প্রতিবেদন
বিচহি লগাইলে ফুলবাড়ি : বাঙ্গীটোলা, আগস্ট ২০২০
mld

দুই দশক আগে নদীভাঙনের তীব্রতা যখন মালদা সহ সারা পশ্চিমবঙ্গকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো, তখন এই চারজনের কারোর জগৎ দেখার চোখ ফোটেনি-একজন তো একেবারে মায়ের কোলের শিশু! পরে কাজ ও গবেষণার সূত্রে ১৯৯৮-২০০৩এ মালদা জেলার বন্যা ও ভাঙন নিয়ে তারা নিজেদের বৃত্তেই নানা সময়ে উত্তেজিত কথোপকথন চালিয়েছে... ‘ওরা’ বলতে চারজন ঋষি, স্বরজিৎ, সিদ্ধার্থ আর জাহ্নবী।

হিন্দি সিনেমার ‘বিস সাল বাদ’-এর ফর্মুলা মেনে ২০২০র অগাস্টের শেষদিকে তারা যখন একটা অসম বয়সী বন্ধুত্বের মধ্যে থেকে চিন্তার আদানপ্রদান চালায়, তখন হয়তো সাহিত্যপাঠের সাধারণ প্রবণতা থেকেই তারা ভাবতে চেয়েছে ভাঙনের তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী ফলাফলগুলি। অবশ্য ভাঙনের কারণ তারা কিছুটা পড়ে এসেছে ক্লাস টেনের ভূগোল বইতে। চারজনের তিনজন মালদাইয়া, তাদের মধ্যে দুজন আবার ভাঙন অধ্যুষিত এলাকার সরাসরি বাসিন্দা, একজন চাকরিসূত্রে এক দশকের বেশি মালদাবাসী। স্বাভাবিকভাবেই নানা কৌণিক দৃষ্টিকোণ উঠে আসে তাদের নানাসময়ের আড্ডা-আলোচনায়।

শহরের সীমা ছাড়িয়ে অমৃতি বাজার পেরোনোর পর গাড়ি যে সময়ে একটু গতি পেল, তার মধ্যে স্বরজিৎ আর সিদ্ধার্থ ঋষিকে বুঝিয়ে ফেলেছে, নদীভাঙন এই অঞ্চলের জনজাতির যাপনের অঙ্গ বহুকাল থেকে। মালদা জেলার কালিয়াচক ব্লক-২ অঞ্চলের বাঙ্গীটোলা সংলগ্ন এলাকার গোলকটোলা, পাঁচকড়িটোলা বা জোতকস্তুরীর মানুষ এই নিম্নগতির নদীর সঙ্গে লড়াই করেই বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত। কথায় কথায় স্বরজিৎ মনে করিয়ে দেয় তার মায়ের মুখে শোনা গল্প, ১৯৯৮ সালের বন্যায় কেবি ঝাউবোনা অঞ্চলের রাতারাতি গঙ্গাগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার কথা। সেই সময়ের বিপর্যয়ে সবকিছু হারানো মানুষেরা বসবাস করছিলেন গঙ্গার ধার বরাবর বাঙ্গীটোলার পিছনের অংশে। বেশ কয়েক বছরের আপাত নিশ্চিন্তির পর এবছর সকলেই এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে। লকডাউনের নতুন বিপদ মিলেমিশে যাচ্ছে ভাঙনের পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে ... বাকিটা কেউ জানে না। জেলার সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, একেবারে স্বাধীনতা দিবসের দিন বাঙ্গীটোলার পাশাপাশি ভাঙন শুরু হয়েছে কালিয়াচক-৩ ব্লকের চক বাহাদুরপুর, সূর্যপাড়া ও সরকারপাড়ার মতো এলাকায়। এলাকার মানুষজন বলছেন, এ ভাঙন দ্বিতীয় দফার, এর আগেও একদফা হয়ে গেছে। সেচ দপ্তরের কর্তারা বলছেন, এই ভাঙন একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে। তাঁরা বলছেন, মানিকচক থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত নানা পয়েন্টে অল্পস্বল্প ভাঙনের সম্ভাবনা আছে, প্রশাসন নজর রেখেছে। এলাকাবাসীরা বলছেন, ১৮ বিঘা জমিসহ ২০০ মিটার রাস্তা চলে গেছে গঙ্গাগর্ভে। পার চকবাহাদুরপুর থেকে হোসেনপুর যাওয়ার রাস্তা বিচ্ছিন্ন। কৃষ্ণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পাশেই পাশের জেলা মুর্শিদাবাদের কুলিদিয়ারা অঞ্চল। এই কুলিদিয়ারা অঞ্চলের অবস্থাও কালিয়াচক-৩ এর মতোই। উল্লেখ্য, এই ক্ষতিগ্রস্ত ১৮ বিঘা মূলত পটল, ভুট্টা ও আখচাষের জমি।

