প্রতিবেদন
কেসিসি ঋণ – অতি প্রাথমিক এক সমীক্ষা
kcc

কৃষকদের ঋণমুক্তির দাবি ২০১৭-র মধ্যভাগে দেশজোড়া আলোড়ণ সৃষ্টি করে এবং দিল্লীতে ‘কৃষকদের জাতীয় পার্লামেন্টে’ এবিষয়ে একটি বেসরকারী বিলও পাশ হয়।

এর পরপরই, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে কৃষিঋণ মুক্তি এক নম্বর অ্যাজেন্ডা হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গেও বারে বারে বিষয়টি উঠে এলেও বড় কোন আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। কিন্তু বর্তমানে মহিলাদের ক্ষুদ্র ঋণমুক্তির জোরদার আন্দোলনের আবহে কৃষিঋণ মকুবের প্রশ্নটি বিভিন্ন রূপে আবার সামনে আসছে। সাথে সাথে দাবি উঠেছে গরিব ঠিকা বা চুক্তি চাষিদেরও কিষাণ ক্রেডিট কার্ড (কেসিসি) দিতে হবে এবং সাম্প্রতিক আমফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কেসিসি ঋণ মকুব করতে হবে।

কিন্তু কেসিসি ঋণ কোন ধরনের কৃষকেরা পেয়ে থাকেন, তার কোনো বিস্তারিত তথ্য বা সমীক্ষা তেমন নজরে পড়ে না। সেই অভাব দূর করতে, প্রারম্ভিক প্রয়াস হিসেবে হুগলী জেলার পান্ডুয়া ব্লকের ৩টি সমবায় সমিতিতে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে।

প্রাথমিক তথ্য : একটি সমবায়ের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সমিতির মোট সদস্য সংখ্যা ২৮৯২, কেসিসি পেয়েছেন ৫২২ জন (১৮%)। অপর একটি সমবায়ে, সদস্য সংখ্যা ২২৫৯, কেসিসি পেয়েছেন ৭০০ জন (৩১%)। তৃতীয় সমবায়টিতে, সদস্য সংখ্যা ৩৩০০, কেসিসি হোল্ডার হলেন ২০২ জন (৬%)।

কেসিসি অধিকাংশ সদস্যদেরই নেই। কেন নেই? প্রথম কারণ, এদের বেশিরভাগেরই নিজস্ব কোনো জমি নেই। সমবায়ের এক কর্তা তো পরিষ্কার বলে দিলেন, “কিষাণ ক্রেডিট কার্ড, যারা কিষাণ তারাই কেবল পেতে পারে। মজুররা কোনো কেসিসি পেতে পারেনা।” তিনি সরকারী ভষ্যটাই শুনিয়ে দিয়েছেন এবং হেসে বলেছেন, “সরকার যতই বিজ্ঞাপন দিক, বাস্তবে অপরের জমি ঠিকে নিয়ে চাষ করছেন এমন কৃষক সরকারী হিসেবে মজুর মাত্র। কেসিসি পাওয়ার মাণদণ্ডে তিনি অচল।”

সমবায়ের সদস্য এবং যার জমি আছে এমন কৃষকও বিশেষ কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেসিসি পাচ্ছেন না। যেমন কোনো ক্ষেত্রে, পরিবারের প্রধান মারা যাওয়ার পর এখনও পর্যন্ত তাঁর নামেই জমির ‘রেকর্ড’ রয়ে গিয়েছে। জমি হয়ত ছেলেরা বা উত্তরাধিকরীরা চাষ করছেন কিন্ত ওয়ারিশনদের মধ্যে মনোমালিন্য থাকায় বা অন্য কোনো জটিলতার কারণে ওয়ারিশন সার্টিফিকেট জোগার হচ্ছে না। ফলে কেসিসি তাঁরা পাচ্ছেন না। এছাড়া ছোট চাষিদের অনেকে ‘সমবায় ঋণে কাগজ-পত্রের যা ঝক্কি, তার থেকে মহাজনের কাছে দাদন নিয়েই তো বেশ চলে যাচ্ছে’ – এই ভাবেই চলছিলেন। কেসিসির কথা তেমন ভাবতেন না। এখন এই প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে। ভবিষ্যতে সরকার যদি ঋণ মকুব করে বা নগদ অর্থ সাহায্য দেয় – এই আশায় তাঁরাও ধীরে ধীরে কেসিসির জন্য আবেদন করছেন এবং কেসিসি পাচ্ছেন।

loan

 

