প্রতিবেদন
চারপাশের চলমানতা ও ইসলামোফোবিয়া সম্পর্কে দু চারটে কথা
char

করোনা সংক্রমণ যখন এদেশে ছড়াতে শুরু করেছে সেই পর্বে তবলিগি জামাতের একটি সমাবেশকে রাষ্ট্র অপরাধী বানানো শুরু করেছিল। সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যম একে কেন্দ্র করে প্রতিদিন ইসলামোফোবিয়া ছড়াত।

আমরা সেদিন তবলিগি জামাতের জমায়েত বিবেচনাপ্রসূত হয়নি বলেছিলাম। আর বিরোধিতা করেছিলাম একটি জমায়েতের সূত্র ধরে একটি গোটা কমিউনিটিকে ভিলেন বানানোর পরিকল্পিত চেষ্টার।

তার পর মাস সাতেক পেরিয়ে এখন এসেছে দুর্গাপূজা। এর আগে হয়েছিল ইদ। দুটোই এমন সময়ে যখন অতিমারির প্রকোপ তুঙ্গে।

ইদ ঘরে বসে পালন করার কথা বলা হল। তা সেভাবে পালিতও হল বিবেচনাবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে৷ দুর্গোপুজোর সময় ব্যাপারটা একেবারে উলটে গেল।

সর্বজনীন পুজোর আয়োজকদের ভিক্টিম বানানো দূরে থাক, কমিউনিটিকে ভিলেন বানানোর কথাটা এক্ষেত্রে কেমন হাস্যকর রকম অলীক সেই আলোচনাও শিকেয় তোলা থাক, শুধু দেখা যাক প্রশাসনের ভূমিকা। যে মুখ্যমন্ত্রী বাড়ি বসে ইদ পালন করার কথা বলেন, তিনিই ঘরে বসে আবার দুর্গোৎসব হয় নাকি, একথা বলে রাস্তায় জনজোয়ারের প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। পুজো কমিটি পিছু পঞ্চাশ হাজার অনুদান ঘোষণা করে সর্বজনীন পুজোর ভিড়ের প্রেক্ষাপট রচনা করে দেন। চিকিৎসক সমাজের আকুল আবেদন কানেই তোলার প্রয়োজন মনে করেন না।

মার্চে তবলিগি জামাতের সেই জমায়েত থেকে মাঝে ইদ হয়ে এই শেষ অক্টোবরে দুর্গাপুজো – আমাদের সেকুলারিজম, ইসলামোফোবিয়া, তথাকথিত সংখ্যালঘু তোষণের মুখোশ ও প্রকৃত মুখ – সবকিছুকেই দেখিয়ে দেয়।

প্যারিসে যে হত্যাকাণ্ডটি ঘটল, সেটি নিঃসন্দেহে একটি বর্বরোচিত কাজ। “ধর্মানুভূতি বলে কিছু থাকারই কথা নয়, তা কেন থাকবে, এই জাতীয় ইউটোপিক কল্পনার বাইরে বাস্তব বুঝে, অন্যের অনুভূতিকে মর্যাদা দেওয়াটাই উচিত” – একথা মনে রাখার কথা যারা বলছেন, তাদেরও অধিকাংশই মানছেন দেড় হাজার বছরের ও দেড়শ কোটি অনুসারী মানুষের ধর্মটিকে রক্ষার জন্য গলা কেটে খুন করার ব্যাপারটি অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর এবং নৃশংস।

কিন্তু সদ্য তরুণ চেচেন যুবকটির উন্মাদ বীভৎসতার জন্য মুসলিম সমাজকেই সন্ত্রাসবাদী বানানোর উচ্চারণগুলি মারাত্মক। ব্যক্তি বা সংগঠনের দায়কে গোটা সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এবং তার পেছনে প্রবলভাবে রাষ্ট্র ও কর্পোরেটের মদত থাকার বিষয়গুলি আমরা গত কয়েক দশকে বারবার দেখছি।

এই প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাতন্ত্র একটি ভিলেনকে দেখিয়ে সংখ্যাগুরুকে সংগঠিত করতে চায় আমাদের দেশে। ইউরোপ, আমেরিকার ন্যাটো অক্ষ চায় ওয়ার অন টেররিজম এর নামে তার দেশদখল, লুন্ঠন ও কর্পোরেট স্বার্থকে চরিতার্থ করার দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। অন্যদিকে পরম মিত্র সৌদি আরব সহ নানা ইসলামিক রাষ্ট্রেও প্রগতিশীল সংস্কার ও প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাতন্ত্র বিরোধী বিদ্রোহকে রুখতে সে পলিটিক্যাল ইসলামকে নানাভাবে সার জল দেয়। এশিয় ভূখণ্ডে সোভিয়েতকে রোখার জায়গা থেকে যে নক্সা শুরু হয়েছিল, তা পরে ক্রমেই তার ডালপালা মেলেছে নানাদিকে।

বিশ্ব রাজনীতির গত কয়েক দশকের ঘটনাপ্রবাহকে বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি কর্পোরেট স্বার্থ, তাঁবেদার শাকরেদকুল সহ সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতাতন্ত্র ও পলিটিক্যাল ইসলাম এক দুষ্টচক্র গড়ে তুলেছে।

সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সামনে আপাত যুযুধান কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সহযোগী শক্তিগুলোর মুখোশ উন্মোচন এই সময়ের প্রগতিশীল রাজনীতির অন্যতম কাজ। কেবল পুতুলগুলির বিরুদ্ধে যাবতীয় ঘৃণাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি কর্পোরেট ও সাম্রাজ্যবাদী অক্ষ যতদিন সফলভাবে করে যেতে পারবে, ততদিন পর্দার আড়ালে থাকা ক্ষমতাসীন সব বাজিগরদের স্বস্তিতে থাকা আটকাবে কে?

- সৌভিক ঘোষাল     

খণ্ড-27
সংখ্যা-38