নতুন শিক্ষানীতি : বাজার ও রাষ্ট্রের নতুন সমীকরণ
edt

বিগত ২৯ জুলাই সরকারিভাবে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষিত হওয়ার পরে এই বিষয়ে আলোচনা এবং বিতর্ক চলছেই। মোদি সরকারের সমস্ত নীতির ক্ষেত্রেই এই উলট-পুরান চলে – আলোচনা সবসময়ে নীতি ঘোষণার পরে হয়, আগে নয় কারণ গণসংগঠন থেকে আরম্ভ করে সংসদ পর্যন্ত পর্যালোচনার সমস্ত পরিসর থেকেই নীতিগুলিকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রাখা হয় যতদিন না আকাশবাণী বা বজ্রাঘাতের মতো সেগুলি নাগরিকদের ঘাড়ে এসে পড়ে। এবারেও লক ডাউনের কারণে যখন মার্চ মাস থেকে সংসদের কাজকর্ম বন্ধ, রাজ্য সরকারগুলি করোনার সংক্রমণ নিয়ে এবং দেশের সাধারণ মানুষ চরম আর্থিক সংকটে জর্জরিত সেই সময়ে প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোর মাধ্যমে কয়েকটি পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড জারি করে জানানো হয় যে নতুন শিক্ষানীতি মন্ত্রীমণ্ডলের অনুমোদন পেয়েছে। সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকায় বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী এই সম্পর্কে একটি  উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখেছেন (‘কী ভাবব, না শিখিয়ে কী ভাবে ভাবব, শেখাতে চায় শিক্ষানীতিঃ নতুন পথ, নতুন চিন্তা’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫ শে অগাস্ট ২০২০)।

অধ্যাপক চক্রবর্তীর মতে এই শিক্ষানীতির মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারীকরণের রাস্তা খুলে দেওয়া হচ্ছে এই ভয় অমূলক। এই আশ্বাসের পিছনে একমাত্র অকাট্য প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেছেন শিক্ষাখাতে ৬% জিডিপি বরাদ্দের সুপারিশ। সুপারিশ সরকারি অঙ্গীকার নয়, এবং সুপারিশটিও নতুন নয়। ১৯৬৬ সালে কোঠারি কমিশনও একই সুপারিশ করেছিল, ১৯৬৮ সালে দেশের প্রথম শিক্ষানীতিতে এর উল্লেখ ছিল, ১৯৮৬ সালের শিক্ষানীতিতে সেই সুপারিশের পুনরাবৃত্তি হয়। অথচ ২০১৭-১৮ সালের বাজেটে জিডিপির মাত্র ৪.৪৩% শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় হয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি ধরে নিলে প্রকৃত ব্যয় আরো কম। শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আর্থিক দায়ের গোটাটাই জিডিপি ভিত্তিক হওয়ার মানে প্রকৃত খরচের পরিমাণ জিডিপির উত্থানপতনের সঙ্গে জড়িয়ে সবসময় অনিশ্চিত থেকে যায়। ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে জিডিপি যেখানে প্রায় ২৪% কমে গেছে সেখানে জিডিপির ৬%-এর চর্বিতচর্বন অর্থহীন।

অধ্যাপক চক্রবর্তী বলেছেন শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারী আর্থিক সাহায্য এই দেশে নতুন নয়, অনেক বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এভাবেই গড়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে জানিয়েছেন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে মদনমোহন মালব্য এবং বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠাকালে রবীন্দ্রনাথ বেসরকারী আর্থিক সাহায্য নিয়েছিলেন। যুক্তিটি অদ্ভুত। কারণ যে উদাহরণগুলি তিনি দিয়েছেন তার প্রতিটিই ঔপনিবেশিক শিক্ষাপ্রণালীর বিপ্রতীপে শিক্ষার অন্য মডেল তৈরির জন্য নেওয়া ব্যক্তিগত এবং বেসরকারী উদ্যোগ। এর সঙ্গে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম এবং খাতায়কলমে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ভূমিকার কোনো তুলনা চলে না। একইসঙ্গে উনি বরাভয় দিয়েছেন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বভৌমত্ব কোনোভাবেই খর্ব হবে না, চার ধরনের নিয়ন্ত্রণ দিয়ে বেশ শক্তপোক্ত বন্দোবস্ত করা আছে।