প্রসঙ্গত বলা যায়, সমবায়ের অধিকাংশ সাধারণ সদস্য গরিব এবং তাদের জমি নেই। তাদের সমবায়ের সদস্য হওয়ার নিজস্ব কোনো গরজ নেই। রাজনৈতিক দলের মাতব্বররাই, সমবায়ের বোর্ড নির্বাচনে এদের ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহারের জন্য সদস্য করে থাকে। সুযোগ বলতে, কোনো কোনো বছর বার্ষিক সাধারণ সভায় অন্য সদস্যদের মতো এরাও টিফিনের প্যাকেট, একটা প্লাস্টিকের বালতি কিম্বা স্টিলের থালা পেয়ে থাকেন। আর একটা সুবিধা, সমবায়ে টাকা জমা রাখলে, সন্ধ্যে বেলায় টাকা জমা দেওয়া বা তোলা যায়। কাজ কামাই করে ব্যাঙ্কে লাইন দিতে হয় না।

সে যাক। আমরা আবার বরং কেসিসি তথা কৃষি ঋণের কথায় আসি।

কেসিসিতে লাভবান হচ্ছেন কারা?

প্রথমে যে সমবায় সমিতিটির উল্লেখ করা হয়েছে (কেসিসি হোল্ডার ৫২২ জন), সেখানে কেসিসি ঋণ নিয়েছেন ৭৭% কৃষক (৪০২ জন)। বোঝা যাচ্ছে, এখানে কেসিসি রয়েছে এমন কৃষকদের অধিকাংশই ঋণ নিতে আগ্রহী এবং ঋণ পেয়েও যাচ্ছেন। ঋণ যারা পেয়েছেন তাদের মধ্যেও (ক) গরিব ও (খ) নিম্ন মধ্যকৃষকের সংখ্যাই বেশি। যথাক্রমে ১৮৫ জন এবং ১২৭ জন। (ক) শ্রেণীভুক্তরা এক একর পর্যন্ত জমির মালিক এবং (খ) শ্রেণীভুক্তরা এক একরের উর্দ্ধে ২ একর পর্যন্ত জমির মালিক। এরপরেই রয়েছেন মধ্য থেকে স্বচ্ছল মধ্যকৃষকরা। এমন মোট ৭৫ জন কৃষক ঋণ নিয়েছেন (এদের জমির পরিমাণ ২ থেকো ৩ একর পর্যন্ত)। ধনী কৃষকদের (যাদের জমির পরিমাণ ৩ একরের বেশি) মধ্যে ঋণ নিয়েছেন ১৫ জন।  

বলা বাহুল্য, জমি যার বেশি সেই বেশি অঙ্কের ঋণ পাবে। এই সমবায়টিতে দেখা যাচ্ছে আলু চাষের জন্য সর্বাধিক ঋণ (৮৫০০০ টাকা) পেয়েছেন একজন ধনী কৃষক। বাকি ১৪ জন, ৪০ হাজার টাকা থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ পেয়েছেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার, রবি মরশুমে (মুখ্যত আলু চাষে ৬৪০ টাকা শতক হিসেবে লোন দেওয়া হয়। এথেকে বুঝে নেওয়া সহজ, গরিব কৃষকরা ৭-৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ পেয়েছেন। নিম্ন মধ্যকৃষকরা ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত এবং মধ্য ও স্বচ্ছল মধ্য কৃষকরা ৪০ হাজার থেকে ৬৩ হাজার টাকা পর্যন্ত লোন পেয়েছেন।

প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার অন্যান্য ক্ষেত্রের মত সমবায় ব্যবস্থায়ও যে সঙ্গতি-সম্পন্নরাই বেশি সুযোগ পাবেন সেটা স্বাভাবিক। কিন্ত নির্দিষ্ট এই সমবায় সমিতির কার্যকলাপে এটা স্পষ্ট, সমবায় থেকে গরিব ও নিম্ন মধ্যকৃষকরাও কৃষিঋণ পাচ্ছেন।      

