দিল্লী পুলিশের “দাঙ্গা তদন্ত” সমান নাগরিকত্বের দাবিতে লড়া নাগরিকদের ওপর নির্যাতন ছাড়া অন্য কিছু নয়
del

প্রথমে দিল্লী দাঙ্গার তদন্তের চার্জশিটে বাম নেতৃবৃন্দের নাম ঢোকানো হল এবং তারপর গ্ৰেপ্তার করা হল ছাত্র আন্দোলনের কর্মী উমর খলিদকে। এরপর থেকেই দিল্লী পুলিশের “দাঙ্গা তদন্ত”র সমালোচনা ও তাকে ধিক্কার জানানোটা তীব্রতর হয়ে উঠেছে। সারা ভারতেরই ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সমাজ আন্দোলনের কর্মীরা, এবং এর সাথে এমনকি প্রাক্তন পুলিশ অফিসাররাও দিল্লী পুলিশ কমিশনারের কাছে চিঠি লিখে পুলিশ যে একদেশদর্শী ধারায় “তদন্ত” চালাচ্ছে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

ক্রমেই বেড়ে চলা এই সমস্ত নিন্দার চাপের মুখে দিল্লী পুলিশ শশব্যস্ত হয়ে একের পর এক “ব্যাখ্যা” ও বিবৃতি হাজির করতে থাকে। এই বিবৃতিগুলো সুনিশ্চিতভাবে কোনো কিছুকে যদি প্রতিপাদিত করে থাকে তবে তা হল – কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় তাদের এই যে নির্লজ্জ কর্মকাণ্ড তার পক্ষে দাঁড়ানো বা তাকে গোপন করতে পারাটা দিল্লী পুলিশের পক্ষে একেবারেই সম্ভব হচ্ছে না।

দাঙ্গার বিভিন্ন মামলায় দিল্লী পুলিশ যে সমস্ত চার্জশিট পেশ করেছে তাতে নাম রয়েছে সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই(এমএল)-এর পলিটব্যুরো সদস্য কবিতা কৃষ্ণাণ, স্বরাজ অভিযান নেতা যোগেন্দ্র যাদবের মতো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের; অধ্যাপক অপূর্বানন্দ ও জয়তী ঘোষের মতো বুদ্ধিজীবীদের; চলচ্চিত্র নির্মাতা রাহুল রায়ের; জেএনইউ-র ছাত্র আন্দোলনের প্রাক্তন নেতা উমর খলিদ এবং এআইএসএ, জেসিসি ও পিঁজড়া তোড়-এর মতো ছাত্র সংগঠন ও মঞ্চের কর্মীবৃন্দের। চার্জশিটে এঁদের নাম থাকার কারণ হিসাবে পুলিশ জানিয়েছে যে, কয়েকজন অভিযুক্ত “গোপনে দেওয়া বিবৃতিতে” এঁদের নাম প্রকাশ করেছেন। এরপর ক্রোধ ও নিন্দার যে ঝড় বয়ে যায় তাতে অনেকেই জানান যে, পুলিশি হেফাজতে নেওয়া এই ধরনের “গোপনে দেওয়া বিবৃতি”র আইনসম্মত সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে কোনো গুরুত্ব নেই, কেননা, সেগুলোর পুলিশের নিজেরই বয়ান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দিল্লী হিংসার ঘটনাগুলোতে “গোপনে দেওয়া বিবৃতিগুলো” পুলিশের নিজেরই লিখে দেওয়া বয়ান হওয়ার ধারণাকে জোরালো করছে এই ঘটনা যে, বিভিন্ন ব্যক্তির বিবৃতি বলে যা বলা হচ্ছে সেগুলোর ভাষা হুবহু এক বলে দেখা যাচ্ছে; এবং এই ঘটনাও ওই ধারণাকে জোরালো করছে যে অন্ততপক্ষে তিন অভিযুক্ত — সাফুরা জারগর, নাতাশা নারওয়াল এবং দেবাঙ্গনা কলিতা – যে বিবৃতি দিয়েছেন বলে বলা হচ্ছে তাতে তাঁরা “স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করছি” শব্দগুলোও লেখেন। বিভিন্ন ব্যক্তি এই অভিযোগ করেছেন বলেও জানা গেছে যে, পুলিশের কাছে তাঁদের মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা হয়েছে: বলা হয়েছে, হয় মিথ্যা এজাহার দিয়ে আন্দোলনকারীদের অভিযুক্ত করতে হবে, আর না হয় দানবীয় ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত হতে হবে।