নিয়ন্ত্রণ আর সার্বভৌমত্বের এই সমীকরণ অতিসরলীকৃত। নয়া শিক্ষানীতিতে একদিকে ‘হালকা অথচ আটোসাটো’ নিয়ন্ত্রণের কথা বলা আছে; অন্যদিকে এক এমন নিয়ন্ত্রকতন্ত্র তৈরির ব্যবস্থা করা আছে যার নিজের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি নেই। নীতিনির্ধারন, গুণমান নির্ণয়, গবেষণায় আর্থিক অনুদান এবং পঠনপাঠনের দিশানির্দেশ – উচ্চশিক্ষার এই চারটি প্রধান দিক একটিই নিয়ামক সংস্থার হাতে কেন্দ্রীভূত হবে। স্বভাবতই এই সংস্থা অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অধিকারী হবে এবং এর দায়বদ্ধতা সুনিশ্চিত করার কোনো ব্যবস্থা নথিতে দেওয়া নেই। শিক্ষানীতির ৬৬ পাতার দস্তাবেজের মধ্যে ৪০ পাতা জুড়েই বহুস্তরীয় আমলাতন্ত্রের সাহায্যে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা – একেবারে দিল্লি থেকে ব্লক স্তর পর্যন্ত সেই আমলাতন্ত্রের বিস্তার। নথিটি পড়ে মনে হয় না যে সংবিধানে শিক্ষা কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ তালিকার অন্তর্ভুক্ত বিষয় এবং নথিটি একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে।

শিক্ষানীতি কোনো নিরালম্ব, বায়বীয় পদার্থ নয়। তাকে বুঝতে হলে কেবল একটি ৬৬ পাতার নথি যথেষ্ট নয়, নথিটিকে সামগ্রিক নীতি-আবহের পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা দরকার। জুন মাসের ২৪ তারিখ, অতিমারির আবহে, কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি ঋণের চুক্তি অনুমোদন করে। এটি কোনো এককালীন ঋণ নয়, বরং একটি দীর্ঘকালীন কর্মসূচির অন্তর্গত তৃতীয় দফার ঋণ। এই দফার কর্মসূচীর নাম Strengthening Teaching-Learning and Results for States, সংক্ষেপে STARS। এর আগের দু’দফায় ১৯৯৩-২০০২ সাল পর্যন্ত District Primary Education Programme (DPEP) এর মাধ্যমে এবং ২০০২ সাল থেকে সর্ব শিক্ষা অভিযানের মাধ্যমেও একইভাবে ভারতের স্কুলশিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাংক প্রভাব বিস্তার করেছে। STARS সমগ্র শিক্ষা অভিযানের অংশ হলেও তার মোট বিনিয়োগের মাত্র ১.৪% এই ঋণের মাধ্যমে আসবে, বাকি পুরোটাই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির পকেট থেকে আসবে। অথচ এই সামান্য বিনিয়োগের বিনিময়ে বিশ্বব্যাংক একেবারে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত  শিক্ষা পদ্ধতি, বিষয়, পঠন-পাঠন, এককথায় স্কুলশিক্ষার সম্পূর্ণ প্রকরণকে প্রভাবিত করতে পারবে।

