সম্পাদকীয়
বেছে নিতে হবে এখনই
sadc

এরাজ্যে সবকিছু ঢেলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিজেপি। তার এক নজরকাড়া নজীর স্থাপন করতে সংঘটিত করল ‘নবান্ন অভিযান’। দলের যুব সংগঠনের ব্যানারে নেওয়া হলেও এটা ছিল বিজেপির সর্বাত্মক কর্মসূচী। তার মানে বিজেপি এখানে বাড়তে চাইছে বিশেষত যুবশক্তির ওপর ভর করে। আসল প্রচার চালাচ্ছে সামনে বিজেপি আর নেপথ্যে আর এস এস-এর সমন্বয়ে হিন্দুত্বের মেরুকরণের রাজনীতির রণকৌশলে। আর ওপর ওপর দেখাচ্ছে গণতন্ত্র ও কর্মসংস্থান ফেরানোর বাহানা। ইস্যু দুটো হল  উপলক্ষ। লক্ষ্য হল ২০২১-এ ক্ষমতা দখল। কিন্তু ক্ষমতায় এলে কি হবে তার প্রমাণ হল যোগীরাজের উত্তরপ্রদেশ, মোদীরাজের কেন্দ্র। কোনও সন্দেহ নেই, টিএমসি শাসনে পশ্চিমবঙ্গ পর্যবসিত হয়েছে গণতন্ত্র দমনের রাজ্যে, কিন্তু বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ পৌঁছেছে গণতন্ত্র নিধনের সীমাহীন চরমে। তুলনাটা কথাপ্রসঙ্গে বিজেপির বাংলা সভাপতির মুখ থেকেও বেরিয়ে এল! আর কেন্দ্রের মোদী সরকারও কার্যত গণতন্ত্রের কবরই রচনা করে চলছে। ‘করোনাবিধি’র নামে কর্তন করে চলছে সমস্ত ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পরিসরকে। তাই বিজেপি কিছুতেই টিএমসির বিপ্রতীপে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিকল্পের যুক্তিসঙ্গত দাবি করতে পারে না। তবু মরীয়া হচ্ছে ফুলে-ফেঁপে ওঠায়, নানা ভেক ধারণ করে। ফ্যাসিবাদীরা ঠিক যেমনটা করে থাকে। গণঅসন্তোষের বিভিন্ন ইস্যু আত্মসাৎ ও পুঁজি করে চলা। তৃণমূলী শাসনে এরকম ইস্যু তৈরি হচ্ছে হামেশাই। পশ্চিমবঙ্গে ক্রমাগত উধাও হচ্ছে কাজ। বেকারি বাড়ছে তীব্র ও ব্যাপকভাবে। গ্রাম ও শহরে সর্বত্র। কাজের খোঁজে পরিযায়ী হয়ে যাওয়ার প্রবণতা এখানে কর্মসংস্থানের সংকটকে আরও অসহনীয় মাত্রায় উন্মোচিত করে দেয়। চূড়ান্ত অপদার্থতা থাকছে রাজ্য সরকারের। তার সাথে মিলে চলছে দুর্নীতি-দলতন্ত্র। যেখানেই অসংগঠিত কিছু কাজের ঠিক-ঠিকানা মেলে সেখানেই পড়তে হয় দাদাগিরির।

কিন্তু বিজেপির ব্যর্থতা ক্ষমাহীন। গত লোকসভা নির্বাচনে কাজের বহুত প্রতিশ্রুতির ফিরিস্তি শুনিয়ে গঙ্গার দু’পাড়ে দুটি আসন কব্জা করেছিল বিজেপি। তারপরে কিছুই হয়নি। হবেটা কি করে? কর্মসংস্থানের দায়দায়িত্বই তো মোদী সরকার পরিত্যাগ করার পলিসি নিয়েছে মোদী সরকার। কৃষি থেকে শিল্প, পরিষেবা সবকিছু তুলে দিচ্ছে কর্পোরেটদের হাতে। অগত্যা দলের নির্দেশে বাংলার গঙ্গাপাড়ের সাংসদ নেতা-নেত্রী দুজন লিপ্ত হয়েছেন অন্য কাজে — সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চাষ ছড়াতে আর মাফিয়া জোগাড়ে চষে ফেলতে। বিরোধী দল হয়ে থাকলেও উত্তরবঙ্গ থেকে গাঙ্গেয়বঙ্গে বাহুবলী দাদাদের অন্তর্ভুক্তি বাড়ছে বিজেপিতে। এসব ‘সম্পদ’ মিলছে মূলত টিএমসি থেকে। এজন্য কখনও কখনও চড়া মাশুলও গুণতে হচ্ছে। সম্প্রতি উত্তর চব্বিশ পরগণার শিল্পাঞ্চলে যে ডাকসাইটে নেতার গুলিতে মারা যাওয়া হজম করতে হল, তিনি ছিলেন বিশাল এলাকার দাপুটে বাহুবলী, দলের ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদের ডান হাত, বলাবাহুল্য ঐ সাংসদও কুখ্যাত বাহুবলী।

বাংলায় বিজেপি এক সুযোগ সন্ধান ও সংকটের জটিল সন্ধিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ‘ম্যাজিক বৃদ্ধি’র জন্য নির্ভর করছে তৃণমূল কংগ্রসের ভাঙ্গনের ওপর, আবার সেই ফায়দা ওঠাকে কেন্দ্র করে দলের মাথা-নেতাদের ক্ষমতার বিন্যাস-পুনর্বিন্যাস করতে বিজেপি পড়ছে ‘আদি-নব’-র সংঘাতেও।

দেশব্যাপী পরিস্থিতি দাবি করছে বিজেপিকেই প্রতিরোধের প্রধান লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে চলতে। এই পরিস্থিতি মাথায় রেখেই চলতে হবে পশ্চিমবাংলার বাম রাজনীতিকে। কোনোমতে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের তাড়না থেকে জগাখিচুড়ি শ্লোগান আর তার সাথে খাপ খাওয়ানোর সুবিধাবাদী সমীকরণে শরিক খোঁজার অভিলাষ থেকে বিরত থাকাই উচিত। বামপন্থী শক্তিগুলোর সবচেয়ে জোর দেওয়া প্রয়োজন বাম ধারায় সম্মিলিত উদ্যোগ, হস্তক্ষেপ ও সক্রিয়তা বাড়িয়ে চলায়। দরকার আন্দোলনের ধারার দৃঢ় বনিয়াদ নির্মাণের ভিত্তিতে অনন্য নজির সৃষ্টি করে চলা, সংগ্রামী সংকল্প নির্ভর বামপন্থার মর্যাদার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে চলা। এটাই আসল চাবিকাঠি, এভাবে চলতে পারলে এই ধারার কার্যকারিতাকে মান্যতা দিয়ে আরও অনেক শক্তি বাড়ার বহু শর্ত তৈরি হবে, নাহলে কোনো কার্যকরী শক্তি থাকবে না। তাই যা বেছে নেওয়ার এখনই নিতে হবে।

খণ্ড-27
সংখ্যা-36