বিহার নির্বাচন প্রসঙ্গে
ddr

২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিহারের জনগণের দেওয়া বিজেপি-বিরোধী জনমতের বিরুদ্ধে নীতীশ কুমারের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতালিপ্সু বিজেপি বিহারের মসনদ ছিনতাই করেছিল। এবারও তারা ভেবেছিল কোভিড-১৯ ও লকডাউনকে এনডিএ-র ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বিহার নির্বাচনকে লুঠ করবে। কিন্তু বাস্তবে নীতীশ কুমার সরকারের উদ্ধত দুঃশাসন ও বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে জনগণের ক্রোধ ও সংকল্প স্পষ্টত বিজেপির বুকে কাঁপন ধরিয়েছে এবং আরজেডি-বাম-আইএনসি বৃহত্তর জোটের বিরুদ্ধে ও বিশেষত জোটে সিপিআই(এমএল)-এর উপস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে জনগণকে ভয় দেখানোর চেষ্টা শুরু করেছে তারা।

বিজেপিকে কোন বিষয়টা এত ভীত ও মরিয়া করে তুললো? এই নির্বাচনে জনগণের মনে সর্বাগ্রে যে প্রশ্নগুলি উঠে আসছে তার কোনো স্পষ্ট জবাব বিজেপির কাছে নেই। আসলে জনতার ভাবনার গতিমুখ পাল্টানোর জন্যে তাদের একটি অবান্তর শত্রুকে খাড়া করা দরকার এবং তারা মনে করে সিপিআই(এমএল)-কে শত্রু হিসেবে জনগণের সম্মুখে খাড়া করতে পারলে বিজেপির সর্বনাশা নীতি, বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতি এবং নিষ্ঠুর ও দমনমূলক শাসনে সারা দেশে যে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে তা লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাবে। তাদের প্রতিবেশি উত্তরপ্রদেশে যা কিছু ঘটে চলেছে – শান্তি ও সমৃদ্ধির তালুকের বদলে সেখানে যোগীরাজ ধর্ষণ ও নিপীড়ন, মব লিঞ্চিং ও ভুয়ো সঙ্ঘর্ষে হত্যা এবং সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলার শাসন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গেছে – তাতে বিহারের মানুষের বিজেপিকে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

নির্বাচনী অঙ্গনে সিপিআই(এমএল)-এর ট্র্যাক রেকর্ডটি কী? ১৯৮০-র শেষদিকে সিপিআই(এমএল) নির্বাচনী বুথ-দখল রুখে দেওয়া এবং ভূমিহীন দরিদ্র ও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত দলিতদের তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা ও ক্ষমতায়নের দল হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল। প্রথম ভোটের পরেই ভোজপুরে দলিতদের গণহত্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কিন্তু তারা ১৯৮৯ সালে প্রথম মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সাংসদ হিসাবে কমরেড রামেশ্বর প্রসাদকে সংসদে পাঠাতে সফল হয়। আরো একজন সিপিআই(এমএল) নেতা ডাক্তার জয়ন্ত রংপি পরপর চারটি নির্বাচনে লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, অসমের স্বায়ত্তশাসিত জেলার আসন থেকে।

বিহার ও ঝাড়খণ্ডে সিপিআই(এমএল) বিধায়ক কে কে ছিলেন? সাহার থেকে পরপর তিনটি নির্বাচনে জয়ী ভোজপুরের প্রবাদ প্রতিম কমিউনিস্ট নেতা কমরেড রাম নরেশ রাম। বিহারের রাজ্য সরকারী কর্মচারী আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা কমরেড যোগেশ্বর গোপ। ঝাড়খণ্ডের জনগণের সবচেয়ে দুঃসাহসী কণ্ঠ, কমরেড মহেন্দ্র সিং, যাঁকে ২০০৫ সালের নির্বাচনের মনোনয়ন পেশের ঠিক পরেই হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়াও বিহারের মানুষ তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন চন্দ্রদীপ সিং, অমরনাথ যাদব, অরুণ সিং, সুদামা প্রসাদ ও রাজরাম সিংয়ের মতো প্রখ্যাত কৃষক নেতাদের। কৃষিমজুর নেতা সত্যদেব রাম, সীমাঞ্চলের জনপ্রিয় কমিউনিস্ট নেতা মেহেবুব আলম, বিনোদ সিং ও রাজকুমার যাদবের মতো ঝাড়খণ্ডের জনপ্রিয় নেতারা বিহার ও ঝাড়খন্ড বিধানসভায় সিপিআই(এমএল) বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