এইসব কথাবার্তার মাঝেই মাঝপথ থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে গাড়িতে ওঠে জাহ্নবী, সে ফোটোগ্রাফি করে, একেবারে বাঙ্গীটোলারই ভূমিকন্যা। সেও পরিবারের বড়োদের মুখে শুনেছে গঙ্গাভাঙনে ৩০-৩৫টি গ্রাম রাতারাতি হারিয়ে যাওয়ার কথা ... কেবি ঝাউবোনা এখন শুধু স্মৃতি আর আতঙ্কের আরেক নাম। ঋষির হঠাৎ মনে পড়ে, জীবনানন্দ লিখেছিলেন “গ্রামপতনের শব্দ হয়”, সেটা কি এরকমটা ভেবেই লেখা? কে জানে! জাহ্নবী ও স্বরজিৎ স্থানীয় হওয়ার সুবাদে আঞ্চলিক লোকবিশ্বাসের সঙ্গেও বিশেষভাবে পরিচিত। তারা একসঙ্গেই বলে, বিগত বেশ কয়েকবছর যাবৎ বাঙ্গীটোলায় বসবাসকারী মৈথিল ব্রাহ্মণসহ জোতকস্তুরী থেকে পঞ্চানন্দপুর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার চাঁই, মণ্ডল, বিন ও নাপিতরা বিশ্বাস করে, বাঙ্গীটোলার গ্রামদেবী মা মুক্তকেশী এই ভাঙন আটকে দিয়েছেন ... কিন্তু এই বিশ্বাসও তাদেরকে আপাতত স্বস্তি দিতে পারছে না। স্বরজিৎ বিশ্লেষণ করে বলে, বাঙ্গীটোলার কাছে গঙ্গার স্থির হয়ে দাঁড়ানোর ভৌগোলিক কারণ নদীর উজানে সৃষ্টি হওয়া একটি বড়ো চর। কিন্তু এই বছর গঙ্গার স্রোত চরটি অনেকটা কেটে ফেলায় মূল স্রোত পূর্ব থেকে নিচের দিকে এসে সরাসরি এলাকায় ধাক্কা মারছে।

পুরো এলাকা জুড়ে রেইকি করার ফাঁকে সিদ্ধার্থ জানায়, স্থানীয় লোকজন  বোল্ডার ও ক্রেট ফেলে স্থায়িভাবে ভাঙন রোধের পক্ষে, কিন্তু সেচ দপ্তরের কর্তারা তাঁদেরকে স্পষ্ট বলছেন, বর্ষাকাল এই জাতীয় কাজের অনুপযুক্ত। তাই বাঁশ ও ধাতব তার ব্যবহার করে ডিপট্রিজ  করে অস্থায়ীভাবে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছেন। আগে কি কিছুই করা যেত না? কেন জোড়াতালি দেওয়া ব্যবস্থাকেই বছরের পর বছর লাগু রাখা হয়েছে? অভিমান জমে জমে পাথর হয়, এমএলএ ম্যাডামের সহানুভূতি সেই পাথরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে ... বাঙ্গীটোলা থেকে যায় বাঙ্গীটোলাতেই। কোন প্রতিশ্রুতিই স্থায়িভাবে বাস্তবয়িত হয় না, হয়নি কোনদিনও।

