প্রতিবেদন
কীভাবে থাকেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা?
wrw

আলোচনা : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাজর্ষি দাশগুপ্ত

‘সমাজ ও চিন্তা’ নামের একটি উদ্যোগের পক্ষ থেকে গত তিন দশক যাবৎ সমাজতত্ত্ব ও সমাজ-আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে। কোভিড সংক্রমণের পরিস্থিতিতে মুখোমুখি আলোচনার পরিসর ছেড়ে এই প্রথম গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০তে এই আলোচনা হল গুগল মিট-এর মাধ্যমে, অনলাইন পরিসরে। এদিনের আলোচক ছিলেন দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রাজর্ষি দাশগুপ্ত। রাজর্ষি দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন, সমীক্ষা চালাচ্ছেন, লিখছেন নগরায়ণের নতুন নতুন দিকগুলি নিয়ে। এইসূত্রে তাঁর লেখালেখিতে খুব বেশি করে উঠে আসে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রসঙ্গ। কারণ এই নতুন নগরায়ণের সঙ্গে তাদের বিরাট যোগ। এই লকডাউন পর্বে পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্কটের দিকটি সাম্প্রতিক সময়ে খুব বেশিভাবে সামনে এসেছে। এই আলোচনায় রাজর্ষি মূলত ভারতের পরিযায়ী শ্রমিক ও তাদের বাসস্থান, কাজের ধরন ও সংশ্লিষ্ট দিকগুলি নিয়ে কথা বলেছেন। সেই কথা শুনতে শুনতেই আমরা কিছু নোট নিয়েছিলাম। পরে সেটি রাজর্ষির কাছে পাঠানো হয় এবং সেটি তিনি অনুমোদন করেন। সেই নোটটিই পয়েন্ট আকারে আমরা পাঠকের সামনে তুলে দিচ্ছি।

‘পাড়া থেকে পাড়া গাঁ – গরিবের ঠিকানা ও মহানগরের চরিত্র’ এই শিরোনামকে সামনে রেখে দক্ষিণ এশিয়ায় নগরায়নের সাম্প্রতিক প্যাটার্ন নিয়ে এই আলোচনায় রাজর্ষি দাশগুপ্ত বললেন,

গ্রাম শহরের পারস্পরিক সমীকরণের পুনর্বিন্যাস ঘটছে। নয়া উদারনীতিবাদের সময় নগরায়ণ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।

আমরা সাধারণভাবে দেখি গ্রাম ধীরে ধীরে শহরকে তার জায়গা ছেড়ে দেয়।

এখন আমরা দেখছি শহরের তলায় আধা গ্রাম। এমন মানুষদের দেখি পথই যাদের ঠিকানা, পথেই তাদের বাস। বাঁচার জন্য তাদের বার বার ফিরতে হয় গ্রামে।

রাহি মাসুম রাজা লিখেছিলেন আধা গাঁও। এটা একটা ছোট কবিতা দিয়ে শুরু হচ্ছে। গ্রাম থেকে শহরে কীভাবে লোকে যায়, গ্রামকে পেছনে ফেলে যায়, সেটাই আমাদের ভাবনার কাঠামো।

১৯৪৯ সালে এটা লেখা। কোলকাতায় তখন অনেক চটকল। সেখানে গ্রাম থেকে আসা মানুষদের ভিড়। কলকাতা, মুম্বাই, ঢাকা, কানপুরের কথা আসছে এই আখ্যানে।

এখান থেকে আমরা চলে আসতে পারি বর্তমান সময়ে। এই সময় আমরা দেখলাম পরিযায়ী শ্রমিকদের বাস্তব। আজিজ প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয় ৫,০০০ পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে এই পর্বে এক সমীক্ষা করে। সেখানে পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবিকার ভয়ানক সঙ্কট ও অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর কথা উঠে এসেছে। চাষিরা ফসল বেচতে পারেননি, বা বেচলেও অনেক কম দামে বেচতে হয়েছে। খারিফ শস্য মার খেয়েছে, বীজ, সার কেনায় সমস্যা হয়েছে। জমানো টাকায় টান পড়েছে। দশ জনের মধ্যে আটজন ভয়ানক সমস্যায় পড়েছেন। শহরে বসবাসকারী শ্রমিকদের অবস্থা হয়েছে সবচেয়ে খারাপ।

বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে জিডিপি প্রায় ১২ শতাংশ কমতে চলেছে। অর্থনীতি ও চাকরির বাজার আরো সংকুচিত হচ্ছে। শ্রমিক শ্রেণির ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়তে চলেছে।

আজকে ভারতের শ্রমিক শ্রেণির ৯০ শতাংশের বেশি আছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, উত্তরপ্রদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ করতে যান দিল্লি, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কেরালার শহরগুলোতে।

কীভাবে থাকেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা? মহারাষ্ট্রের ধারাভির কথা ধরা যাক। এখানে ২৫ থেকে ৩০টি পরিবার পিছু একটি করে শৌচাগার। প্রায় সাত লক্ষ লোক এভাবে থাকেন এখানে।

