সম্পাদকীয়
বাংলায় বাড়াতে হবে বাম চ্যালেঞ্জ
ssa

নব মনোনীত প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির নেতৃত্বে কলকাতায় কংগ্রেস মিছিল করল, বার্তা ছুড়ে দিল বামেদের নিয়ে জোট সরকার গঠন করার। ইনিই সেই প্রদেশ সভাপতি, যাঁকে কংগ্রেস হাইকমান্ড ইতিপূর্বে একবার সরিয়ে দিয়েছিল। তাঁর জায়গায় প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিল সদ্য প্রয়াত সভাপতিকে। ফের পুনর্বাসিত করা হল পূর্বতন অপসারিত নেতাকেই। এই সভাপতি আবার বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হওয়ার দৌলতে লোকসভায়ও কংগ্রেসের দলনেতা। বিষয়গুলো এজন্যই পুনরাত্থপন করা যে, কেন্দ্রে এবং রাজ্যে রাজ্যে ব্যক্তিনেতার মহিমার ওপর নির্ভরতা সর্বস্ব কংগ্রেস কালচার আজও একইভাবে বিরাজমান, একইসাথে তা নেতৃত্বের আকাল ঘনিয়ে আসার পরিণামও দেখিয়ে দেয়। পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেস সংগঠন অন্যান্য আরও বহু রাজ্যের মতোই অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত বিভাজিত একাধিক গোষ্ঠীতে। ২০১৬-র বাম-কংগ্রেস নির্বাচনী আঁতাতের ফায়দা তুলে রাজ্য বিধানসভায় কংগ্রেস যদিও দখল পেয়েছে প্রধান বিরোধীদলের, তবু বিগত চার-সাড়ে চার বছরে সামাজিক শক্তির নতুন কোনও বিশেষ পুনরুজ্জীবন ঘটাতে পারেনি। উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেওয়া বলতে গণতন্ত্রের প্রশ্নে কিছু কিছু সরব হয়, সমাবেশ করে। যেমন, এনআরসি-এনপিআর-সিএএ বিরোধী ইস্যুতে। কিন্তু তার বেশি নয়, মাঠে ময়দানে রাস্তার আন্দোলনে সাধারণত নয়। টিএমসি-বিজেপি-র বিপ্রতীপে ‘বিকল্প কংগ্রেস-বাম জোটে’র সরকার গড়ার হাঁকডাকের প্রকৃত উদ্দেশ্য হল, কংগ্রেসের বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে আসার মহড়া দেওয়া। কিন্তু টিএমসি-বিজেপিকে সমান প্রতিপক্ষ চিত্রিত ও বিরোধিতার অবস্থান কার্যত দেশের সামনে বিজেপির সবচেয়ে আগ্রাসী বিপদকে লঘু করে দিচ্ছে। কথায় কথায় রাজ্যপালের দ্বারস্থ হওয়াও একই পরিণাম ডেকে আনছে।

