এআইকেএম ডেপুটেশন : কৃষকদের কৃষিঋণ দাও, মহাজন ও কোম্পানির ঋণের নির্ভরতা বন্ধ করো
dee

কৃষিক্ষেত্রে কোম্পানিরাজ নিয়ে আসার প্রতিরোধে গোটা দেশ উত্তাল। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আইন প্রণয়নের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রে সরকারী উদ্যোগে পূঁজি বিনিয়োগ তথা কৃষকদের কৃষি-ঋণ দেওয়ার দাবি তুলে ধরে কিষাণ মহাসভা এ রাজ্যে আন্দোলনে নামলো। বাস্তবে রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে দেখা যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকরা আজও সেই মহাজনী ঋণের মুখাপেক্ষী হয়ে রয়েছে, কারন তারা ব্যাংক বা সমবায়ের কৃষিঋণ পায় না। এর ফলেই বন্ধন বা উজ্জীবনের মতো মাইক্রোফিনান্স কোম্পানির উপর নির্ভরতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। চড়া সুদে সেই কোম্পানির ঋণ নিয়ে গ্রামের গরিবরা হয়ে আছে ঋণফাঁদে জর্জরিত। অথচ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ঢাকঢোল বাজিয়ে কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের প্রচার করে চলেছে। তথ্য হলো এই কিষাণ কার্ডে মরসুমী চাষের জন্য কৃষি-ঋণ সময়সীমার মধ্যে পরিশোধ করলে তার সুদ ৪ শতাংশ। সময় পেরিয়ে গেলে ৭ শতাংশ। অথচ বন্ধনের সুদ তার চারগুনেরও বেশি, ১৮ শতাংশ! এই প্রেক্ষাপটে গ্রামের সমস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিদের কিষাণ কার্ডের দাবি তুলে ধরে সারা ভারত কিষাণ মহাসভা গত ৫ অক্টোবর রাজ্যের বিভিন্ন ব্লকে সহ কৃষি অধিকর্তার দপ্তরে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত করে। আরও যে দাবিগুলি তুলে ধরা হয় তা হলো, যারা ভাগে বা চুক্তিতে চাষ করে তাঁদের জন্যও কিষাণ কার্ড, শস্য বীমা, কৃষকদের সার বীজ সরবরাহ করা, আমফান ও লকডাউন ক্ষতিপূরণ প্রভৃতি। আধিকারিকরা জানায় যে কিষাণকার্ডের জন্য দপ্তরে কৃষকরা যে কাগজপত্র জমা দিয়েছে সেগুলি তারা ব্যাংকে পাঠিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ এভাবে তাদের দায় খালাস করে দিয়েছে। বাস্তবে ব্যাঙ্কে জমা পড়া কাগজের মধ্যে মুষ্টিমেয়রা কৃষিঋণ পায়, আর বিরাট সংখ্যক চারিরা বঞ্চিতই থেকে যায়। এ জন্য সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে, ডেপুটেশনে এই দাবি তুলে ধরা হয়।

উত্তর ২৪ পরগণার গাইঘাটা ব্লকের সহ কৃষি অধিকর্তার কাছে বেলা ২ টায় ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ভাগচাষি, লিজ চাষিদের কিষান ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হবে বলে তিনি জানান। এই জন্য জমির দাগ খতিয়ান আধার কার্ড ভোটার কার্ড ব্যাংকের একাউন্ট বই দেখালে ফর্ম দেওয়া হবে। সেই ফরম ফিলাপ করে জমা দিতে হবে। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি নীতি ও ফসলের লাভজনক দামের বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। ডেপুটেশনে নেতৃত্ব দেন এআইকেএম নেতা কৃষ্ণ প্রামানিক।

দার্জিলিং জেলার ফাঁসীদেওয়া এডিও অফিসে সারা ভারত কিসান মহাসভা (এআইকেএম)’র পক্ষ থেকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। ফাঁসিদেওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মিছিল শুরু হয়ে এডিও দপ্তরে শেষ হয়। মিছিল ও সমাবেশে নেতৃত্ব দেন কিসান মহাসভার দার্জিলিং জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ, শরৎ সিংহ, কান্দ্রা মুর্মু, মোজাম্মেল হক, নেমু সিংহ, পৈসাঞ্জু সিংহ, মোজাম্মেল হক, দীপক ঘোষ, মামনি বর্মন, তাপস বর্মন, সুমন্তি এক্কা, রমু সিংহ প্রমুখ। কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের প্রশ্নে এখানেও সেই একই কথা শোনা যায়। কৃষি পেনশনের প্রশ্নে তিনি বলেন ফাঁসিদেওয়া ব্লকে মাত্র ১১০ জন পেনশন পায় অথচ দরখাস্ত করেছিলো হাজারেরও বেশি কৃষক।

জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়িতে এডিও দপ্তরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয় ও আধিকারিককে স্মারকলিপি পেশ করা হয়। এই কর্মসূচীতে নেতৃত্ব  দেন জেলা নেতা ভাস্কর দত্ত, শ্যামল ভৌমিক, মুকুল চক্রবর্তী, দেবনাথ রায়, শৈলেন রায়, বৈশাখী রায়, প্রদীপ দেবগুপ্ত প্রমুখ। সরকারী উদ্যোগে  সার বীজ কীটনাশক প্রভৃতি উপকরণ স্বল্প মাত্রায় সরবরাহ করার ক্ষেত্রে চরম দলবাজি চলে। কিষাণ সভা স্বচ্ছভাবে বিলি করার দাবি জানায়। আধিকারিক জানায় এবার থেকে কিষাণ মহাসভাকে অবহিত করেই ঐ জিনিসগুলি সরবরাহ করা হবে।

নদীয়া জেলার নাকাশীপাড়া ব্লকে কৃষি দপ্তরে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। সহ কৃষি অধিকর্তা ও অন্যান্য আধিকারিকরা ডেপুটেশন গ্রহণ করেন। এই প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত  কৃষকদের জন্য আমফান ক্ষতিপূরণের কথা শোনা গেলো। এ রাজ্যে “কৃষকবন্ধু” প্রকল্পে একর পিছু বছরে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা (জমির পরিমান কম থাকলে আনুপাতিক কম টাকা, সর্বনিম্ন ২০০০ টাকা) কৃষকদের দেওয়া হয়ে থাকে। ডেপুটেশনে জানা গেলো কৃষকবন্ধু উপভোক্তাদের আমফানের ক্ষতিপূরণের নামে দেওয়া হচ্ছে তার অর্ধেক মাত্র ২৫০০ টাকা! অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত ৭০-৮০ ভাগ ছোট চাষির ভাগ্যে জুটবে সামান্য ১০০০ টাকা! কিষাণ মহাসভা যুক্তিসঙ্গতভাবেই লকডাউন ও আমফানের ক্ষতিপূরণ বাবদ দাবি করেছিলো একর পিছু ২৫ হাজার টাকা। অথচ সরকার দিচ্ছে দশ ভাগের এক ভাগ, কিংবা তারও কম! কৃষকের প্রতি বঞ্চনা আর প্রতারণা কী মাত্রায় চলছে এটা তার একটা ছোট উদাহরণ। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেটদের মকুব করে দিচ্ছে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা। আর রাজ্য সরকার অনুৎপাদক “সামাজিক” দান খয়রাতিতে উদারহস্ত। আরেকটা করুণ তথ্য জানা গেলো যে, কৃষি পেনশনের টাকা সমগ্র ব্লকে পায় মাত্র ৩২১ জন চাষি। অথচ জমি আছে এমন পরিবারের সংখ্যা ব্লকে ৪০ হাজারেরও বেশি!

এই সংখ্যা কিন্তু বাড়বে না। একজন মৃত কৃষকের স্থানে ঢুকবে অপেক্ষায় থাকা অপর একজন! অথচ তথাকথিত “কৃষক দরদী” কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের প্রচারের ঢাকঢোল বেজেই চলেছে। ডেপুটেশনে ছিলেন আয়ারলার কাজল দত্তগুপ্ত, কিষাণ মহাসভার আসারুদ্দিন সেখ, আফজেল সেখ, জয়তু দেশমুখ। নদীয়া জেলার চাপড়া ও কালীগঞ্জে ডেপুটেশনে ছিলেন এআইকেএম নেতা ধনঞ্জয় গাঙ্গুলী, ইনসান সেখ, আলতাফ হোসেন প্রমুখ।

খণ্ড-27
সংখ্যা-36