সম্পাদকীয়
বিজেপি-র ত্রিমুখী প্রচার কৌশল
dew

সময়ের আঁকবাঁক বুঝে বাংলায় বিজেপি এবার ত্রিমুখী প্রচার কৌশলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। ইতিমধ্যে মোদী সরকার নিয়ে আসে বিশেষ করে কৃষি সম্পর্কিত একপ্রস্থ নয়া বিল। সেইসাথে শ্রম বিধি সংক্রান্ত ও অন্যান্য বেশ কিছু বিল। সেগুলো সংসদে নজিরবিহীনভাবে পাশও করিয়ে নিয়েছে। কোনও আলোচনার ধার-কাছ মাড়ায়নি। স্রেফ একতরফা সাংসদ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর খাটিয়েছে, ভোটাভুটির ধার ধারেনি, উপরন্তু প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়াকে অজুহাত বানিয়ে বিরোধী সদস্যদের একাংশকে সংসদ কক্ষ থেকে বহিষ্কার ও বাকিদেরকে বয়কটে প্ররোচিত করেছে। এইভাবে বিলগুলো পাশ করিয়েছে। রাষ্ট্রপতিরও সম্মতি পেয়েছে, আইনে পরিণত করে নিয়েছে। বিরোধী দলগুলো আপত্তি জানিয়েছিল সরকারের কাছে, আবেদন করেছিল রাষ্ট্রপতির কাছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। হল না যখন, তখন বাঁধ ভেঙে গেল প্রতিবাদের প্রতিরোধের নতুন এক কিষাণ জোয়ারে। তা আছড়ে পড়ে এরাজ্যেও। এর প্রতিক্রিয়ায় গনগনে মাশুল গোনা অনিবার্য, আঁচ করছে বিজেপি। তাই পদক্ষেপ করল প্রচার কৌশলের ছাঁচ পরিবর্তনের। তার ত্রিশূল প্রচারের বিষয়-তিনটি হল, এক, মোদী-বিল কৃষকদের ওপর থেকে মধ্যস্বত্বভোগী প্রথার অবসান ঘটাবে! দুই, এরাজ্যে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের করালছায়া আইন শৃংখলা ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে এক ক্রমবর্দ্ধমান বিপদ! তিন, গণতন্ত্র এখানে অবরুদ্ধ। এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে প্রথমোক্ত ও শেষোক্তটির বাস্তবতা রয়েছে অত্যন্ত রূঢ় প্রকৃতির। তার সাথে লেপ্টে নিজের তৈরি দুটো ভিত্তিহীন ভূয়ো বিষয়টি সাজিয়ে-গুছিয়ে বিজেপি প্রচারে নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তবে কেন্দ্রের নয়া কৃষি আইনের সপক্ষে হাওয়া তোলা অতো সহজ হওয়ার নয়। তার প্রথম মহড়ায় বিজেপি তা ভালোই মালুম পেল। কৃষি জমি রক্ষা আন্দোলনে অন্যতম প্রতীক হয়ে থাকা সিঙ্গুরে বিজেপির সাংসদ নেত্রীকে সদলবলে কৃষক জনতার কালো পতাকা দেখতে হয়েছে। ও মাটিতে প্রতিবাদ কিভাবে পুনরুজ্জীবিত হল, তার চেয়েও বড় কথা, কৃষকের চেতনায় বিজেপি প্রথমেই ধাক্কা খেল। প্রতিরোধের এই প্রয়াসকে লাগাতার ধারায় পরিণত করে তোলা প্রয়োজন। গ্রামে গ্রামে রব তোলা দরকার। কৃষক চেতনা, গ্রাম চেতনা জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন। বিজেপি যেখানেই এই কৃষক বিরোধী কৃষি আইন নিয়ে মুখ খুলবে সেখানেই তার স্বরূপ উন্মোচনে পাল্টা প্রচারে ধাওয়া করতে