এরই মধ্যে ফুটেজ তোলার মাঝে স্বরজিৎ-এর মোবাইলের কলার টিউন বেজে ওঠে, ভূপেন হাজারিকার কালজয়ী “গঙ্গা আমার মা” ... এরমধ্যেই সিদ্ধার্থ পাড় থেকে অনেকটা ঝুঁকে পড়ে ডিপট্রিজের বাঁশের গভীরতা পরখ করতে গিয়ে মাঝির সতর্কতামূলক গালাগালি শুনেছে ... ছবি তোলবার উত্তেজনায় জাহ্নবী হাতে লাগিয়ে ফেলেছে নৌকার আলকাতরা ... আর সবাইকে সচকিত করে ঋষি খেয়েছে এক পেল্লায় আছাড়! তবে সেই আছাড়ের ফলেই আবিষ্কার করা গেল, ডিপট্রিজের ধাতব তার ভাঙন কবলিত পাড়কে নিজের সাধ্যমতো ক্ষমতাবলে বেঁধে রাখতে চাইছে। কিন্তু গঙ্গায় জলস্তর বেড়ে স্রোতের ধাক্কা (স্থানীয় ভাষায় ‘পহল লাগা’) হঠাৎ বাড়লে? গঙ্গার জোরালো হাওয়ায় তার থিরথির করে কাঁপতে কাঁপতে মাথা নাড়ে-জানি না, জানি না! আর্কিমিডিসের আবিষ্কারের মতো ঋষির মনে পড়ে যায় নাইজেরিয়ান কবি বেন ওকরির নয়ের দশকের সাড়াজাগানো উপন্যাস “দ্য ফেমিশড রোড”-এর শুরুর লাইনগুলো, অনেকদিন আগে পড়া, তাও ... সব পথই একদিন নদী ছিলো, তারপর নদীরাই পথ হলো আর সারা পৃথিবীতে ডালপালা ছড়ালো-তাই পথের ক্ষুধা কোনোদিন ফুরোয় না, নদীর ক্ষুধাও।

বাঙ্গীটোলার প্রায় সাত কিলোমিটার দূরের পঞ্চানন্দপুরের মানুষেরা মনে করেন, তাঁরা আপাতত নিরাপদ। জোতকস্তুরীর গঙ্গাতীরে দাঁড়িয়ে জলের তীব্র স্রোত আর ঘূর্ণি দেখতে দেখতে ঋষি সিদ্ধার্থকে বলে, বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় পড়েছিলাম, “আকারহীন হিংস্র, খল/অনিশ্চিত ফেনিল জল/মিলিয়ে গেল অদৃষ্টের মৌন ইশারাতে/তোমায় আমি রেখে গেলাম ভবিষ্যের হাতে”, এখানে না এলে এ কবিতার ব্যঞ্জনআর আর একটা স্তর অনাবিষ্কৃত থেকে যেত। স্বরজিৎ মনে করিয়ে দেয়, কথাসাহিত্যিক অভিজিৎ সেনের নানা লেখায় এই বিষয় আর এই অঞ্চলের মানুষ নানাভাবে উঠে এসেছে ... তাকে হৈচৈ করে সমর্থন করে সকলে! কেননা, এই চারজনের বন্ধুত্বের একটা সাধারণ সূত্র অভিজিৎ সেনের লেখা। জাহ্নবী মনে করিয়ে দেয়, এই লেখকের বেশ কিছু ছোটগল্প ও “নিম্নগতির নদী” উপন্যাসের পটভূমি এই ১৯৯৮-এর বন্যা ও নদীভাঙন।