এই সমস্ত সমালোচনার জবাবে দিল্লী পুলিশ এই “ব্যাখ্যা” হাজির করে যে, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদদের যে নাম রয়েছে তা হল “সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভ সংগঠিত করা ও তাতে বক্তব্য রাখার সঙ্গে যুক্ত এক অভিযুক্তর গোপনে দেওয়া বিবৃতির অংশ।” দিল্লী পুলিশ যেমন এই দাবি করেছে যে “গোপনে দেওয়া বিবৃতিতে অভিযুক্ত যে কথাগুলো বলেছেন তা যথাযথভাবে লিপিবিদ্ধ করা হয়েছে”, একই সাথে তারা এটাও বলেছে যে, “গোপনে দেওয়া বিবৃতির ভিত্তিতেই কাউকে অভিযুক্ত রূপে হাজির করা হয় না। আর, দৃঢ় সমর্থনসূচক সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকলে তবেই আরও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।” এর পরদিনই দিল্লী পুলিশ উমর খলিদকে গ্ৰেপ্তার করে এবং তা শুধুই “গোপনে দেওয়া বিবৃতির” ভিত্তিতে যা তার ওপর হিংসায় প্ররোচনা দেওয়ার বক্তব্য রাখার দায় চাপিয়েছে। উমর খলিদ হিংসায় প্ররোচনা দিয়েছে বলে গোপনে দেওয়া বিবৃতিতে যে দাবি করা হয়েছে তার সমর্থনে “দৃঢ় সমর্থনসূচক সাক্ষ্যপ্রমাণ” কোথায়? এর বিপরীতে, সমদর্শী আইনের দাবিতে আন্দোলনের সময় উমর খলিদ বৈষম্যমূলক সিএএ এনআরসি এনপিআর আইনগুলোর বিরুদ্ধে যে ভাষণগুলো দেন তাতে হিংসার মুখেও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের আহ্বান রাখা সম্পর্কে যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে।

নাতাশা নারওয়াল এবং দেবাঙ্গনা কলিতার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া যে মামলাগুলোর ভিত্তিতে তাঁদের গ্ৰেপ্তার করা হয়, সেগুলোর কয়েকটার জামিন মঞ্জুরির আদেশে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পুলিশের দাবির বিপরীতে জনসমক্ষে দেওয়া তাঁদের ভাষণে কোনো হিংসা উস্কিয়ে তোলা হয়নি, শুধুই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের আহ্বান জানানো হয়। সাক্ষ্যপ্রমাণের পুরোদস্তুর অভাবকে পুষিয়ে নিতেই পুলিশ ইউএপিএ-তে অভিযোগ দায়েরের আশ্রয় নিচ্ছে। ইউএপিএ এমন একটা আইন যা পরিকল্পিতই হয়েছে সরকারের সমালোচকদের আক্রমণের নিশানা বানানোর অস্ত্র হিসাবে: এটা এমনই আইন যার অধীনে রাষ্ট্র যে কোনো অভিযোগের ভিত্তিতেই জামিন না দিয়ে কোনো বিচার না করে কোনো ব্যক্তিকে বছরের পর বছর জেলে আটক রাখতে পারে। রাজ্য সভায় তোলা এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক স্বীকার করেছে যে ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ইউএপিএ-তে দায়ের করা ৩০০৫টি মামলার মধ্যে মাত্র ২৭ শতাংশের ক্ষেত্রে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, আর এই তথ্যটা এই আইনের অধীনে মামলাগুলোর পলকা চরিত্রকেই দেখিয়ে দেয়। এ সত্ত্বেও পুলিশ তদন্তে অনন্তকাল ধরে বিলম্ব ঘটাতে পারে, এবং মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বছর-বছর ধরে জেলে পচতে থাকে। পরবর্তীকালে কোনো অভিযুক্ত খালাস পেলেও ইউএপিএ আইনের অধীনে অভিযুক্ত হওয়ার কারণেই সে শাস্তি পেয়ে যায়।

