প্রতিবেদন
অর্থনীতির সংকোচনের ফলে শ্রমিক-কৃষক খেটে খাওয়া মানুষদের ২ বছরে মাথাপিছু ২৫ হাজার টাকা আয় কমবে
area

১৪ তারিখে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের (আইএমএফ) তরফে যে বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে অনুমান পেশ করা হয়েছে তা ভারতের পক্ষে কোনোভাবেই সুখপ্রদ নয়। একদিকে গত জুন মাসে করা বৃদ্ধির হারের অনুমান, -৪.৫%-কে সংশোধন করে ভারতের ২০২০-২১-এর অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারকে -১০.৩% করা হয়েছে। যদি আইএমএফ-এর তার তিন মাস আগে এপ্রিল, ২০২০র যে বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে অনুমানের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে বৃদ্ধির হারের অনুমান ১.৯%কে সংশোধন করে -১০.৩% করা হয়েছে। অর্থাৎ, আইএমএফ এপ্রিল মাসে ভারতীয় অর্থনীতির ২০২০-২১ সালে ১.৯% বৃদ্ধি হবে বলে অনুমান করেছিল, তার তিনমাস বাদে অনুমান করা হল ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধিতো হবেই না বরং হ্রাস ঘটবে ৪.৫%; আর সাম্প্রতিক অনুমান হল হ্রাস আরো ভয়ানক হবে, ১০.৩%। অর্থাৎ, এপ্রিলের তুলনায় হ্রাসের পরিমাণ ১২.২%। এভাবে ক্রমাগত অর্থনীতির ধ্বসের অনুমান ভারতীয় অর্থনীতির ভয়ঙ্কর ক্ষয় নির্দেশ করছে নাতো? আশা করা যাক, দেশের অর্থনীতি কৃষক-শ্রমিক-শ্রমজীবী মানুষের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াবে।

একদিকে যখন ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির হার সম্পর্কে আইএমএফ-এর অনুমান গত ৬ মাসে ক্রমাগত নেতিবাচক হয়েছে, ঠিক তখনই বিশ্ব অর্থনীতি সম্পর্কে অনুমান কিন্তু বিপরীতমুখী হয়েছে। জুন মাসে আইএমএফ-এর অনুমান ছিল যে বিশ্ব অর্থনীতি ২০২০ সালে ৫.২% হ্রাস পাবে, সাম্প্রতিক অনুমানে সেই হ্রাসের মাত্রা ০.৮% কমে ৪.৪% হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশি দেশ চিনের ক্ষেত্রে এপ্রিলের অনুমানের তুলনায় সাম্প্রতিক বৃদ্ধির অনুমান ১.৬% বেড়েছে। কোভিডে সর্বাধিক আক্রান্ত অন্যতম দুটি দেশ আমেরিকা ও ব্রাজিলের বৃদ্ধি সম্পর্কে পূর্বাভাষ জুন মাসে করা আইএমএফের অনুমানের তুলনায় বেড়েছে যথাক্রমে ৩.৭% ও ৩.৩%। আইএমএফ-এর পূর্বাভাষ অনুযায়ী ২০২০তে ইউরোপের কেবল দুটি দেশ স্পেন (-১২.৮%) ও ইতালি (১০.৬%)র অর্থনৈতিক হ্রাস ভারতের তুলনায় বেশি হলেও কিন্তু ওই দুটি দেশের ক্ষেত্রেও আইএমএফ-এর হ্রাসের পূর্বাভাষ জুনের তুলনায় বাড়েনি, বরং ইতালির ক্ষেত্রে ২.২% কমেছে (স্পেনের ক্ষেত্রে একই থেকেছে)। মনে রাখা দরকার, স্পেনের প্রতি ১০ লাখে করোনায় মারা গেছেন ৭২৭ জন, ইতালিতে ৬০৬ জন; অন্য দিকে ভারতে সেই হার ৮৩ জন। ফলে কোভিডের তুলনায় ভারতে অর্থনৈতিক দুর্দশার তীব্রতা অনেক মারাত্মক।

অর্থনৈতিক অবহেলার সরকারী নীতির পরিণাম হিসেবেই এই মারাত্মক অর্থনৈতিক ক্ষতিকে দেখতে হবে। ভারতের প্রতিবেশি অন্য সকল দেশের তুলনায় আইএমএফ কর্তৃক অনুমিত ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষতি ভয়ানক। অনুমিত বাংলাদেশের বৃদ্ধি ৩.৮%, মায়ানমারের বৃদ্ধি ২%, চিনের বৃদ্ধি ১.৯%, ভূটানের বৃদ্ধি ০.৬%, নেপালের ০.০%, পাকিস্তানের (হ্রাস) -.০.৪%, শ্রীলঙ্কার (হ্রাস) -৪.৬%, আফগানিস্তানের (হ্রাস) -৫%। এর তুলনায় ভারতের আনুমানিক অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রাটা দেখুন, -১০.৩%। আইএমএফ-এর অনুমানকে যদি অনুসরণ করা যায় তাহলে বোঝা যাবে যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক মোর্চা সরকার দেশের অর্থনৈতিক পরিচালনে কী অপরিসীম অক্ষমতা প্রদর্শন করেছে।