ন্যাশানাল ক্যাপিটাল রিজিয়ন-এ বিহার থেকে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে করা এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে তারা প্রায় দু’মাস রোজগার বিহীন ছিলেন। এরপর ৩২ লক্ষ শ্রমিক বিহার সরকারের থেকে আশ্বাস পেয়ে রাজ্যে ফিরে আসেন। কিন্তু ফিরে এসেও তারা কাজকর্ম তেমন কিছু পাননি।

গবেষক ঋতজ্যোতি মোহালির জগৎপুর নামে এক গ্রামের কথা বলেছেন। এ ধরনের গ্রাম টায়ার টু শহরের পাশে বা মধ্যে অনেক আছে। তারা কীভাবে মহানগরের কাজে লাগে সেটা দেখার। এই গ্রাম গড়ে উঠেছে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে। বড় বড় শহরের মধ্যে এরকম অনেক লেবার কলোনি গড়ে উঠেছে। এরা লকডাউন শুরু হবার পর পায়ে হেঁটে নিজেদের গ্রামে ফিরতে বাধ্য হন। অনেক ক্ষেত্রেই তা বারোশো থেকে পনেরোশো কিলোমিটার দূরে।

খোড়া কলোনি এনসিআর অঞ্চলে। এটা এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ পরিযায়ী শ্রমিকদের কলোনি। মূলত বিহার, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ থেকে এক লক্ষ মানুষ এখানে এসে থাকেন। ইউটিউবে রাভিশ কুমারের এই সংক্রান্ত একটি ভিডিও আছে। খোড়া কলোনির পরিযায়ী শ্রমিকদের বিরাট ভূমিকা আছে নয়ডার আর্থিক বিকাশে। কিন্তু তাদের অবদান প্রায় হিসেবের বাইরে থেকে যায়।

বামপন্থী রাজনীতি কারখানা পরিসর নিয়ে যতটা কাজ করেছে, বাসস্থান ও মহল্লার মধ্যে বেঁচে থাকা, বাসস্থানের অধিকার নিয়ে ততটা করেনি – এটা রাজর্ষি মনে করে করেছেন তাঁর আলোচনায়। সেইসঙ্গে তিনি এও মনে করেছেন বাম রাজনীতির ঘুরে দাঁড়ানো, শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে তাদের জনভিত্তিকে ফিরে পাবার জন্য কারখানা বা কাজের পরিসরের বাইরে বাসস্থান বা মহল্লার মধ্যে কাজের পরিসর বাড়ানো দরকার। মহল্লার ও বাসস্থানের অবস্থার উন্নতিকে দাবিদাওয়া আন্দোলনের মধ্যে আরো বেশি করে নিয়ে আসার দরকার।

দক্ষিণ এশিয়ার বড় বড় শহরে অরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে যারা কাজ করেছেন তারা জানিয়েছেন পরিযায়ীরা মূলত ভাড়াটে হিসেবে এই “আর্বান ভিলেজ”গুলোতে থাকেন। এশিয়ায় কম খরচের ভাড়াবাড়িতে যারা থাকেন তাদের ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিক। এগুলির অনেকগুলিই বেআইনি লেবার কলোনি। গবেষক মুক্তা নায়েকের এই সংক্রান্ত কাজ আছে গুরগাঁও নিয়ে। দেবীলাল কলোনি সহ আরো কিছু গ্রাম নিয়ে তিনি কাজ করে দেখিয়েছেন সরকারী আবাস দেবার যোজনাগুলি কেন এরা পাচ্ছে না। এই যোজনাগুলি পাবার শর্ত আছে। বাড়ির মালিকেরাই এগুলি পাবার অধিকারী। ভাড়াটে পরিযায়ীরা এগুলি পাবার অধিকারী নন। পরিযায়ীদের মধ্যে অনেকে বেআইনি লিজ-এ থাকে। অনেকে ভাড়া দেয়। অনেকে ভাড়া দেয়না, নানা রকম ফাই ফরমাস খেটে দেয়।

এশিয়ায় বাড়ি ভাড়ার আশি শতাংশ এমন বাড়ি যেখানে নিম্নবিত্তরা নিজেদের বাসগৃহকে বাড়িয়ে বাড়া দেন। এই ভাড়াটাই তাদের আয়ের একমাত্র পথ।

ভারতের নানা লেবার কলোনি, যেমন ব্যাঙ্গালোরে আগেই ভাড়ার টাকা অগ্রিম দিতে হয়। একটি বড় হলে ডর্মিটারি ধরনে ভাড়া দেওয়া হয়।

আশি বছর আগে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন “মমতাদি” নামের উপন্যাস। ১৯৪৬ সাল নাগাদ আখ্যানটা লেখা হয়। ‘জীবনময় লেন’ নামটা একটা ঠাট্টা হয়ে ওঠে। আর একটি লেখা “শহরবাসের ইতিকথা”। এই আখ্যানগুলি আজকের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যায়।

- প্রতিবেদক, সৌভিক ঘোষাল  

খণ্ড-27
সংখ্যা-32