তাঁতশিল্প, হস্তশিল্প কি শুধুমাত্র স্টাইল স্টেটমেন্ট?
ttar

২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৭ আগস্টকে ‘ন্যাশনাল হ্যান্ডলুম ডে (জাতীয় হস্তচালিত তাঁত দিবস)’ ঘোষণা করেন। স্বদেশী আন্দোলনের স্মরণে হ্যান্ডলুমের ঐতিহ্য এবং বৈশিষ্ট্য ভবিষ্যতে টিকিয়ে রাখার জন্যেই নাকি এই দিনটির ঘোষণা। বাস্তবে তাঁত শিল্পকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে ‘স্পেশাল’ করার ফলে তাঁতিদের কী উপকার হল সে কথায় পরে আসছি, তবে প্রত্যেক বছর এই দিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড হয় হ্যান্ডলুম শাড়ি পরে ছবিসহ “আমাদের ঐতিহ্যকে টিঁকিয়ে রাখতে হবে” লিখে  স্ট্যাটাস মেসেজ। না, কারোর সোশ্যাল  মিডিয়ায় ছবি পোস্ট  করায় কোনও আপত্তি নেই! কিন্তু হ্যান্ডলুম কি শুধুই ‘স্টাইল  স্টেটমেন্ট’ হয়ে থেকে যাবে?

অনেকেই হয়তো জানেন না, ২৭ জুলাই এবং ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকার ‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট ম্যাক্সিমাম গভর্নেন্সের’ যুক্তি দেখিয়ে অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডলুম বোর্ড, এবং অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডিক্রাফট বোর্ড দুটোকেই বাতিল ঘোষণা করেছে! এর ফলে থমকে গেল এই দুটি বোর্ডকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষের ভবিষ্যৎ। ৭ই আগস্ট ‘হ্যান্ডলুম ডে’ উপলক্ষ্যে টেক্সটাইল মিনিস্টার স্মৃতি ইরানি হ্যান্ডলুমের শাড়ি এবং কাপড়ের তৈরি মাস্ক পরে নিজের দুটি ছবি টুইট করে মোদীর সুরেই ‘ভোকাল ফর লোকাল’-এর ডাক দিয়ে বলেছেন “হ্যান্ডলুম আমাদের প্রতিদিনের জীবন ও আশপাশের পরিবেশকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। পোশাক থেকে ফার্নিশিং কিংবা মুখোশ... বাড়িতে নিয়ে আসুন একটুকরো হাতে তৈরি ভারত”৷ আর তার এই ‘দরদী’ পোস্ট দেখে সেলিব্রিটিরাও সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যান্ডলুমের শাড়ি পরে ফ্যাশন স্টেটমেন্ট দিতে শুরু করলেন। কেউ টেক্সটাইল মন্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন না “আচ্ছা তাহলে এই বোর্ডগুলিকে বাতিল করলেন কেন?”

তাই আসুন, বাস্তবটাকে একটু জানি ...

হ্যান্ডলুম এবং হস্তশিল্প প্রায় ৩২ লক্ষ মানুষের জীবিকা নির্বাহের একটি উৎস, তাদের বেশিরভাগই অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র পশ্চাৎপদ, তফসিলি উপজাতি, তপশিলী জাতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এবং বেশিরভাগই মহিলা। এই ব্যবসার ফলে সরকার লাভের মুখ দেখে না এমনও নয় যে ‘খাজনার থেকে বাজনা বেশি’ (মিনিমাম গভর্মেন্ট ম্যাক্সিমাম গভর্নেন্সের বাংলা করলে যা হয়) বলে সরকার বোর্ডগুলি বন্ধ করে দেবে। হস্তশিল্প, বস্ত্রশিল্প উৎপাদন ভারতের সেরা অর্থনৈতিক উপার্জনের মাধ্যম (কৃষিকার্যের পরে)। এই দুটি শিল্পই অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। আগের অর্থ-বছরে সরকার হস্তশিল্প রপ্তানির মাধ্যমে ৩৬,৭৮৯৮৮ কোটি টাকা এবং দেশীয় বাজারে ১২,৬৭৮ কোটি টাকা আয় করেছে, হ্যান্ডলুম রপ্তানির মাধ্যমেও ২,২৮০.১৮ কোটি টাকা, এবং দেশীয় ব্যবসায় ২,৭৫,০০০ কোটি টাকা আয় হয়েছে। পলিসি এক্সপার্ট ও সমাজকর্মী ডঃ নরসিমা রেড্ডি ‘সিয়াসত ডেলি’ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন এই বোর্ড চালাতে সরকারের তেমন কোন খরচা ছিল না, অথচ এই বোর্ড থাকার কারণে লাভ হতো বহু মানুষের।

