ফেসবুক আর বিজেপির মধ্যে আঁতাত ভারতের মানুষের পক্ষে ক্ষতিকারক
face

ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল নামে এক মার্কিনী পত্রিকায় নিউলি পার্নেল এবং জেফ হরউইতজ নামক দুই সাংবাদিক ফেসবুক-বিজেপি আঁতাত নিয়ে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে।

ফেসবুক একটি ইন্টারনেট গণমাধ্যম যেখানে আপনি বৃহত্তর সমাজের সাথে আলাপচারিতা করতে পারেন বা বন্ধু বান্ধবদের সাথে খোশগল্পও করতে পারেন। শুনে খুব নিরীহ একটি জিনিস মনে হলেও এটি সারা বিশ্বের গণতন্ত্রগুলির বিরুদ্ধে একটি বিপজ্জনক সংস্থা হয়ে উঠেছে। ওয়াটসঅ্যাপ আর ইন্সটাগ্রামও এই সংস্থার দ্বারা পরিচালিত।

ফেসবুকে আমি-আপনি যেসব নিজস্ব ফটো বা লেখা “শেয়ার” করি বা মেসেজ অথবা অন্যের ছবি বা লেখায় লাইক কমেন্টগুলো করি সেই তথ্যগুলো ফেসবুকের বাণিজ্যের কাঁচামাল। ফেসবুক এই কাঁচামাল সংগ্রহ করার জন্য মানুষকে নিজেদের পরিষেবা বিনামূল্যে ব্যবহার করতে দেয়। যখন একজন মানুষের সম্পর্কে পর্যাপ্ত পরিমাণে তথ্য জোগাড় হয়ে যায়, তখন সে সেটিকে ব্যবহার করে।

কিভাবে ব্যবহার করে? ভাবুন ফেসবুক একটা সমাজ। সেই সমাজের নিয়মকানুন ফেসবুক কোম্পানির মালিকদের নিয়ন্ত্রণে। তারা আমাদের দেওয়া তথ্য যাচাই করে বুঝে ফেলছে যে জনতা কী ভাবছে, কি করছে, কী চাইছে। এবার একটি কোম্পানি আসছে ফেসবুকের কাছে। তারা জানতে চায় যে ঠিক কারা কারা তার পণ্য কিনতে পারে এবং তাদেরকেই সে তার বিজ্ঞাপন দেখাতে চায়। ফেসবুক সেই কোম্পানির কাছ থেকে পয়সা নিয়ে তাদেরকে জনতার তথ্য দেখায়। যে যত বেশি টাকা দেবে ফেসবুক তাদেরকে তত বেশি জনতার কাছে পৌঁছে দেবে।

ফেসবুকের নিজস্ব কিছু নিয়ম-কানুন আছে যেগুলো কেউ অমান্য করলে তাকে ফেসবুক থেকে বিতাড়িত করা হবে। তার মধ্যে একটি হল কেউ যদি হিংসা, উসকানিমূলক কথা বলে তাহলে তা সহ্য করা হবে না।

অসুবিধে তখন শুরু হয় যখন কোম্পানির বদলে রাজনৈতিক পার্টিগুলি ফেসবুকের প্রধান ক্রেতা হয়ে উঠল। তারা রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এবং আরো বিভিন্ন ধরনের সাংঠনিক আর আর্থিক শক্তি লাগিয়ে ভোটারদের ভাবনাচিন্তার দখল নিতে শুরু করল।

ওয়াল স্ট্রীট জার্নালের খবরে উঠে এসেছে যে টি রাজা সিং বলে তেলেঙ্গানার বিজেপি এমপি বার বার ফেসবুকে সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কথা বলেছে। ফেসবুকের কর্মচারিরা টি রাজা সিং কে বিপজ্জনক ঘোষণা করলেও ফেসবুকের ভারতের একজন উচ্চপদস্থ ম্যানেজার, আঁখি দাস অভ্যন্তরীণ মিটিংএ বলছেন যে বিজেপির রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে ভারতে ফেসবুকের বাণিজ্যে আঘাত আসতে পারে। এই মিটিঙের পর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি টি রাজা সিং এর ওপর। এই দুই রিপোর্টার খোঁজ খবর করা শুরু করার পর পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