তবে আর একটি তথ্য নিঃসন্দেহে বেশ আকর্ষণীয়। দেখা যাচ্ছে, সমবায়টি থেকে আলু চাষে যেখানে ১৮৫ জন কৃষক ঋণ নিয়েছেন সেখানে বোরো ধান চাষের জন্য ঋণ নিয়েছেন মাত্র ১১২ জন কৃষক। এটা দেখিয়ে দেয়, জমি আছে এমন কৃষকদের অনেকেই নিজেরা বোরো চাষ করেন না। তাঁরা খেতমজুরদের বোরো চাষের জন্য জমি লিজ বা ঠিকে দিয়ে দেন। আর এই খেতমজুররা কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পাওয়ার অধিকার ভোগ করেন না।

অপর সমবায়টিতে (যার কেসিসি হোল্ডার ৭০০ জন) আলু চাষের জন্য ঋণ নিয়েছেন ৩৮০ জন (অর্থাৎ কেসিসিধারীদের ৫৪%), বোরোতে ঋণ নিয়েছেন কার্ডধারীদের ১৯% (১৩৩ জন) এবং আমনে ঋণ নিয়েছেন ২৮% (১৯৬ জন)।

এখানে আলু চাষের জন্য ১০ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ পেয়েছেন এমন চাষি ৫০ জন (আলু চাষে মোট ঋণ প্রাপকের ১৩%)। ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ পেয়েছেন ১৩০ জন (৩৪%) এবং ৪৫ হাজার টাকার বেশি ঋণ পেয়েছেন ২০০ জন (৫৩%)। এরমধ্যে একজন আবার একাই দেড় লক্ষ টাকা ঋণ পেয়েছেন। সর্বমোট এই সমবায় সমিতি আলু চাষের জন্য গত মরশুমে দেড় কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দ করেছিল।

স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, এই সমবায় সমিতির অন্তর্ভুক্ত কেসিসি কার্ডধারীদের মধ্যে ধনীকৃষকরাই অধিকতর সংখ্যায় কৃষিঋণ পেয়েছেন। ধনীকৃষক ঋণগ্রাহকের সংখ্যা ক্ষুদ্র ও মধ্যকৃষক ঋণগ্রাহকদের মিলিত সংখ্যাকেও ছাপিয়ে গেছে। তবুও মানতে হয়, ক্ষুদ্র ও মধ্যকৃষকরাও কৃষিঋণ গ্রহণের আংশিক সুবিধা ভোগ করছেন।

kkk

ঋণখেলাপী কারা হচ্ছেন-কেন হচ্ছেন?

ঋণ পাওয়ার পর ঋণ পরিশোধের ছবিটাও এক ঝলকে দেখে নেওয়া যেতে পারে।

প্রথম সমবায়টিতে, ঋণপ্রাপকদের ৩৪ শতাংশই যথাসময়ে ঋণ শোধ করতে পারেননি। এক বছরে, তিনটি ফসল মরশুমে (Crop Season) তিন দফায় ঋণ দেওয়া হয়। কেউ যদি পরপর দুটি ফসল মরশুমে নেওয়া ঋণের অন্তত একটিও শোধ করতে না পারেন তাহলে পরবর্তী ফসলের জন্য ঋণ পাবেন না। উদাহরণ হিসেবে, আমন ও রবিতে নেওয়া ঋণের মধ্যে অন্তত একটি ফসলের জন্য নেওয়া ঋণ তাকে শোধ করতেই হবে। নাহলে তিনি ঋণখেলাপী হয়ে যাবেন। দেখা যাচ্ছে, এই সমবায়ের অন্তর্ভুক্ত চাষিদের অনেকেরই ঋণ পরিশোদের সামর্থ্য নেই। ৪০২ জন ঋণগ্রহিতার মধ্যে ১৩৭ জনই যথাসময়ে ঋণ শোধ করেননি এবং এদের মধ্যে ১৩৩ জনই গরিব বা মধ্যচাষি। ঋণখেলাপীদের মধ্যে ৪ জন ধনী কৃষকও রয়েছেন। আঋণখেলাপী গরিব চাষিদের একটা অংশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ঋণগ্রহণকারী কৃষক মারা গেছেন। ঋণখেলাপীদের তালিকায় তাঁদের নাম থেকে যাওয়াটা স্বাভাবিক। বলা বাহুল্য, ঋণের দায় না নেওয়ায় মৃত কৃষকদের সন্তানরাও কেসিসি পাচ্ছেন না। আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে থাকায় এখানে গরিব ও মধ্যকৃষকদের অনেকেই সময়ে ঋণ মেটাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

