শান্তিনিকেতনে বর্গি হানা -- ভেঙ্গে ফেল অচলায়তন
sared

“প্রাচীরের আকার ধরে আকাশের জ্যোতি আচ্ছন্ন করতে উঠবে
তখন সেই প্রাচীর ধুলোয় লুটিয়ে দিতে হবে।”

এই কথা অচলায়তনে আছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি চরিত্র বলছেন। সম্প্রতি বিশ্বভারতীর মেলার মাঠের চারপাশে পাঁচিল তৈরি করছিলেন কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ না বলে উপাচার্য ও তার বাহিনী বলা ভাল। সেই পাঁচিল ভেঙে দিয়েছেন স্থানীয় মানুষ। কিছু কাল আগে পরিবেশ আদালতে বিশ্বভারতী বলেছিল, তারা মেলা প্রাঙ্গনের সীমানা নির্ধারণ ও ব্যারিকেড করবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ওই মাঠ ইটের পাঁচিল দিয়ে ঘিরতে হবে। বিশ্বভারতীর সঙ্গে যুক্ত আমাদের মতো অনেকেই জানেন, মেলার মাঠ একটি উন্মুক্ত জায়গা। সেই জায়গাকে ঘিরে ফেলা মানে বিশ্বভারতীর বুকের উপর পাঁচিল তোলা। তাছাড়া, স্থানীয় যুবক যুবতীরা এখানে খেলাধূলা করতে আসেন। আসবেনই। বিশ্বভারতীতে বাইরের পর্যটকদের ঘোরাঘুরিও বৈধ। হঠাৎ মেলার মাঠকে ঘিরে ফেলে উপাচার্য কোন বার্তা দিতে চাইছেন, বোঝা বেশ সহজ। তবে স্থানীয় লোক তাঁকে সমুচিত জবাব দিয়েছেন। পৌষমেলা, বসন্ত উৎসবের মতো ঐতিহ্যশালী অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ঐতিহ্যবিরোধী কাজ করেছেন।

উপাচার্যের এ হেন ক্রিয়াকলাপ শান্তিনিকেতনকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা। এমনিতে বিশ্বভারতী জাতীয় স্তরে বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বেশ নিম্ন মানের। উচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর গেরুয়া সন্ত্রাসের কথা সুবিদিত। জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়ার উপর যে বর্বর আক্রমণ চালানো হয়েছে, বিশ্বভারতীতেও অনুরূপ হামলা করে উপাচার্য গেরুয়া হুকুম পালন করছেন মাত্র। মুক্ত শিক্ষাঙ্গনটিকে তাঁরা বদ্ধ করতে চাইছেন। রবীন্দ্রনাথ যে উন্মুক্ত প্রতিষ্ঠানের বীজ বপন করে গিয়েছেন, তাকে বদ্ধ করতে না পারলে গেরুয়া স্বার্থ সিদ্ধ হবে না। তাই উপাচার্যের কাছে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ‘বিশ্বভারতীতে বহিরাগত’। সে কথা উপাচার্য নিজেই বলেছেন। নারী লাঞ্ছনার অভিযোগে অভিযুক্ত এই উপাচার্য আরও বলেছেন, মেলার মাঠে নাকি দেহ ব্যবসা হয়, মাঠে ব্যবহৃত কণ্ডোম পড়ে থাকতে দেখেছেন তিনি। একই অভিযোগ করা হয়েছিল জেএনইউ ও জামিয়ার ক্ষেত্রে। এই সব মিথ্যে অভিযোগে এরা বেশ পটু।  

এই উপাচার্যই আবার বিশ্বভারতীর গোলমাল নিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন, তাঁর সেই দাবি খারিজ হয়েছে কিন্তু ইতিমধ্যে সেখানে ইডি নাক

গলিয়েছে। কিন্তু কেন ইডি? এর আগে মেটিয়াবুরজে ত্রাণ বিলি নিয়ে গোলমালের সময়ও ইডি নাক গলিয়েছিল। স্বতস্ফূর্তভাবে জড়ো হয়ে বিভিন্ন মতাবলম্বী মানুষ যখন পাঁচিল গুঁড়িয়ে দেন, তখন বুঝতে হবে, এই অচলায়তন তাঁরা সমর্থন করছেন না। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের অতি সক্রিয়তা তাই যুগপৎ হাস্যকর ও দুঃখজনক। এই সব কাণ্ডে স্পষ্টত বোঝা যায়, এই কাণ্ডের পেছনে কেন্দ্রের শাসক দল প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের এই সব কাজকে সমর্থন করছেন না। স্মরণে রাখা দরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব চেয়ে বড় স্টেক হোল্ডার ছাত্রছাত্রীরা, সেখানে তাঁদের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা ওই পাঁচিল চাইছেন না। আশ্রমিকদের মতামত নেওয়াও অত্যন্ত দরকারি। আশ্রমিকরাও প্রাচীরের নিন্দা করেছেন। কিন্তু উপাচার্য সে সবের ধারকাছ দিয়ে যাচ্ছেন না, তিনি ক্ষমতা ও পদের স্পর্ধা দেখাচ্ছেন বার বার।

যে দুই রাজনৈতিক দল বিশ্বভারতীর পাঁচিল নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন, তাঁদের বোঝা উচিত — তাঁদের মতামত নয়, ছাত্রছাত্রী ও আশ্রমিকদের মত নিয়ে যা করার করতে হবে। সীমানা নির্ধারণ আর ইটের পাঁচিল তোলা এক কথা নয়। সত্যিই বিশ্বভারতী এখন কুস্তির আখড়া হয়ে উঠেছে।

আবার বিশ্বভারতীর পাঁচিল ভাঙা নিয়ে কলকাতার জোড়াসাঁকোয় বিজেপি পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। তাঁরা এখন সকলে রবীন্দ্র ভক্ত হয়ে উঠতে চাইছে, ভোট বড় বালাই। তাঁদেরই চালিকাশক্তি আরএসএস স্কুলের পাঠ্যবই থেকে বাদ দিতে চায় ইংরেজি, উর্দু শব্দ, উঠিয়ে দিতে চায় রবীন্দ্রনাথ ও মির্জা গালিবকে। আরএসএস-এর শিক্ষা শাখা বিদ্যাভারতীর প্রাক্তন প্রধান দীননাথ বাত্রা পাঁচ পাতার প্রস্তাবে দাবি করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের মতো লোকজনের সাহিত্য না পড়িয়ে রাণা প্রতাপ, শিবাজীদের জীবনী পড়ানো হোক। রবীন্দ্রনাথের কবিতা নাকি মানবতাবিরোধী!

তাঁরা বিশ্বভারতীকে পাঁচিল দিয়ে অবরুদ্ধ করবেই। এবং মানুষই ভাঙবে সেই অবরোধ। কয়েক দিন আগে যেমন ভেঙেছেন।

-- শামিম আহমেদ  

খণ্ড-27
সংখ্যা-30