প্রশ্ন উঠতেই পারে বিশ্ব ব্যাংক একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা, আন্তর্জাতিক পুঁজির স্বার্থ দেখাই তার কাজ, স্কুলশিক্ষায় তার ভূমিকা কী? ১৯৮০’র দশক থেকেই বিশ্বব্যাংক তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা কমিয়ে কখনো ‘জনসেবার’ নামে কখনো প্রাইভেট-পাবলিক-পার্টনারশিপের আকারে বেসরকারী পুঁজিকে অগ্রাধিকার দেওয়ানোর চেষ্টা শুরু করে। ফলে একদিকে যেমন রাষ্ট্রের জবাবদিহি কমে যায় অন্যদিকে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণও ক্রমশ কমতে থাকে। ২৮ অগাস্ট ‘ফ্রন্টলাইন’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে মধু প্রসাদ জানাচ্ছেন বিশ্বব্যাংক প্রণীত DPEP দেশের ১৮টি রাজ্যে এবং মোট জেলার মধ্যে অর্ধেক জেলায় প্রযুক্ত হয়। এর মাধ্যমে স্কুলশিক্ষার প্রসার এবং গুণমান বিষয়ে সরকারী স্কুলগুলিকে ‘স্বল্প মূল্যের উপায়’ বাতলানো হয়। ফল হয় মারাত্মক। সরকারী প্রাথমিক স্কুলগুলির ব্যবস্থাপনা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা দুটোই কমতে থাকে। ব্যাপক বেসরকারীকরণ শুরু হয়। ২০০৯ সালে শিক্ষার অধিকার আইন পাশ হয়। এই আইনকে সার্বজনীন শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি মাইলস্টোন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু এই আইন বিশ্বব্যাংক মডেলকেই অনুসরণ করে। ১৯৬৪-৬৬ সালের শিক্ষা কমিশন জনশিক্ষার জন্য কমন স্কুল সিস্টেমের কথা বলেছিল; বলেছিল নির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিক স্কুল হবে যেখানে ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে এলাকার সমস্ত শিশু পড়বে, যদিও ১৯৬৮ সালের শিক্ষানীতিতে সেই স্কুলের উল্লেখ থাকে না কারণ শিক্ষা শ্রেণিব্যবস্থাকে ধরে রাখার অন্যতম প্রকরণ; তার শ্রেণিচরিত্র আমূল পরিবর্তনে স্বাধীন ভারতের কোনো কেন্দ্রীয় সরকারই উৎসাহী ছিল না। শিক্ষার অধিকার আইনও শিক্ষাব্যবস্থার মূলগত অসাম্যকে দূর করার বদলে বেসরকারী স্কুলে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারের শিশুদের ২৫% সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে একভাবে স্কুলশিক্ষার বেসরকারীকরণে স্বীকৃতির শিলমোহর লাগিয়ে দেয়।

শিক্ষার অধিকারের অতি সীমিত ব্যাখ্যা সত্ত্বেও এই আইন ২০০২ সালে সংযোজিত সংবিধানের ২১(এ) ধারাকে স্বীকৃতি দেয় যাতে আবশ্যিক এবং বিনামূল্যের শিক্ষা ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী সমস্ত শিশুর মৌলিক অধিকারের মর্যাদা পায়। শিক্ষানীতির কস্তুরিরঙ্গন কমিটি-কৃত ড্রাফটেও এই কথার স্পষ্ট উল্লেখ ছিল। অথচ জাতীয় শিক্ষানীতিতে কোথাও বলা নেই যে বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার অধিকার আইন মেনে চলা বাধ্যতামূলক হবে। এ সম্পর্কে স্পষ্ট অবস্থান না নেওয়ার মানেই এই আইনের শর্তগুলিকে লঙ্ঘন করার সুযোগ করে দেওয়া, যদিও বিনা শিক্ষানীতিতেই বেশিরভাগ বেসরকারী স্কুল এই আইনকে স্বচ্ছন্দে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে থাকে।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ২০০৫ সালে ভারত সরকার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) সঙ্গে GATS চুক্তি স্বাক্ষর করে উচ্চশিক্ষাকে ‘বাণিজ্যিক পরিষেবা’র স্বীকৃতি দেয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারকে প্রবেশাধিকার দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। এই চুক্তি যখন হয় তখন কেন্দ্রে অন্য সরকার ছিল, সেই সরকারের সহযোগী হিসেবে সংসদীয় বামপন্থী দলগুলির অনেকেই ছিলেন। দশটি রাজ্য সরকারের শিক্ষামন্ত্রীরা আপত্তি জানিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও চুক্তি সাক্ষর হয়। ২০১৫ সালে মোদি জমানায় সে চুক্তি পাকাপোক্ত হয়। অথচ সারা পৃথিবীর প্রায় ৩ কোটি শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের প্রতিনিধিত্বকারী এডুকেশন ইউনিয়ন শিক্ষাকে ‘বাণিজ্যিক পরিষেবা’ হিসেবে দেখার বিরোধিতা করে ২০০৯ সালে বলে, “শিক্ষা এবং অন্যান্য নাগরিক পরিষেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে দেখা যাবে না...। GATS একটি বাণিজ্যচুক্তি যার একমাত্র লক্ষ্য বিনিয়োগকারীদের ব্যবসার সুযোগবৃদ্ধি ...” মুনাফাখোরি ছাড়াও শিক্ষাকে ‘বাণিজ্যিক পরিষেবা’ হিসাবে দেখার অন্যতম উদ্দেশ্য হোলো পরিবর্তনশীল এবং উত্তরোত্তর চুক্তিভিত্তিক শ্রমনির্ভর বাজারের উপযোগী কর্মীর অফুরান জোগান। নতুন শিক্ষানীতি বলছে দেশকে ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের’ জন্য প্রস্তুত হতে হবে আর তার জন্য উচ্চশিক্ষার ‘মাল্টিডিসিপ্লিনারি’ হওয়া প্রয়োজন। চুক্তিশ্রমের বাজারও এমন কর্মীই চায় যে নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নয়; নানান ‘স্কিলসেটের’ অর্থাৎ দক্ষতার সমষ্টি যাতে নিরন্তর কর্মী ছাঁটাইয়ের আবহে একজনকে দিয়ে একাধিকের কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। একের মূল্যে একাধিক কর্মী রাখা যায়।

নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির নথিটি প্রায়শই স্ববিরোধে পূর্ণ; সন্দেহ হয় এই স্ববিরোধ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যাতে ভাব ও ভাষার দ্বন্দ্বের মধ্যে রাজনৈতিক ছায়াচিত্রটি ধোঁয়াটে থেকে যায়। যেমন এই নীতির ঘোষিত উদ্দেশ্য শিক্ষার বাণিজ্যিকরণ বন্ধ করা। অথচ একই নিশ্বাসে বলা হচ্ছে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে আইনি নিয়ন্ত্রণ কমানো দরকার যাতে বেসরকারী এবং বিদেশি বিনিয়োগ আসে। বিশ্ব ব্যাংকের ফর্মুলা মেনেই যেসব বেসরকারী প্রতিষ্ঠান “মানবকল্যাণ ও জনসেবার উদ্দেশ্য” নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে চায় তাদের উৎসাহ দেওয়া হবে। এহেন ‘মানবকল্যাণকামী’ বেসরকারী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজেদের ইচ্ছেমতো কোর্সের ফি ধার্য করতে পারবে যদি তারা কিছু ফ্রি-শিপ বা স্কলারশিপের ব্যবস্থা রাখে। জনশিক্ষার মূলে যে সমতার ধারণা, সকলের জন্য সমমানের শিক্ষার সমান সুযোগ, তার ফলিত প্রয়োগে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। এখন নীতির জগত থেকেও তাকে নির্বাসন দিয়ে বিদ্যায়তনে শ্রেণিবৈষম্যকে স্থায়িত্ব দেওয়া হোলো। উপরন্তু যে সরকার নিজেই শিক্ষাক্ষেত্রে সবরকম বৃত্তি প্রায় তুলে দেওয়ার মুখে তারা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের বৃত্তির নিশ্চয়তা দেবে এই গল্প মহামারীদীর্ণ ভারতে, যেখানে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ছাত্রবৃত্তি পর্যন্ত বন্ধ থেকেছে, সেখানকার কোনো ছাত্র বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। নয়া শিক্ষানীতিতে অনলাইন শিক্ষার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। এই অতিমারিতে অনলাইন ক্লাস নেওয়া থেকে অনলাইন পরীক্ষা নেওয়ার মতো একাধিক বিষয়ে সরকারী গা জোয়ারি হয়েছে, এর মাধ্যমে সমাজে এক নতুন অসাম্য জন্ম নিয়েছে, আবার সেই অসাম্য সমাজে স্বীকৃতিও পেয়েছে। ইউজিসি’র কমিটি বলেছে অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে লক ডাউনের মধ্যেও ৬০%-৭০% সিলেবাস শেষ করা সম্ভব; কাদের পক্ষে সম্ভব সে বিষয়ে অবশ্য কোনো বক্তব্য রাখেনি। নয়া শিক্ষানীতিও বলছে অনলাইন আর ক্লাসরুম শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে হবে। তার জন্য অনলাইন শিক্ষার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম, কোর্স তৈরি ইত্যাদির উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