সেই অক্ষমতার অন্যতম নিদর্শন হল, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের তুলনায় ভারতের মাথাপিছু আয়ের পশ্চাদপসরণ। আইএমএফ-এর পূর্বাভাষ অনুযায়ী ২০২০-২১-এ ভারতের বার্ষিক মাথাপিছু আয় হবে (ডলারের হিসেবে) ১৮৭৭ ডলার, আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা দাঁড়াবে ১৮৮৮ ডলার। যদিও ২০০৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বেড়েছে, কিন্তু ভারতের বৃদ্ধি তার তুলনায় বেশি হওয়ায় ভারত ও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের পার্থক্যটা বেড়েছে। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বেড়েছে অন্যদিকে ভারতের বৃদ্ধির হার কমেছে। তাছাড়া ২০০৪ থেকে ২০২০ এই সময়কালে ১৫ বছরে বাংলাদেশর জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে ১৮%, ভারতে যা ২১%। বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনামূলক কম বৃদ্ধি মুসলমানদের দ্রুত জনসংখ্যাবৃদ্ধির কল্পকথাকে নির্ঘাৎ ধূলিসাং করছে। অন্যদিকে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশের অমিত-কথনকেও মিথ্যে প্রমাণিত করছে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের এই অগ্রগতিকে কেবল কোভিডের সঙ্গে মেলালে ভুল করা হবে। ৫ বছর আগেও ভারতের মাথা পিছু জিডিপি ভারতের থেকে প্রায় ৪০% কম ছিল। কিন্তু গত ৫ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি বার্ষিক ৯.১% চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে, যা ভারতের ক্ষেত্রে মাত্র ৩.২%।

কেবল মাথাপিছু আয়েই নয়, ভারত বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু সূচকে পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের ঋণ বনাম জিডিপি অনুপাত ৪৫.৯৫, ভারতের ৯০.৪%; ভারতের গড় আয়ু ৬৯.৪ বৎসর, বাংলাদেশের ৭২.৩ বৎসর; মহিলাদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার বাংলাদেশে ৩৬, ভারতে ২০। লিঙ্গ সমতায় বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম, ভারতের ১১২তম; বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের নিরিখে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম, ভারতের ৯৪তম; অনিরাপদ পানীয় জল, অস্বাস্থ্যকর মলনিকাশী ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যবিধির অভাবে প্রতি লাখ জনসংখ্যায় মৃত্যুহার বাংলাদেশে ১২, ভারতে ১৯; ফলে বেশিরভাগ সামাজিক সূচকেই ভারত বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে যদিও বহুচর্চিত সহজে ব্যবসার সুযোগে, জিডিপির তুলনায় বিদেশী বিনিয়োগের হারে বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে।

সামগ্রিকে, দেশের সরকার ও প্রধানমন্ত্রী মোদী ও তাঁর শাগরেদ অমিত শাহ পুরো দেশ জুড়ে যে বিভেদের রাজনীতি ও গণতন্ত্রহীনতার পরিবেশ তৈরি করেছে তার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের নাগরিকদের। কেবল ধার্মিক বিভাজনের শ্লোগান ও কর্পোরেট তোষণের কর্মসূচী দিয়ে কোনো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। কেবল মিথ্যে ও ধোঁয়াশা তৈরি করেও অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটানো যায় না। ২০১৯-২০-র বাজেটে ২০২৪-২৫এর মধ্যে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির মনভাোলানো শ্লোগান দেওয়া হয়েছিল। যার জন্য প্রতি বছরে চক্রবৃদ্ধি হারে গড় বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল ৮% অন্তত। যদি ২০১৮-১৯-এর তুলনায় ২০২১-২২ পর্যন্ত অর্থনীতির কথা ভাবা হয়, তাহলে ২০১৮-১৯-এর জাতীয় আয় ১০০ টাকা হলে ২০২১-২২-এ তা হওয়া দরকার ১২৬ টাকা, ২০২৪-২৫-এ ১৫৯ টাকা। আইএমএফ-এর অনুমান অনুযায়ী ২০২১-২২-এ তা হবে ১০১ টাকা, ২০২৪-২৫-এ হবে ১২৫ টাকা। মোদিজির ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি কত বড় মিথ্যে তা বোঝাই যাচ্ছে।

শেষে আরেকটি কথা শাসক দলের অনেকেই বলতে শুরু করেছে ২০২১-২২-এ অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে ও আমাদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ৮.৮% হবে বলে আইএমএফ বলেছে। ওই বৃদ্ধির হারের অনুমানটি আপাতত সত্যি হলেও চেচিয়ে বলাটা ধোঁকা। কারণ, ২০১১-১২ সালের টাকার মূল্যে ২০১৯-২০-র জিডিপি যদি ১০০ টাকা হয় তাহলে অনুমান অনুসারে ২০২০-২১-এ জিডিপি হবে ৮৯ টাকা ৭০ পয়সা; ২০২১-২২-এ ৯৭ টাকা ৬০ পয়সা। সেই হিসেবে ২০১১-১২ সালের টাকার মূল্যে ভারতের জিডিপি ২০১৯-২০ সালের ১৪৫.৭ লক্ষ কোটি টাকা থেকে কমে ২০২০-২১-এ ১৩০.৭ লক্ষ কোটি টাকা হবে ও ২০২১-২২-এ ১৪২.২ লক্ষ কোটি টাকা হবে। ফলে ২০১১-১২ সালের টাকার মূল্যে দু বছরে জিডিপির ক্ষতি হবে প্রায় ১৯ লক্ষ কোটি টাকার। বর্তমান টাকার মূল্যে যা প্রায় ৩০ লক্ষ কোটি টাকা। কাদের পকেট থেকে যাবে তা, কাদের ক্ষতি হবে তাতে? অবশ্যই খেটে খাওয়া শ্রমিক কৃষকদের, যদি খেটে খাওয়া শ্রমিক-কৃষকদের সংখ্যা জনসংখ্যার ৯০% ধরা হয় তাহলে ২ বছরে তাদের মাথাপিছু আয় কমবে ২৫ হাজার টাকা। ওদিকে আম্বানি আদানিদের সম্পত্তিতো করোনাভাইরাসেও বেড়েই চলেছে।

অমিত দাশগুপ্ত      

খণ্ড-27
সংখ্যা-38