প্রাক্তন পুলিশ প্রধান জুলিয়ো রিবেইরো দিল্লী পুলিশ কমিশনারকে একটা চিঠি লিখে এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে – দিল্লী পুলিশ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের জন্য নাগরিকদের গ্ৰেপ্তার করলেও কপিল মিশ্র ও অনুরাগ ঠাকুরের মতো বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ওই চিঠির প্রত্যুত্তরে দিল্লী পুলিশ কমিশনার এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, পুলিশের পক্ষপাতদুষ্টতা নিয়ে দুরভিসন্ধি পোষণ করা ব্যক্তিদের “উদ্ভাবিত মিথ্যা গাল-গল্পে” রিবেইরোর নিজের নাম জড়ানো উচিৎ নয়। পুলিশ কমিশনারের প্রত্যুত্তরের অনুকরণ করে দিল্লী পুলিশের এক প্রতিনিধিও মিডিয়ার কাছে একটা বিবৃতি পেশ করেন যাতে দাবি করা হয় যে তারা হিন্দু ও মুসলিমদের সমান চোখেই দেখেছে। বলা হয়, “দাঙ্গার ঘটনাগুলোতে ২৫০টা চার্জশিট দেওয়া হয়েছে যাতে মোট ১১৫৩ জন অভিযুক্তর বিরুদ্ধে (৫৭১ জন হিন্দু ও ৫৮২ জন মুসলমান) চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।” এই দাবিটা বিভ্রান্তিকর। অভিযুক্ত হিন্দু ও মুসলমানদের সংখ্যা তুলে ধরে দিল্লী পুলিশ যে প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে তা হল সমদর্শী নাগরিকত্বের (সিএএ-বিরোধী) জন্য আন্দোলনকারীদের তুলনায় সিএএ সমর্থনকারী কত জনকে ইউএপিএ এবং অন্যান্য কঠোর আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে? যে ৫৭১ জন হিন্দুকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে সমদর্শী নাগরিকত্বের দাবি জানানো নাতাশা ও দেবাঙ্গনা ছাড়া অন্য কাউকে কি ইউএপিএ সহ কঠোর আইনগুলোর ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে? তাদের মধ্যে ব্যাপক সংখ্যাধিকের বিরুদ্ধেই কি লঘু আইনে অভিযোগ দায়ের হয়নি?