এরই মধ্যে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক সামাজিক মাধ্যমে ‘ভারত পড়ে অনলাইন’ নামক হ্যাশট্যাগ চালিয়ে এ বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের মতামত জানতে চেয়েছে; যদিও সেই মতামত মোদির ভারতের আরো অনেক মতামতের মতই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে গেছে। ২০০০ সালের বিড়লা-আম্বানি রিপোর্টেও ওপেন লার্নিংয়ের জয়গান ছিল। ২০১৪ সালে মোদি সরকার আসার পরে স্বয়মের মত প্ল্যাটফর্ম হয় যাতে স্বল্প মূল্যে রেজিস্টার করে বিভিন্ন কোর্স করা যায়। সঙ্গে সঙ্গে বাজারে আসে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থান যাদের মাধ্যমে নানান বিখ্যাত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন কোর্স করে শংসাপত্র পাওয়া যায়, অবশ্যই মোটা মূল্যের বিনিময়ে।

২০১০-১১ সাল থেকে বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন রিপোর্টে ম্যাসিভ অনলাইন ওপেন কোর্স বা ‘MOOC’ প্রসঙ্গ উঠে আসে, বলা হয় উন্নতিশীল বিশ্বে উচ্চশিক্ষার প্রসারে MOOC নাকি বৈপ্লবিক ভূমিকা নিতে পারে। ভারতের মতো দেশ এই জাতীয় প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত – GATS চুক্তির সময়েই বোঝা গিয়েছিল আমেরিকা এবং চীনের পরে ভারতের উচ্চশিক্ষাক্ষেত্র বিশ্বে তৃতীয় সর্ববৃহৎ। এখানে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ অল্পবয়স্ক, যারা উচ্চশিক্ষা পেতে চায়। কিন্তু সামগ্রিক ভর্তির অনুপাত, অর্থাৎ Gross Enrolment Ratio (GER) খুবই কম। ২০০৭ সালে সুখদেও থোরাট কমিটি এই বিপুল বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারকে আরো বেশি সংখ্যক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা বলেন। নয়া শিক্ষানীতি GER’কে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে, বলা হয়েছে আগামী পনেরো বছরে GER দ্বিগুণ করা হবে, কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানোর বদলে বর্তমানের ৫২,০০০ উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কমিয়ে ১৫,০০০ করা হবে। তাহলে GER-এর মোক্ষ সাধিত হবে কী করে? এখানেই MOOC-এর মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ‘বৈপ্লবিক ভূমিকা’। একদিকে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার একটা অংশ অনলাইন করে দিলে অধ্যাপকের বিপুল ঘাটতি পূরণের বদলে শূন্যপদগুলি লোপ করা যাবে, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার ক্রমসংকোচন ও বেসরকারীকরণের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে দেশের একটা বড় অংশের মানুষের সাধ্যের বাইরে নিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে এরফলে তৈরি হওয়া শূন্যতার সুযোগে অনলাইন কোর্স এবং ডিগ্রির বাজার গড়ে তোলা। স্বভাবতই এতে GER বাড়বে, এবং সেই বর্ধিত GER-কেই শিক্ষানীতির চূড়ান্ত সাফল্য হিসেবে দেখানো যাবে, যদিও এরসঙ্গে শিক্ষার মানের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকারও জানে যে হার্ভার্ড আর অনলাইন হার্ভার্ডের ডিগ্রির বাজারমূল্য এক নয়। স্বল্পমূল্যের ডিগ্রি বাজারে স্বল্পমূল্যের কর্মীর জোগান দেবে, সঙ্গে বেসরকারী মুনাফার এক বিপুল সম্ভাবনা।

এই শিক্ষানীতি শিক্ষার বাণিজ্যিকরণের এক দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়ার সারাৎসার। স্বশাসনের ফাঁপা বুলির পিছনে শিক্ষার প্রশাসনিক কেন্দ্রিকরণ এবং আর্থিক বিকেন্দ্রিকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের খবরদারি আর বাজারের চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য সাধনের চেষ্টা।

- শিঞ্জিনী বসু  

খণ্ড-27
সংখ্যা-32