হবে। বিজেপির প্রচার কৌশলের দ্বিতীয় ‘ইস্যু’ হল, এরাজ্য পরিণত হয়েছে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটিতে! মাদ্রাসাগুলো তার আখড়া! এর সাথে অকস্মাৎ জুড়ে দেওয়া হল অন্য এক চিল চিৎকার! গরু-পাচার নিয়ে। মুর্শিদাবাদের ঘটনাবলীর ধারাভাষ্যে এখনাবধি আধিপত্য চলছে ‘নিয়া’-বিজেপি-র। মিডিয়ার প্রচারে থাকছে বিচিত্র সব ধোঁয়াশা। তা থেকে সাধারণ মানুষের মনে খোলসা হচ্ছে না কিছুই, বরং ছড়াচ্ছে বিভ্রান্তি বিস্ময় গুচ্ছের প্রশ্ন। তার জের টেনে বিজেপি সক্রিয় হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে, ভয়-ভীতি সন্ত্রাসে পরিবেশ বিষিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে। রাজ্যের সীমান্ত জেলাগুলোর চোরা সমান্তরাল অর্থনীতিতে গরু পাচার অতি চেনা বস্তু। এর মধ্যে শাসকদল-পুলিশ-প্রশাসন-বিএসএফ সবেরই রয়েছে স্বার্থের হাত। তাই কেন্দ্র-রাজ্যের ক্ষমতার কোনও পক্ষেরই এপ্রশ্নে ‘সাধু’ সাজার উপায় নেই। তবু বিজেপি চায় এটাকেও ‘ইসলামিক সন্ত্রাস’-এর হৈচৈ তোলার সাথে জুড়ে দিয়ে ‘যুগল ইস্যু’ হিসেবে পাকিয়ে তোলার। এভাবে মরীয়া হবে নন-ইস্যুকে ‘ইস্যু’ তোলার দুরভিসন্ধিতে। তবে এর মুখোশ উন্মোচিত করতে বিএসএফ কার অধীন সেপ্রশ্ন তুলে যেমন চেপে ধরা যায়, তেমনি আরও অনেক ইস্যুও রয়েছে। যেমন, মোদীর বিদেশ থেকে কালো টাকা ফেরানোর প্রতিশ্রুতির প্রতারণা, পি এম কেয়ারস্ ফান্ডের টাকার হিসাব দিতে অস্বীকার করা! রাজ্যে বিজেপি-র প্রচার কৌশলের তৃতীয় উৎস ও অঙ্গ হল গণতন্ত্রের বিষয়। এক নির্মম বাস্তবতা হল এখানে সরকার ও শাসকদলের দলতন্ত্র-দমনতন্ত্রের যাঁতাকলে গণতন্ত্র আক্রান্ত হয় প্রতিনিয়ত। আর এই সূত্রেই এখানে বিজেপি বাড়াবাড়ির সুযোগ পাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে চেতনার প্রশ্নে পশ্চাৎপদতার কারণে যখন মোদীতন্ত্র-যোগীতন্ত্রের বিভীষিকা দূরের বিষয় হয়ে থাকে আর রাজ্যের টিএমসি শাসনে উৎপীড়নের জ্বলন প্রাণান্তকর করে তোলে, সেই দুঃসহ অবস্থার সুযোগ নিয়েই বিজেপি ‘গণতন্ত্রের পরিত্রাতা’ সেজে তৎপর হয় পরিসর বাড়ানোয়।  নেতাদের মুখে নিত্য লেগে থাকে অকথ্য ভাষা, মেরে লাশ বানিয়ে দেওয়ার হুঙ্কার।

এর মোকাবিলায় পাল্টা প্রচারে ধেয়ে যাওয়া প্রয়োজন। কেন্দ্রের মোদী জমানা, রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি জমানা কেমন ফ্যাসিবাদী প্রকৃতির, দেশকে কিভাবে পরিণত করছে গণতন্ত্রের নিধনভূমিতে, মতপ্রকাশের নাগরিক স্বাধীনতাকে কিভাবে নানা রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের নাগপাশে রুদ্ধ করছে, সেইসব উন্মোচনে এগিয়ে যাওয়াই আজ সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।

খণ্ড-27
সংখ্যা-35