১৯৯২ সালে তৈরি হ্যান্ডলুম বোর্ড তাঁত, তাঁতশিল্পী ও কারিগরদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছে এবং নানা অসুবিধাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা চালিয়েছে। ঠিক তেমনি ভাবেই ১৯৫২ সালে দেশের হাজার হাজার মহিলাদের স্বনির্ভর করার জন্য হস্তশিল্প বোর্ড তৈরি করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং নারী অধিকার রক্ষার আন্দোলনের নেত্রী কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় এবং পুতুল জয়াকার। কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এই বোর্ডের প্রথম চেয়ারপার্সন। মহিলাদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করে আসছিল এই বোর্ড। এই দুটি বোর্ডের মুল কাজ ছিল সরকারের সাথে আলোচনা করে এই শিল্প এবং শিল্পের সাথে যুক্ত মানুষের জীবনের মান উন্নত করা।

এই বাংলার তাঁত শিল্প সারা বিশ্বে বিখ্যাত। এক সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় শত শত তাঁতির আঙুল কেটে দিয়েছিল যাতে ভারতবর্ষের দেশীয় তাঁতশিল্প শেষ করে দেওয়া যায়। নিজের দেশে সূতীবস্ত্র শিল্পে বিপ্লব আনার জন্য ভারতের বস্ত্র শিল্পের ক্ষেত্রে কোম্পানির মূল নীতি ছিল ‘যথাসম্ভব কম দামে মাল কিনে তা ইউরোপীয় বাজারে চড়া দামে বিক্রয় করা’। কোম্পানির এই নীতির ফলে ভারতীয় তাঁতিদের লোকসানের সীমা ছিল না। কিন্তু গান্ধীজীর নেতৃত্বে স্বদেশী আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে তাঁত বস্ত্র শিল্পের উন্নতি ঘটতে থাকে।

বহু বছর ধরেই বাংলার ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁত শিল্পের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে পাওয়ারলুম। রাণাঘাট, ধনেখালি, ফুলিয়া, শান্তিপুরের তাঁতশিল্পগুলি ধুঁকছে। যে কোনো শিল্পকে লাভজনক অবস্থায় চালানোর ক্ষেত্রে দরকার যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার উন্নতি ঘটানো, তাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নেওয়া। সরকার যখন ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের কথা বলছে তখন তো দেশের হ্যান্ডলুম ব্যবসাকে আরও উৎসাহ জোগানো উচিত ছিল, তাই না? কিন্তু এই সরকার ঠিক তার উল্টোটা করছে।

এই মোদি সরকার হল সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক নয়া রূপ। দেশের সম্পদকে বিক্রি করে চলেছে কর্পোরেট কোম্পানিগুলির হাতে। আমরা আগেই বলেছি দেশীয় ও রপ্তানি বাজারগুলিতে হ্যান্ডলুম এবং হস্তশিল্পের বিক্রি বাড়ছে। তাহলে কেন সরকার এই বোর্ডগুলি বন্ধ করে দিচ্ছে? তার একটাই কারণ এই বাজারগুলি কর্পোরেট কোম্পানিগুলির হাতে তুলে দেবে। রিলায়েন্সের মত কোম্পানিগুলি ওঁত পেতে রয়েছে এই বাজারগুলি দখল করার জন্য। হ্যান্ডলুম-এর জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটে বরাদ্দও অনেক কম করে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, কয়েকদিন আগে এই সরকারের চাপানো জিএসটি-র প্রভাবে তাঁত ব্যবসায় আরও মন্দা শুরু হয়। তারপর এই লকডাউনের মধ্যে মানুষের জীবন-জীবিকা যখন চরম সংকটে তখন এই সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও সরকারী সম্পত্তি বিক্রি করে, শ্রম আইন, পরিবেশ আইনের জনবিরোধী পরিবর্তন এনে বুঝিয়ে দিচ্ছে তাদের আসল উদ্দেশ্য আসলে দেশীয় উৎপাদনের বিকাশ ঘটানো নয়, এই দেশের সম্পদকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দিয়ে সাধারণ মানুষের পেটে লাথি মারা। এইসব বোর্ডগুলি বাতিল করে দেবার ফলে শিল্পের সাথে জড়িত মানুষের কথা শোনার প্রয়োজনীয়তা সরকারের আর থাকলো না। দেশী, বিদেশী পুঁজিপতিরা এসে আস্তে আস্তে গ্রাস করে নেবে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে, প্রচুর মানুষ এবং বিশেষ করে বহু মহিলা কাজ হারাবেন। ইতিমধ্যেই সিএমআইই রিপোর্ট অনুযায়ী সংগঠিত এবং অসংগঠিত দুটি ক্ষেত্রেই লকডাউনের পর্যায়ে মার্চ এবং এপ্রিলের মধ্যে কাজ হারিয়েছেন ১৭ লক্ষ মহিলা। এখন মোদি সরকার কুটির শিল্পকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ে আরও বহু কোটি মানুষকে কর্মহীন করার রাস্তা পাকা করল।

- মিতালি বিশ্বাস  
সূত্র- livemint.com, firstpost.com, thewire.com  

খণ্ড-27
সংখ্যা-29