মোদীর কৃষি বিল: ভারতের কৃষকদের ওপর মারণ আঘাত
vre

নরেন্দ্র মোদীর গালভরা বচন ‘আচ্ছে দিন’-এর মর্মোদ্ধারে ভারতের তবু কিছুটা সময় লেগেছিল, কিন্তু তাঁর সাম্প্রতিকতম জুমলা (শূন্যগর্ভ বচন) ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে পড়ছে অতি দ্রুত। মোদী সরকারের কাছে ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর একটাই অর্থ – ভারতের গোটা অর্থনীতিটাকে আদানি-আম্বানি উদ্যোগে পরিণত করা!

ভারতের পরিকাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর বেসরকারিকরণের এক আক্রমণাত্মক অভিযান শুরু করার পর সরকার এখন যুদ্ধ শুরু করেছে ভারতের কৃষি ও কৃষকদের বিরুদ্ধে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে (২০২০-র এপ্রিল থেকে জুন) অর্থনীতির সমস্ত ক্ষেত্রেই জিডিপি’র বিপুল পতনের মধ্যে কৃষিই ছিল একমাত্র ক্ষেত্র যাতে কিছু প্রকৃত বৃদ্ধি ঘটেছিল। সরকার সেই ভারতীয় কৃষির নিয়ন্ত্রণকেই এখন তুলে দিতে চাইছে কর্পোরেট চালিত কৃষি-ব্যবসার হাতে।

এই লক্ষ্যে গত ৫ জুন তিনটে কৃষি অধ্যাদেশ জারি হলে সারা দেশের কৃষকরাই এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু অনেক বিলম্বে সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু হলে সরকার এই অধ্যাদেশগুলোকে বিলে পরিণত করল আর তারপর সংসদীয় গণতন্ত্রের চরম প্রহসন ঘটিয়ে কোনো ভোটাভুটি চলতে না দিয়ে সেগুলোকে পাশ করিয়ে নিল।

সমস্ত দিক থেকেই বোঝা গেছে যে রাজ্যসভায় সদস্য সংখ্যা সরকারের অনুকূলে ছিল না এবং বিরোধী সদস্যরা ভোটের দাবি জানালে সরাসরি সম্প্রচার স্তব্ধ করে দেওয়া হয় এবং রাজ্যসভার পরিচালক বিল পাশ হয়ে গেছে বলে ঘোষণা করে দেন। এরপর সংসদীয় রীতিকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান খারিজ করে দিলেন অসংসদীয় পথের আশ্রয় নেওয়া ডেপুটি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবকে এবং তিনি সাসপেন্ড করলেন প্রতিবাদকারী বিরোধী সাংসদদের। ভারতীয় কৃষকদের ভারতের নয়া কোম্পানিরাজের দাসত্বের অধীন করে তুলতে সরকার প্রকাশ্য দিবালোকে গণতন্ত্রকে নিধন করল।

এই বিলগুলোর উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে সরকারের দাবি প্রতারণা ও মিথ্যায় পরিপূর্ণ। বিলগুলোর শিরোনামও চূড়ান্তরূপেই বিভ্রান্তিকর। একটা বিলের শিরোনাম হল কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ব্যবসা ও বাণিজ্য (সহায়তা ও সহজীকরণ) বিল ২০২০। অন্য আর একটা বিলের শিরোনাম হল কৃষকের (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) মূল্য লাভের সুনিশ্চয়তা ও কৃষি পরিষেবা সম্পর্কিত চুক্তি বিল ২০২০। সরকার দাবি করছে যে বিলগুলোর লক্ষ্য হল আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ থেকে কৃষকদের মুক্ত করা, উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয় সম্পর্কে তাদের পছন্দকে সম্প্রসারিত করা এবং বেশি দাম পেতে তাদের সামর্থ্যকে বাড়িয়ে তোলা। সরকারের আরও দাবি – বিলগুলো কোনোভাবেই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য লাভের এবং কৃষকরা এখন যেখানে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করেন সেই মান্ডিগুলোর (কৃষিপণ্য বাজার কমিটি) বিদ্যমান ব্যবস্থার বিলোপ ঘটাচ্ছে না।