ওপরে উল্লেখিত দিল্লী পুলিশের বিবৃতিতে এই ঘটনার বিরুদ্ধে আপত্তি জানানো হয়েছে যে “বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সোশ্যাল মিডিয়ার মঞ্চসমূহ এবং অন্যান্য অনলাইন পোর্টালগুলোকে কাজে লাগিয়ে উত্তর পূর্ব দিল্লীর দাঙ্গার ঘটনাগুলোর তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।” এইভাবে বোঝানো হয়েছে যে – রিবেইরোর চিঠির উত্তরে পুলিশ কমিশনার যেমন জানিয়েছিলেন – তদন্ত নিয়ে কারুর ক্ষোভ থাকলে তাদের সামাজিক মাধ্যম ও নতুন পোর্টালগুলোকে ব্যবহার না করে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ। এই সমস্ত প্রতিক্রিয়া এটাই দেখাচ্ছে যে, তাদের সমালোচকদের নিয়ে, এবং স্বাধীন মিডিয়ার স্বাধীন মতপ্রকাশ নিয়ে দিল্লী পুলিশের কিছু সমস্যা রয়েছে (প্রসঙ্গত, অনলাইন সংবাদ পোর্টালগুলোই দিল্লীর হিংসা ও পুলিশি তদন্ত নিয়ে সবচেয়ে পরিশ্রমসাধ্য প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করেছে)। এরই সাথে দিল্লী পুলিশ যে সরকারের ধামাধরা কিছু মিডিয়া সংস্থাকে বেছে নিয়ে তাদের কাছে হেফাজতে করা “স্বীকারোক্তি”কে (বানানো) ফাঁস করেছে তা নিয়ে তাদের কোনো বিবেক দংশন নেই। আর এগুলোকে ফাঁস করা হয়েছিল সমদর্শী নাগরিকত্বের জন্য আন্দোলনকারী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে। এই সমস্ত ফাঁসকে আটকাতে দিল্লী হাইকোর্টকে একটা বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হয়। ঘটনা হল, গণতন্ত্রে পুলিশ এবং তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে সাধারণ নাগরিকদের বিচার-বিশ্লেষণ এবং প্রশ্নকে খোলা মনে গ্ৰহণ করতে হবে; এই সব প্রশ্নকে আদালত কক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না, যে আদালতের দ্বারস্থ খুব কম লোকই হতে পারে।

পুলিশ কমিশনারের প্রত্যুত্তরের পাল্টা জবাবে রিবেইরো যথার্থভাবেই বলেছেন যে, বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর এবং সাংসদ প্রবেশ ভার্মাকে “গলাবাজি করা, ধাতানি দেওয়া এবং উপলব্ধ অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের প্রতি হুমকি দেওয়ার” যে “লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে” পুলিশ কমিশনার সে সম্পর্কে মুখে কুলুপ এঁটেছেন”।

দিল্লী পুলিশের ১১ লক্ষ পাতার চার্জশিট এবং তাদের আত্মরক্ষামূলক বিবৃতিগুলো সত্যটাকে আড়াল করতে পারবে না। দিল্লী পুলিশ একদিকে সমদর্শী আইনের জন্য আন্দোলনকারীদের শাস্তি দিতে ইউএপিএ-র মতো দানবীয় আইনের প্রয়োগ ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে দিল্লী হিংসার প্রকৃত সংঘটকদের রক্ষা করছে। তারা সমালোচনার জবাবে বলছে যে, সমালোচকরা হয় “দুরভিসন্ধি চালিত কায়েমি স্বার্থের” প্রতিনিধি, আর না হয় এই ধরনের লোকেদের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছেন। যে বিজেপি নেতাদের তারা রক্ষা করছে তাদের কি কোনো অভিসন্ধি ও কায়েমি স্বার্থ নেই? দিল্লী পুলিশ কেন তাদের হাতে নিজেদের ব্যবহৃত হতে দিচ্ছে?

লক্ষ-লক্ষ পাতার চার্জশিট আমাদের বেরটোল্ট ব্রেখটের এই কথাগুলো মনে পড়িয়ে দিচ্ছে: “সরকারের বিপুল ক্ষমতা/তাদের শিবির ও নিপীড়ন কক্ষগুলো/তাদের হৃষ্টপুষ্ট পুলিশ/তাদের সশঙ্ক বা অসাধু বিচারপতিরা আছে বলে/গোটা বাড়িটার ছাদ পর্যন্ত ঠাসা/কার্ডে লেখা পরিচয়পত্র এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তালিকা আছে বলে/লোকটার মনে হয় ওদের/একটা সাদাসিধা লোকের খোলামেলা কথায় ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” সারা ভারতের সহজসরল জনগণ শুধুই “খোলামেলা কথা” দিয়ে, তাদের ঐক্য এবং সত্যের প্রতি তাদের অঙ্গীকারকে আয়ুধ করে প্রতিশোধলিপ্সু এক সরকারের মোকাবিলা করছেন। এই সরকারটাই জনগণকে ভয় পাচ্ছে।

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০)   

খণ্ড-27
সংখ্যা-34