এই খবর প্রকাশ পাওয়ার পর পরিষ্কার হয়ে গেছে যে বিজেপির সাথে বানিজ্যিক সম্পর্কের কারণে ফেসবুক সমাজের সুরক্ষাকেও অগ্রাধিকার দিতে রাজি নয়। ফেসবুক বিজেপিকে তার তৈরি করা এই গণমাধ্যমে আধিপত্য স্থাপন করতে সাহায্য করছে। তার বদলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ভাবে ফেসবুককে সুবিধা দিয়েছে, যেমন “ডিজিটাল ইন্ডিয়া” প্রচারে মোদী সমস্ত সরকারী সংস্থা, মন্ত্রী, আমলাদের বলেন ফেসবুকে প্রোফাইল খুলতে। এই সরকারি মদত ফেসবুককে ভারতে আলাদাই জায়গা দিয়েছে।

বিজেপির সঙ্গে ফেসবুকের সম্পর্কের একটু ইতিহাস ঘাটা যাক।

ভারতের ৩২ কোটি মানুষ আজকের দিনে ফেসবুকের সদস্য। ভোটে প্রচারে ফেসবুক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি গণমাধ্যম হয়ে উঠেছে। তার ওপর ওয়াটস অ্যাপ আর ইন্সটাগ্রামও আছে। প্রথম খটকা লাগা শুরু হয় যখন ফেসবুকে বিভিন্ন বিজেপি বিরোধী খবর প্রকাশ করতে অসুবিধেয় পড়তে শুরু করে। ফেসবুককে টাকা দেওয়া সত্ত্বেও তারা সেই সব খবর বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে দেরী করে। বিজেপি-বিরোধী কথা লেখার জন্য এরমনকি রিপোর্টারদের প্রোফাইল বন্ধ হয়ে যায়।

সিরিল স্যাম আর পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার তদন্তের পর জানা যায় যে শিবনাথ ঠুকরাল নামে ফেসবুকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারি, তিনি ২০১৪’র আগে মোদীর ভোটের প্রচারে কাজ করতেন। তিনি যেসব ওয়েবসাইটের সাথে যুক্ত ছিলেন তা ২০১৪-র আগে বিভিন্ন ভুল খবর বাজারে ছড়াত মানুষের কাছে মোদীর ইমেজ ভাল করার জন্যে। আঁখি দাশের বোনও আরএসএস-এর ছাত্র সংগঠন এবিভিপির সদস্য। তিনি নিজেও যে বিজেপির অত্যন্ত ঘনিষ্ট তা সাংবাদিক মহলে অজানা নয়।

এও জানা গেছে যে বিজেপি আইটি সেলকে ফেসবুকের কর্মচারীরা নিজেরা প্রশিক্ষণ দিয়েছে কিভাবে ফেসবুককে তারা আরো ভাল ভাবে ব্যবহার করতে পারে। এর আগে এই তথ্য সামনে এসেছে যে ফেসবুকে জনতার তথ্য ব্যবহার করে বুথ লেভেল পর্যন্ত ভোটারের মানসিকতা বুঝে ফেলা সম্ভব এবং তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো তার প্রচার চালায়। জনতার ব্যক্তিগত তথ্য ফেসবুক যে রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে তুলে দিচ্ছে না এটা নিয়ে সংশয় দেখা দিচ্ছে।
ভুল ও উসকানিমূলক খবর ওয়াটস অ্যাপ ও ফেসবুকের মাধ্যমে তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে দিয়ে কিভাবে সমাজের মানসিকতাকে বিষিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা আজ অনেকের কাছেই পরিষ্কার। মায়ানমারে এই সব মাধ্যম ব্যবহার করে রোহিঙ্গা-গণহত্যা সংগঠিত হয়। শ্রীলঙ্কায় দাঙ্গা হওয়ার পরে সেখানকার সরকার ফেসবুক ব্যান করতে বাধ্য হয়। ভারতে এর বীজ বপন শুরু হয় ২০১৪-র আগে মোদীর ভোটের প্রচারের সময়। ২০১৯’এ আরো কার্যকর হয় বিজেপি-ফেসবুক-বড়পুঁজি আঁতাত।

আজকের ভারতে বিজেপি-আরএসএস-বড় পুঁজি জোট ভারতের গণতন্ত্রকে গভীর বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। শুধু ভারতে নয় পুরো বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে ফ্যাসিবাদ-পুঁজিবাদ-সোশাল মিডিয়ার মারক মিশ্রণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

-- প্রত্যুষ নন্দী  

খণ্ড-27
সংখ্যা-29