বিজেপির অনেক বিধায়ক ও সাংসদ এই বিশিষ্ট জননেতাদের তালিকার বিপরীতে ঘৃণ্য, কলঙ্কিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত হবেন। কুলদীপ সেঙ্গারের মতো ধর্ষণে অভিযুক্ত এবং দোষী সাব্যস্ত বিধায়ক, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে অভিযুক্ত প্রজ্ঞা ঠাকুর, যিনি গান্ধীর ঘাতক গডসের গুণগান করেন বা গিরিরাজ সিংয়ের মতো মন্ত্রী যিনি কুখ্যাত গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড রণবীর সেনার সর্বোচ্চ নেতা ব্রহ্মেশ্বর সিংকে বিহারের গান্ধী হিসাবে মহিমান্বিত করেন এবং মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, যিনি তার পদের অপব্যবহার করে নিজের বিরুদ্ধে সমস্ত ক্রিমিনাল চার্জগুলিকে বাতিল করে দেন – এমন লজ্জাজনক উদাহরণ নিয়ে বিজেপি বড়াই করতে পারে, কিন্তু আসলে এ’সমস্তই গণতন্ত্রের ইতিহাসে কলঙ্কময় দৃষ্টান্ত হিসেবে লেখা থাকবে।

বিজেপি গরিব ও নিপীড়িতদের কণ্ঠ শুনেই ভয় পাচ্ছে। বিহার জানে যে বিজেপি কীভাবে গণহত্যার খলনায়কদের পাশে দাঁড়িয়ে নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের জন্মগত মর্যাদাবোধ, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং বিকাশের অন্বেষণকে ডুবিয়ে মারতে চাইছিল। বিজেপি এই সত্যটি ঠিক হজম করতে পারছে না যে দরিদ্ররা এই ষড়যন্ত্রের নকশাকে প্রতিহত করতে এবং প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে এবং বিহারের চলমান পরিবর্তনের লড়াইয়ে তারা যোদ্ধা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এই লড়াইকে প্রবল শক্তিশালী করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

bhr

 

বিহারের ‘মহাগঠবন্ধন’ বা মহাজোট কমিউনিস্ট, সমাজবাদী ও কংগ্রেস এই তিন শিবিরকে একত্রিত করে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গৌরবময় জোটের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বিজেপির মতাদর্শগত ও সাংগঠনিক পূর্বসূরীরা ব্রিটিশ শাসকদের সাথে সহযোগিতা করে স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। আজ তারা ‘ভুঁড়ে আংরেজ’ বা বাদামি ইংরেজের মতো দেশকে শাসন করার চেষ্টা করছে, যাদের বিরুদ্ধে ভগত সিং আমাদের আগেই সতর্ক করেছিলেন – ভারতীয় অর্থনীতিকে আদানি-আম্বানির সাম্রাজ্যে পরিণত করে দেশে কোম্পানি রাজ চালু করে এবং বিরোধী স্বর ও গণতন্ত্রের কণ্ঠকে অসীম নিষ্ঠুরতায় দমন করে কালা কানুন ও দমনমূলক শাসন প্রয়োগ করে তারা ভারতবর্ষে এমন এক শাসন ব্যবস্থা জারি করেছে যা একমাত্র ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার সঙ্গেই তুলনীয়।

আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং গণতন্ত্রের গৌরবদীপ্ত উত্তরাধিকার রয়েছে। আমরা ভগত সিং ও আম্বেদকরের উত্তরসূরী যাঁরা সামাজিক সমতা এবং জনগণের মুক্তির নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। আরএসএস, যারা মুসোলিনী এবং হিটলারের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল এবং মনুস্মৃতিকে আধুনিক ভারতের সংবিধানে পরিণত করতে চেয়েছিল, আজ তারা সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য এবং ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের অভীষ্ট লক্ষ্যকে তীব্র ভাবে বিরোধিতা করে চলেছে।

গরিব ও নিপীড়িত জনগণকে তাদের উত্থানের জন্য এবং গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে দেখে বিজেপি ভয় পেতে থাকুক। বিহারে ২০১৫ সালের জনাদেশ লুন্ঠনকারী বিশ্বাসঘাতকদের, ভারতের অর্থনীতির ধ্বংসকারী এবং যে লকডাউনের ফলে বিহারী জনগণ সীমাহীন যন্ত্রণা ও অবমাননার মুখোমুখি হয়েছেন সেই নিষ্ঠুর ও অমানবিক লকডাউনের স্থপতিদের বিহারের মানুষ শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর। পরিবর্তনের জন্য নির্ধারিত সময় এসে গেছে এবং বিহার এই যুদ্ধে লড়াই ও জয়ের জন্য প্রস্তুত।

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই(এমএল)    

খণ্ড-27
সংখ্যা-38