সরকার ফসল সংগ্ৰহের দায়িত্ব পরিত্যাগ করলে তার পরিণতি কী হতে পারে তা বোঝার জন্য আমরা বিহারের দিকে তাকাতে পারি। ওই রাজ্যে নীতীশ কুমার সরকার সেই ২০০৬ সালেই এপিএমসি আইন প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। তথ্যের অধিকার আইনের আশ্রয় নিয়ে ওয়েব পত্রিকা দ্য ওয়্যার যে তথ্য সংগ্ৰহ করে তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২০-২১ রবি মরশুমে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সংস্থাগুলো বিহারে গম উৎপাদনের আনুমানিক পরিমাণের মাত্র ০.১ শতাংশ কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্ৰহ করেছে। এবং এটা কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, গত চার বছরে বিহারে সরকারের কেনা ফসলের পরিমাণ ২ শতাংশেরও কম হয়েছে। ধান সংগ্ৰহের ক্ষেত্রেও পরিসংখ্যানগুলো একই ধরনের জঘন্য বলে দেখা গেছে, এবং ভুট্টা সংগ্ৰহের ক্ষেত্রেও পরিসংখ্যান এর চেয়ে কোনো অংশে উৎকৃষ্ট নয়। সারা দেশের কৃষকরা যখন স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুসারে বর্ধিত সহায়ক মূল্য এবং যথাসময়ে ও সুনিশ্চিত সংগ্ৰহের জন্য লড়াই করছেন, সরকার তখন এই ব্যাপারে তাদের দায়িত্বকে সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে কৃষি বাণিজ্যে যুক্ত বেসরকারী ক্ষেত্রের কোম্পানিগুলোর হাতে নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে চাইছে। বেসরকারী ক্ষেত্রের খেলোয়াড়রা যখন গোটা ব্যবস্থাটায় আধিপত্য করবে, তখন কাগজে-কলমে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য এবং এপিএমসি’র অস্তিত্ব থাকলেও তাতে সাধারণ কৃষকদের কোনো সুরাহা হবে না। কৃষিকাজে নিযুক্ত ভারতের ব্যাপক সংখ্যক জনগণের কাছে এর তাৎপর্য ভয়াবহই হতে পারে।

বিলে যখন ব্যবসা ও বাণিজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা করা ও তাকে সহজসাধ্য করে তোলার কথা বলা হচ্ছে, তখন কৃষিপণ্যের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বেসরকারী কোম্পানিগুলোর কথা মাথায় রেখেই তা বলা হয়েছে। এই সংস্থাগুলোই এখন যেখান থেকে খুশি কেনার এবং ইচ্ছেমত যতখুশি মজুত করার স্বাধীনতা পাবে। সরকার আমাদের এই কথাটা বিশ্বাস করতে বলছে যে, কৃষকরাও একই ধরনের স্বাধীনতা পাবেন, কিন্তু কৃষিপণ্যের ব্যবসায় যুক্ত সংস্থাগুলোর ক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কৃষকদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে কি? কাজেই, পণ্যের মূল্য কি হবে তা নির্ধারণ করার সুবিধা সবসময় ব্যবসায়ীদের হাতেই থাকবে, এবং এরসাথে আন্তঃরাজ্য বাণিজ্য এবং যত ইচ্ছে মজুতের নবলব্ধ স্বাধীনতা যুক্ত হয়ে তা নিজেদের নিয়ন্ত্রণকে আরও শক্তিশালী করতেই ব্যবসায়ী সংস্থাগুলোকে মদত জোগাবে। কৃষিপণ্যের ব্যবসায় যুক্ত প্রভূত ক্ষমতাধর কোম্পানিগুলোর সঙ্গে লেনদেন চালানোর কৃষকদের ‘স্বাধীনতা’র নতুন রূপের এক দাসত্বে পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না, যেখানে কোম্পানিগুলোর হাতেই থাকবে নিয়ন্ত্রণের লাগাম। ক্ষুদ্র কৃষকদের এবং জমি ভাগে নিয়ে চাষ করা ভাগচাষিদের ক্ষতিগ্ৰস্ত করা ছাড়াও খাদ্যশস্য উৎপাদনে ভারতের স্বয়ম্ভরতায় এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও গণবন্টনের গোটা ব্যবস্থাটায় এক ভয়ঙ্কর ধাক্কা দেওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা নতুন এই ব্যবস্থার রয়েছে। চুক্তি চাষ কৃষি উৎপাদনের প্রধান ধারা হয়ে উঠলে কৃষি ব্যবসায় নিযুক্ত কোম্পানিগুলোই তখন নিজেদের স্বার্থ এবং মুনাফার লালসা চরিতার্থ করার হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে চাষের ধরনকে নির্ধারিত করবে, ভারতের শতাধিক কোটি জনগণকে খাদ্য জোগানের প্রয়োজন তাদের কাছে আদৌ আমল পাবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সুবিশাল নেটওয়ার্ক বিএসএনএল-এর ক্ষতির মূল্যে যেমন মুকেশ আম্বানির জিও’র বাড়বাড়ন্ত ঘটানো হয়েছে, একইভাবে কৃষিপণ্যের ব্যবসায় নিয়োজিত বড়-বড় বেসরকারী খেলোয়াড়দের বেদীমূলে ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়াকেও বলি দেওয়া হবে।

