষের মুখ ছোটাতো এই বলে যে, এখানে প্রবল প্রভাব রয়েছে ‘রসুন’ সংস্কৃতির। মানে, রবীন্দ্র-সুকান্ত-নজরুল সমন্বয় সংস্কৃতির। সামনে নির্বাচন। তাই এরাজ্যের বিজেপির আজকের নেতাদের গিলতে হচ্ছে তাদের পূর্বসূরীদের অনেক ছেটানো থুতু।

বিজেপির কোনও সাফাই গাওয়া দেখে ভুললে চলে না, ওদের হিন্দুত্বের আগ্রাসী ‘ভক্তিবাদ’ ভারতকে সবদিক থেকে করে দিচ্ছে বরবাদ।

খণ্ড-27
সংখ্যা-28