টিএমসি-র রাজত্বে ‘আইনের শাসনে’র নামে গণতন্ত্র দমন আর দলতন্ত্র চলার অভিযোগ সত্য। কিন্তু যে রাজ্যপাল কেবলমাত্র রাজ্যের যাবতীয় অনাচার নিয়ে দিনরাত অতি সক্রিয়, আর রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের অর্থ সাহায্য, আমফান ঝড়ে বিপর্যস্তদের অর্থ সাহায্য, জিএসটি ইত্যাদি বিষয়ে কেন্দ্রের বঞ্চনার প্রশ্নে মুখ বন্ধ থাকেন; রাজ্য বিজেপির বিদ্বেষ-বিভাজন-ঘৃণা-হিংসা ছড়ানোর সন্ত্রাসমূলক আচরণ আর মাফিয়া কার্যকলাপের ব্যাপক বাড়বৃদ্ধি দেখেও ধৃতরাষ্ট্রের ভূমিকা পালন করে চলেন, উপরন্তু বিজেপির রামমন্দির শিলান্যাস পূজনে মেতে ওঠেন এবং সেটা সরকারী জায়গায় রাজভবনের ভিতরেই, এরকম এক রাজ্যপালের কাছে রাজ্যের শাসকের বিরুদ্ধে নালিশ ঠোকা, দয়া-দাক্ষিণ্য চাইতে যাওয়া একদিকে দেখিয়ে দিচ্ছে রাজ্যপালের স্বরূপ উন্মোচনের প্রশ্নে দেউলিয়াপনা, অন্যদিকে সুবিধা করে দিচ্ছে কেন্দ্রের মোদী জমানার এবং রাজ্যের বিজেপিরই। এইসব কারণে বামপন্থী শক্তিগুলোর সাথে কংগ্রেসের ‘বিকল্প’ জোট সরকার গঠনের ভিত্তিহীন রাজনীতির বাজার জমানোর কসরত ব্যর্থ হতে বাধ্য। কংগ্রেস যদি বিরোধী বৃহত্তর বাম গণতান্ত্রিক উদ্যোগে সামিল হতে চায় তাহলে কংগ্রেসকেও কাজে লাগানোর দরজা খোলা রাখা যায়, কিন্তু তার প্রধান বর্শামুখ থাকবে সারা দেশের ক্ষেত্রে প্রধান শত্রু বিজেপির বিরুদ্ধে। তৃণমূলী শাসন অবশ্যই এক স্বৈরশাসন, তবু মতাদর্শ ও রাজনীতির বিচারে, আম্বানী-আদানীদের মতো কর্পোরেটশ্রেণীর হাতে সমস্ত সম্পদ হস্তান্তর, শাসন ক্ষমতায় থাকার স্তর-জোর-ব্যাপ্তি, রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করা ও শাসন চালানোর তুলনাতেও বিজেপি-টিএমসি সমার্থক নয়।

বিজেপি আজ সংবিধানের গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, বহুত্বের পরম্পরা, জাতিয়তাবাদের সংজ্ঞা, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও সম্প্রদায়গুলোর স্বায়ত্ততা, নারীর অধিকার, নাগরিকত্ব নির্ণয়ের মানদন্ড ইত্যাদি সবকিছুকেই পাল্টে দিতে চায় তার গন্তব্য হিন্দুত্ব-হিন্দুরাষ্ট্র কায়েমের স্বার্থে। বিগত দু’দশকে বিজেপি ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটিয়েছে বিশেষত উত্তর ও পশ্চিম ভারতে, ক্ষমতার দখল পেয়েছে রাজ্যে রাজ্যে, যদিও কোনো কোনো রাজ্যে উল্টেছে তার রাজপাট, কোনো কোনো রাজ্যে আবার ঘোড়া কিনে গরিষ্ঠতার ঘট উল্টিয়ে দখল নিয়েছে ক্ষমতার, এখনাবধি সবচেয়ে কম সুবিধা করতে পেরেছে দক্ষিণ ভারতে। তবে শুরু করেছে পূর্ব ভারত দখলের অভিযান। দখল করেছে আসাম, ত্রিপুরা। তার রাজ্য শাসনের নমুনায় রয়েছে গুজরাট-আসাম-উত্তরপ্রদেশ মডেল। এবার মরীয়া হচ্ছে বিহারের দখল পেতে, নীতীশ কুমারের জেডি(ইউ)-র সাথে জোট পাকিয়ে। কিন্তু এবার বিহার থেকেই পাল্টা শুরু হচ্ছে বিজেপিকে মোকাবিলার সংকল্প, আর সেই ঝড়ে নীতীশ রাজত্বের অবসানও নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ। বিহারে সংগ্রামী বামশক্তিসমূহ রয়েছে সংগ্রাম-সমাবেশে, নির্বাচনী রণনীতি-রণকৌশল প্রণয়ন ও প্রয়োগে কার্যকরী হয়ে উঠছে বাম শক্তিগুলোর প্রভাব। বিহারের পাশাপাশি তাই সংগ্রাম-সমাবেশ চালিয়ে যেতে হবে পশ্চিমবঙ্গেও। প্রস্তুত হতে হবে বিশেষ করে বাম শক্তিগুলোকে। রণধ্বনি তুলতে হবে বিজেপি হটাও দেশ বাঁচাও, বাংলা বাঁচাও!! এই দিশায়-লক্ষ্যে টিএমসিকেও সমুচিত জবাব দেওয়া সম্ভব। আওয়াজ তুলতে হবে, তৃণমূলের অপশাসনের জবাব চাই, জবাব দাও!

খণ্ড-27
সংখ্যা-37