দ্বিতীয় সমবায়টিতে, ঋণখেলাপীর সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। খুব জোর ৮ শতাংশ ঋণগ্রহিতা এখানে সময়মত ঋণ মেটাতে না পেরে ঋণখেলাপী হয়েছেন। ৩০ জন ঋণখেলাপীর মধ্যে ২০ জনই হলেন গরিব ও ক্ষুদ্র চাষি। পরিবারের প্রধান মারা যাওয়ার পর কেউ আর ঋণ শোধের দায় নিচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে ঋণখেলাপের কারণ এটাই। কয়েকজন আবার নিতান্ত আর্থিক অনটনের জন্যই ঋণ শোধ করতে পারছেন না। ধনী কৃষক ঋণখেলাপীদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যবসায় লোকসান বা চিকিৎসা সংক্রান্ত সংকটে পড়ে ঋণ মেটাননি। ধনী অথচ অভ্যাসগত কারণে ৫-৭ বছর ধরে ঋণ মেটাচ্ছেন না, এমন চাষিরও দৃষ্টান্ত মিলেছে।

এক কথায় বলা চলে, কেসিসি লোনের ক্ষেত্রে ঋণখেলাপীর সংখ্যা নিতান্ত কম নয় এবং ক্ষুদ্র ও গরিব কৃষকদের একাংশ ঋণ পরিশোধ করতে হিমসিম খাচ্ছে। ধনী কৃষকদের বড় অংশই, অন্তত কেসিসি ঋণের ক্ষেত্রে, ঋণের টাকা মিটিয়ে দিতে সক্ষম এবং তাদের ক্ষুদ্র একটা অংশ ছাড়া, বাকিরা ঋণ পরিশোধ করছে।

নিঃসন্দেহে এই সমীক্ষা অত্যন্ত প্রাথমিক স্তরের, যা চালানো হয়েছে মাত্র দু তিনটি ‘সোসাইটিকে’ ধরে। আর বলতে গেলে, প্রায় কেসিসির মতো একটিমাত্র বিষয়কে ঘিরেই সমীক্ষা করা হয়েছে। ফলে এর মধ্য দিয়ে গ্রামের কৃষকদের প্রকৃত অবস্থার অতি সামান্য অংশই ধরা পড়বে। তবুও সমবায়ের মাধ্যমে কৃষিঋণের গতিবিধির একটা সাধরণ প্রবণতার (Trend) হদিশ এই সমীক্ষা থেকে পাওয়া যায়।

হুগলী জেলার সমৃদ্ধ কৃষি এলাকায় অনেক বড় বড় সমবায় সমিতি আছে। সমবায়ের মাধ্যমে ‘হিমঘর’ গড়ে তুলে বার্ষিক কোটি কোটি টাকার ব্যবসা চালানো হয় এবং ধনীকৃষক, কুলাক লবি থেকে শুরু করে বড় ব্যবসাদারদের মাতব্বরি সেখানে প্রশ্নাতীত। সমবায় নিয়ে আশা করি, অনেকেই আরো বহু বিষয়ে সমীক্ষা চালাবেন। কিন্তু আপাতত সমবায়ের যে বৈশিষ্ট্যগুলি সর্বত্র একই ধরনের সেগুলিকে নিয়েই – যেমন সেচের বন্দোবস্ত, সার-বীজ-কৃষি সরঞ্জাম সরবরাহ, কৃষি উন্নয়ন, বীজ উৎপাদন ইত্যাদি-সমীক্ষা চালানো উচিত। একটি একটি বিষয় ধরে সমীক্ষা, আর তার মধ্যেই ধরা পড়বে যে ছো‌ট ছোট দুর্নীতি ও অনিয়ম, তার বিরুদ্ধে প্রচার আন্দোলন চালিয়েই আমরা গ্রাম জীবনে ‘পঞ্চায়েতের’ পরই যে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, সেই সমবায় সংগঠনে হস্থক্ষেপ করে গ্রামীণ গরিবদের আরো ঐক্যবদ্ধ করতে পারি।

– মুকুল কুমার     

খণ্ড-27
সংখ্যা-37