ভারতের যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ইতিমধ্যেই অনেকটা দুর্বল করে তোলা হয়েছে, নতুন ব্যবস্থা তাতে আরও প্রতিকূল প্রভাব ফেলবে। কৃষিপণ্য চলাচল এবং বিক্রয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণের কোনো ক্ষমতা রাজ্যগুলোর থাকবে না এবং কৃষিপণ্য বিপণন কমিটি (এপিএমসি) নেটওয়ার্কের মধ্যে দিয়ে যেটুকু রাজস্ব তারা অর্জন করত সেটুকুও তারা হারাবে। অন্যদিকে, সমস্ত ক্ষমতাই কুক্ষিগত করবে কেন্দ্রীয় সরকার এবং বড়-বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলো। সরকার এই বিলগুলোকে ভারতীয় কৃষির রূপান্তরণের অগ্ৰদূত বলে শোরগোল তুলছে এবং এটাকে ভারতীয় কৃষকদের স্বাধীনতার এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত রূপে অভিহিত করে এই মারণ আঘাতকে আড়াল করতে চাইছে। বিমুদ্রাকরণ এবং জিএসটি চালু করার পর যে ধরনের আত্মস্তুতির ঘটা আমরা দেখেছিলাম, এটা অনেকটা সেই ধরনের। প্রাপ্ত সমস্ত ইঙ্গিত থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, নতুন এই ‘সাহসী সংস্কার’গুলোর পরিণাম বিমুদ্রাকরণ এবং জিএসটি পরবর্তী পর্যায়ে ঘটা বিপর্যয়ের মতোই হবে। সরকারের প্রতারণামূলক প্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে পড়ে নির্ভিক প্রতিরোধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য ভারতীয় কৃষকদের আমাদের অবশ্যই অভিনন্দন জানাতে হবে। কৃষকদের প্রতিবাদের প্রতাপ ইতিমধ্যেই আকালি দলের মন্ত্রীকে মোদীর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগে এবং কয়েকটি রাজ্য সরকারকে বিলগুলোর প্রতি বিরোধিতা প্রকাশে বাধ্য করেছে। ছ’বছর আগে কৃষকদের এবং বিরোধী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের মুখে মোদী সরকার তার জমি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কৃষক সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ মঞ্চের দৃঢ় প্রতিরোধের মুখে মোদী সরকার যাতে আবারও পিছু হটতে বাধ্য হয় আমাদের তা সুনিশ্চিত করতে হবে। এই লড়াইয়ে জয়ী হতে গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানো প্রতিটি নাগরিককেই কৃষকদের সাথে হাত মেলাতে হবে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়,   
২২ সেপ্টেম্বর ২০২০)   

খণ্ড-27
সংখ্যা-35