আদালত অবমাননা, মানহানি বা সিডিশন - ঔপনিবেশিক এই আইনগুলি বিলুপ্ত করা আজ সময়ের দাবি
dasa

প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে ‘আদালত অবমাননা’র রায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া এযাবৎ সবচেয়ে উদ্ভট রায় হিসেবে পরিগণিত হবে। সর্বোচ্চ আদালত প্রশান্ত ভূষণের দুটি ট্যুইটের বিরুদ্ধে স্বতপ্রণোদিত হয়ে মামলা শুরু করল এবং শেষে শতাধিক পৃষ্ঠার এক রায় ঘোষণা করল যে রায়ে তাঁকে কেবলমাত্র ‘অবমাননা’র অপরাধেই নয়, এমনকি গণতন্ত্র ও ন্যায়ের সাংবিধানিক ভিত্তিকেই টলিয়ে দেওয়ার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হল।

বছরের পর বছর, এমনকি দশকের পর দশক যেখানে হাজার হাজার মামলা পেণ্ডিং পড়ে আছে, শুনানি পর্যন্ত হয়না, সেখানে যে দ্রুততায় এই বিচারটি সম্পন্ন হল তা লক্ষ্যনীয়। ‘আদালত অবমাননা’ বিধিটি আসলে ঔপনিবেশিক শাসনের মতবাদ থেকে আসা, যাকে ১৯৭১ সালে আইনে পরিণত করা হয়। এই আইনটির চরিত্র কতদূর অযৌক্তিক ও স্বৈরতান্ত্রিক তা বোঝার জন্য একটি উদাহরণই যথেষ্ট। ২০০৬ সালে আইন সংশোধন করে অবমাননার অভিযোগের বিরুদ্ধে সত্যকে এক গ্রহণযোগ্য যুক্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় (না হলে আইনের চোখে সত্যকথনও ছিল অবমাননাকর)।

আইনটি নিজেই যেখানে স্বেচ্ছাপ্রসূত ও অবাধ তখন কেবল বেছে বেছে প্রয়োগ হলে তা আরও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। বাবরি মসজিদ ধ্বংস সবচেয়ে প্রকট একটি ক্ষেত্র যেখানে একটি সরকার এবং একটি রাজনৈতিক দল ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে তাদের প্রতিশ্রুত দায়বদ্ধতাকে অবমাননা করে। আঠাশ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও সেই মামলা চলছে, আর সেই আদালতই ওই জমিকে মন্দির নির্মাণের জন্য ধার্য্য করেছে, তার ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপিত হয়ে গেছে। সমকাজে সমমজুরিকে বাধ্যতামূলক করেছে আদালত, কিন্তু একের পর এক সরকার তা অমান্য করে চলেও কখনও আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয় না। অথচ মাত্র দুটি ট্যুইটকে ভারতের বিচার বিভাগের অখণ্ডতা ও সুনাম ধ্বংস করার চরম আঘাত হিসেবে গণ্য করা হল।

প্রশান্ত ভূষণের ট্যুইটগুলিই অবশ্য আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সর্বপ্রথম চর্চিত ঘটনা নয়। ২০০২-র ৬ মার্চ লেখক অরুন্ধতী রায় এই একই ‘অপরাধে’ অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ২০১৭-র ৯ মে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক সিএস কারনানকে একই অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করেছিল সুপ্রিম কোর্ট এবং এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি, ছয় মাসের কারাবাসে, দণ্ডিত করেছিল। এই সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতের উচিৎ এই অবমাননা আইন ও তার অন্যান্য ঔপনিবেশিক দোসর সিডিশন ও মানহানির মতো আইনগুলি বিলুপ্ত করা। এইসব আইন কেবলমাত্র বিরোধী কণ্ঠস্বরকে অপরাধ বানাতে ও সমালোচনার স্বাধীনতাকে খর্ব করতেই প্রযুক্ত হয়।

প্রশান্ত ভূষণের জারি করা বিবৃতি, যাকে বিচারক অরুণ মিশ্র নিছক ‘তাঁর অপরাধকেই বাড়িয়ে তুলেছে’ বলে মনে করেন, তা গণতন্ত্রকে বিরোধিতাশূন্য বানানোর এবং সংবিধান লাগাতার আক্রান্ত হওয়ার এই দুঃসময়ে সত্য ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে জনতার বিবৃতি হিসেবে দেশজুড়ে অনুরণিত হয়েছে। প্রশান্ত ভূষণের প্রতি অভূতপূর্ব জনসমর্থন ভারতে প্রতিবাদ ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের পক্ষে সবচেয়ে ভরসা-জাগানো লক্ষণ।

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য   

খণ্ড-27
সংখ্যা-30