হাওয়ায় এলোমেলো চুলের গোছা সামলে তাড়াতাড়ি একটা হাতখোঁপা বেঁধে ফেলে জাহ্নবী বলে, কাছাকাছি বিহার ঝাড়খণ্ডসহ এখানকার মৈথিল সম্প্রদায়ের বিয়ের গানেও এই ভাঙন একটা রূপক হিসাবে উঠে এসেছে। বাকিদের কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে সে বলে, আশীর্বাদের দিন (এখানে বলা হয় ‘পানপত্র’) গাওয়া হয়,

“এ পার গঙ্গা ও পার যমুনা
বিচহি লগাইলে ফুলবাড়ি
হো গঙ্গা মাঈঈ
বিচহি লগাইলে ফুলবাড়ি”

অর্থাৎ, ভাঙনপ্রবণ দুই নদীর মাঝে রচিত হয় ফুলে সাজানো বাসরঘর ... সব ভাঙন পেরিয়ে সৃষ্টির আনন্দে মিলিত হয় দুটি প্রাণ, দুটি পরিবার। এই মিলন সত্য, আর ভাঙন মিথ্যা নয়; কেননা, তার পটভূমিতেই সেই মহাসত্য রচিত হয়। সে বলে, মূল গানটা অনেক লম্বা-আমি শুধু ধুয়াটা শোনালাম।

তাকে নামিয়ে গাড়ি এখন অমৃতির বাজারে থেমেছে। সিদ্ধার্থরা একটু ‘আড়ালে’ গেছে আর চায়ের গ্লাস হাতে ঋষি ভাবতে থাকে সকালের সেই ফোনটার কথা। ফোনের ওপারের অচেনা ছেলেটি তার পরিচিত এক সমাজকর্মীর রেফারেন্স টেনে বলেছিলো, দাদা বলেছেন একটা ভাঙন বিরোধী সচেতনতা মঞ্চ তৈরি হওয়া দরকার ... শুধু অঞ্চলগুলোতে নয়, টাউনেও ... মাসে অন্তত একটা করে মিটিং ... ডিএমের কাছে ডেপুটেশন ... ৭০০ ঘরহারা মানুষদের জন্য কুড়িটা ত্রিপল... সে শুধু মাথা নেড়ে যায়, তার মাথায় কিছু আসে না। চারিদিক থেকে উড়ে আসতে থাকে নানা টুকরো শব্দ ... বোল্ডারের কাটমানি, মাঝির গোপন খাতা, বানানো পরিসংখ্যান, অল ক্লিয়ারের বিপবিপ ... তার মাথায় কিছু ঢোকে না।

সম্বিত ফেরে রথবাড়ি মোড়ের ট্রাফিকের গর্জনে। আনলক পর্বের ব্যবসাকে বাড়াতে বাস, অটো, ম্যাক্সি (মিনিবাস), টোটো সবাই যেন হর্ন বাজিয়ে প্যাসেঞ্জার ধরার প্রতিযোগিতায় নেমেছে ... এই গর্জনের মাঝেই চোখ বুজে ফেলে ঋষি। চোখ বুজে সে দেখতে পায় তার বুক শেলফে রাখা বইগুলোকে, অভিজিৎ সেনের “নিম্নগতির নদী”, জয়ন্ত জোয়ারদারের “ভূতনি দিয়ারা”, “রূপান্তরের পথে”র ভাঙন বিষয়ক সংখ্যার বাঁধানো কপি, কল্যাণ রুদ্রর “বাংলার নদীকথা”... ডকুমেন্টেশনের কাজ কীভাবে আরো জোরালো ও অকাট্য করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করতে করতে ফুটপাত দিয়ে এগিয়ে চলেছে স্বরজিৎ-সিদ্ধার্থ … ঋষি পিছিয়ে পড়ে, ক্রমশ পিছোতেই থাকে ... তাকে ফিরে যেতে হবে তার বুক শেলফের কাছে, ঐ বইগুলির কাছে, পুনপাঠের প্রস্তুতি নিতে হবে তাকে, আবার …

- তপোমন ঘোষ  

খণ্ড-27
সংখ্যা-31